মসজিদে কুবা, হযরত মোহাম্মদ (সাঃ ) এর নিজ হাতে গড়া পৃথিবীর প্রথম মসজিদ
দ্বিতীয় দিনের ভোর শুরু হলো ফজরের নামাজ দিয়ে। মসজিদে নববীর বিখ্যাত সবুজ নরম কার্পেটে বসে দুই হাত তুলে আল্লাহর রহমত কামনা করছিল সবাই। প্রতিটি নামাজের পর আবার একটি নামাজ শুরু করতেন ইমাম সাহেব। পরে জেনেছি প্রতিটি নামাজের শেষে জানাজার নামাজ হতো। মদীনায় কেউ মারা গেলে তাকে এই মসজিদে আনা হয় জানাজা পড়ার জন্য। এত মানূষ হয়েছিল সে সময় যে স্থানীয়রা পর্যন্ত বলছিল হজ্ব ছাড়া ওমরাহয় এত মানুষ তারা আগে দেখে নি।সেই অজানা অচেনা ব্যাক্তির জন্য সেই হাজার হাজার মানুষ দু হাত তুলে মোনাজাত করতো তার সকল গুনাহ মাফের জন্য,সেই সাথে তাদের নিজেদের মৃত আত্মীয় স্বজনের জন্যও। আমরাও শরিক থাকতাম সেই নামাজে।
ওহুদের পথে
রুমে ফিরে সবাই নাস্তা খেতে যেতাম হোটেলের রেস্তোরায়। রুম ভাড়ার সাথে সকালের নাস্তা ইনক্লুড ছিল। এখানে একটা কথা উল্লেখ না করে পারছি না সেটা হলো পৃথিবীর অনেক দেশের বিভিন্ন তারকা যুক্ত হোটেলে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, সাথে ব্যুফে সিস্টেমে সকালের নাস্তা তো থাকেই।সেখানে তুমি পেট ভরে যত খেতে পারো কিন্ত সাথে করে রুমে কিছু নিতে পারবে না, খুব বেশি হলে সাজানো ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল বা কমলা এমন। কিন্ত এখানে আমি যখন যথারীতি আমার প্রিয় পাউরুটি মাখন দিয়ে নাস্তা করে উঠে আসার সময় জিজ্ঞেস করলাম আমি একটা আপেল নেই ? উত্তর আসলো "তোমার যা খুশী, যত খুশী নিয়ে যাও"। আমি তো অবাক পরে জানলাম আমরা তো তাদের মেহমান। সারা জীবন শুনে এসেছি আরবরা আমাদের বলে মিসকিন কিন্ত আমার অভিজ্ঞতা ব্যাতিক্রম সেটা পরে বলছি।
বর্তমানে সেই প্রান্তরের এক কোনায় পার্কিং আর অদুরে ওহুদ পাহাড়
পরদিন সকাল নটায় আমাদের মোয়াল্লেম মদীনার কিছু বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থান দেখাতে নিয়ে গেল। বিশাল এক এসি (অবশ্য সেখানে সব যানবাহনেই এসি) বাস আসলো আমাদের ১৪ জনের জন্য । ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসলাম সবাই। আমাদের এই দলের সবাই সবার পুর্ব পরিচিত তাই অস্বস্তি লাগছিলো না। ছিমছাম নিরিবিলি মদীনা শহর ঘুরে ঘুরে আমরা একটা পাহাড় ঘেরা জায়গায় আসলাম। এই হলো সেই বিখ্যাত ওহুদ যুদ্ধের ময়দান যা মসজিদে নববী থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে। ইতিহাস বিখ্যাত সেই ওহুদ পাহাড়ের এক অংশ
মক্কা থেকে নবীজি মদীনায় হিজরতের পর মক্কার কুরাইশরা মদীনায় নবীজীর প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে শংকিত হয়ে উঠে। তারা মুসলিমদের ধ্বংস করার জন্য ২রা হিজরীর ১৭ রমজান বদর নামে এক জায়গায় মদীনার মুসলমানদের আক্রমন করে। ভয়ংকর সেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে কুরাইশরা পরাজিত হয়। তারই প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ২৩ শে মার্চ ৬২৫ খৃঃ মদীনার ওহুদ প্রান্তরে কুরাইশরা আবার এক হয়। এই যুদ্ধ ইতিহাসে ওহুদের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে আমাদের প্রিয় নবী করিম সা. তাঁর নিজ গোত্রের কাছ থেকেই ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হন। যেই আক্রমন মদীনার মুসলমানদেরকে বিপর্যস্ত করে ফেলে।
