স্বর্নালী শোভায় শোভিত ঐতিহ্যবাহী লোহা প্রাসাত মন্দির
গতকালের সুর্যকরোজ্জ্বল আকাশটা আজ মেঘের ভারে টইটম্বুর, মাঝে মাঝে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির সাথে বাতাসে একটা ঠান্ডা শীতল ভাব । থাইল্যান্ডর বছর জুড়ে চলতে থাকা তাপদাহের মাঝে আজ যেন এক প্রশান্তিময় দিন। এমন দিনে ঘরে বসে থাকতে কি ভালো লাগে ! সহ পর্যটককে বললাম,
"কতদিন ধরে ব্যংককে আছি, দেশ বিদেশের কত যাদুঘরই তো দেখলাম কিন্ত আজ পর্যন্ত এদেশের জাতীয় যাদুঘরটি দেখাই হলো না, চলো না আজ দেখে আসি"। ভদ্রলোক কালিদাসের মত মোটেই রোমান্টিক নন যে মেঘ দেখে পাগল হয়ে আমার সাথে রওনা দিবে। টিভি থেকে মুখ না সরিয়েই সটান জানিয়ে দিল যাদুঘর দেখতে হলে যেই পরিমান হাটতে হবে সেই পরিমান এনার্জি বা শখ কোনটাই তার নেই । কারন আগের দিনই আমি নাকি তাকে কোন শপিং এরিয়াতে নিয়ে গিয়ে প্রচুর হাটিয়েছি। কি আর করা শেষ পর্যন্ত আমি একা একাই রওনা দিলাম।
নান্দনিক নকশায় তৈরী সেতু
সকাল সকাল বাসার কাছের বোট পিয়ের থেকে বোটে উঠে সোজা যাদুঘরের সবচেয়ে কাছের পিয়ের ফানফা লিলার্ড এর টিকিট কাটলাম ১৭ বাথ দিয়ে। হাল্কা বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিয়ে সানসেপের (খালে) মাঝ বরাবর নৌকা ছুটছে তীব্র গতিতে। এ ঘাট ও ঘাট করতে করতে একসময় ফানফা এসে পৌছালাম। এখানে নেমে কয়েকটি সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই ছোট একটা নান্দনিক নকশায় তৈরী লোহার ব্রীজ আর সেই ব্রীজ পার হলেই রাজপুরীতে যাওয়ার বিখ্যাত রাজপথ Ratchadamnoen Avenue । সুপ্রশ্বস্ত রাস্তার দুপাশে বাধানো ফুটপাথ জুড়ে যে ছায়াময় গাছ তারই ছায়ায় ধীরে ধীরে হেটে যাচ্ছি আমি। হাতের বায়ে রাজা নংক্লাও এর অনুরোধে ১৮৪৬ খৃষ্টাব্দে নির্মিত ব্যাতিক্রমী নকশায় তৈরী বিখ্যাত লোহা প্রাসাত যাকে নিয়ে আমার একটি পোষ্ট লেখার ইচ্ছে আছে । আরেকটু এগুতেই ডানে শ্বেতাংগ পর্যটকদের স্বর্গ খাওসান রোড। এর চেহারায় অনেকে কলকাতার সদর স্ট্রীটকে খুজে পাবেন।
ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে উঠে আসা কোহ সামুই মেরিন পার্ক
ক্যালেন্ডারের পাতায় ছাপানো ছবির মতই নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য ঘেরা থাইল্যান্ড দেশটি, ফিরোজা থেকে নীল,নীল থেকে গভীর নীলাভ আদিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র রাশি যার বুকে মাথা উচু করে আছে অসংখ্য দ্বীপমালা। ভঙ্গুর পাহাড়ের ফাকে ফাকে সাদা সফেদ বালুকাবেলা, আর গাঢ় সবুজ পাহাড়। প্রকৃতির এই অসাধারন রূপকে অত্যন্ত যত্ন আর সচেতনতার সাথে লালন করা ছাড়াও ঐতিহ্য প্রিয় থাইরা তাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে একাধিক সমৃদ্ধ যাদুঘরের মাধ্যমে। এর মাঝে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ব্যাংকক জাতীয় যাদুঘর যা দক্