এই যুদ্ধেের সাথে জড়িয়ে আছে ইসলামের ইতিহাসের অজস্র স্মৃতি, ত্যাগ, শিক্ষা, যুদ্ধকৌশল,মুনাফিকের ধোঁকা সহ আরো অনেক ঘটনা। এক কথায় ওহুদের যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্য অগ্নিপরীক্ষা, তাই ইসলামের ইতিহাসে এই যুদ্ধটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি যুদ্ধ। ইতিহাসে বহুবার পড়া সেই ঘাসহীন লাল মাটির ওহুদ প্রান্তরে যাকে ঘিরে আছে রুক্ষ লাল পাথরের ওহুদ পাহাড়। সেই মাটিতে বসে দুই একজন বৃদ্ধ মহিলা খেজুর, মরিয়ম ফুল আর কবুতরকে দেয়ার জন্য গমের দানা বিক্রি করছিল। আমি বিনা প্রয়োজনেই একটা ডুমুরের মালা কিনলাম। আর কবুতরের জন্য খাবার।
সেই ওহুদের বিরান প্রান্তরে এক ভদ্রমহিলা কবুতরকে খাবার দিচ্ছে
পোড়ামাটির ময়দানে দাঁড়িয়ে মনটা বিষন্ন হয়ে উঠলো। বই এ পড়েছিলাম সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও ওহুদের যুদ্ধে মুসলিমরা প্রথমদিকে সাফল্য লাভ করেছিল এবং মক্কার সৈনিকরা পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছিল। বিজয়ের খুব কাছাকাছি থাকা অবস্থায় মুসলিম বাহিনীর কিছু অংশের ভুল পদক্ষেপের কারণে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। হযরত মুহাম্মদ (সঃ) মুসলিম তীরন্দাজদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যে ফলাফল যাই হোক কেন তারা যেন যুদ্ধের ময়দানের পেছনে থাকা ছোট একটি পাহাড় নাম জাবালে রুমা থেকে যেন সরে না আসে। আরবী ভাষায় জাবাল মানে পাহাড়। জাবালে রুমা
কিন্তু সেই সাহাবীরা হজরতের নির্দেশ অমান্য করে অবস্থান ত্যাগ করার পর মক্কার কুরাইশ বাহিনীর অজেয় সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ যিনি তার জীবনের ১০০ টি যুদ্ধের প্রতিটিতে জয়ী হয়েছিলেন তিনি মদীনার মুসলিমদের উপর নির্দয় ভাবে ঝাপিয়ে পরে তাদের হত্যা করেন। এই নিহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বীর যোদ্ধা হামজা বিন মুত্তালিব যাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। এই হামজা ছিলেন যেন ট্রয়ের হেক্টর, লংকার মেঘনাদ। সম্পর্কে আপন চাচা এবং বাল্যবন্ধু হামজার মৃত্যু নবীজীর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল। এই যুদ্ধে রসুল(সঃ ) নিজেও আহত হয়েছিলেন। এরপর মুসলিমরা উহুদ পর্বতের দিকে পিছু হটে আসে। মক্কার বাহিনী মক্কায় ফিরে যায়। অবশ্য পরে খালিদ বিন ওয়ালিদ ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে মুসলমান বাহিনীর সেনাপতি হিসেবে সব যুদ্ধেই জয়ী হয়েছিলেন।
ওহুদের প্রান্তরে এই সেই কবরস্থান যেখানে শুয়ে আছেন বীর হামজা সহ অনেক শহীদ
এই ময়দানের কিছুটা অংশ উচু রেলিং দিয়ে ঘেরা মাঝখানে শিক দিয়ে চৌকো করা নকশা। আমরা জানলাম এখানে আছে হামজা বিন মুত্তালিব ছাড়াও দশ হাজার সাহাবীর কবর। মেয়েদের কবরস্থানে যাওয়ার নিয়ম নেই তাই আমরা উকি ঝুকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলাম। সমান লাল বালুময় মাটি আর কাকর বেছানো সেই কবরস্থানে কোন চিনহ বা সৌধ নেই। শুধু কিছু বড় বড় পাথরের টুকরো দিয়ে ঘেরাও করা ।
মসজিদে কিবলাতাইন বা দুই কিবলার মসজিদ
এরপর আমাদের গন্তব্য ছিল মসজিদে কিবলাতাইন অর্থাৎ দুই কিবলার মসজিদ । এই মসজিদেই প্রিয়নবীর (সা: ) এক দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছিল। এখানে নামাজ পড়ার সময়ই নবীজির কাছে কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশের ওহি আসে। কিবলা পরিবর্তন সম্পর্কিত পবিত্র কোরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়।
ইরশাদ হয়, “ নিশ্চয় আমি আপনার মুখ বার বার আকাশের দিকে উঠতে দেখছি। সুতরাং আমি অবশ্যয় আপনাকে এমন কিবলার দিকে ফিরিয়ে দেব যা আপনি পছন্দ করেন। এখন আপনি আপনার মুখ মসজিদুল হারামের দিকে ফিরান” (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৪৪)।
এরপর রাসূল সা. নামাজরত অবস্থায় বাইতুল মুকাদ্দাসের দিক থেকে কাবার দিকে ফিরে যান। তার সাথে জামাতে নামাজে দাঁড়ানো মুসল্লিরাও ফিরে যায়। একই মসজিদে দাঁড়িয়ে যেহেতু হুজুরে পাক সাঃ দুই কিবলার দিকে মুখ করে নামাজ পড়েছিলেন তাই এই মসজিদের নাম ‘মসজিদে কিবলাতাইন’ বা ‘দুই কিবলার মসজিদ’ রাখা হয়েছে।
দুই কিবলার মসজিদ কিবলাতাইন
এখানে আমরা সবাই বাস থেকে নেমে মহিলা পুরুষরা আলাদা লাইনে সারিবদ্ধভাবে মসজিদে প্রবেশ করি। এরপর ওযু করে দু রাকাত নফল নামাজ আদায় করি। মনটা এত প্রশান্ত ছিল যে এখানে আসার সৌভাগ্য হয়েছে যেখানে আমাদের নবীজি নামাজ পরেছিলেন, আবার উদ্ববিগ্নও ছিলাম আল্লহ রাব্বুল আল আমীন কি আমার শত শত গুনাহ মাফ করবেন ?
৬টি গম্বুজ আর ৪টি মিনারের কিছু অংশ
মসজিদে কুবা, পৃথিবীর প্রথম মসজিদ
শেষ গন্তব্য ছিল মসজিদে কুবা,পৃথীবীর বুকে প্রথম নির্মিত মসজিদ। মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর মদিনার অদূরে কুবায় থাকা কালে এই মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। এর আগে মক্কায় তিনি কোনো মসজিদ নির্মাণ করেননি। ৬টি গম্বুজ আর ৪টি মিনার সহ এই মসজিদের অবস্থান চতুর্থ। অর্থাৎ মক্কা, মদীনা আর আল আকসার পরই এই মসজিদ কুবা। অত্যন্ত তাৎপর্যপুর্ন এই মসজিদটি দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ সেই দয়াময়ের কাছে যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন ।
চলবে
ছবি ঃ জাবাল রুমা ছাড়া বাকিগুলো আমার মোবাইলে ।
পশ্চিমের পথে এক গুনাহগারের পবিত্র ওমরাহ যাত্রা(তৃতীয় পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৩ রাত ৮:৪২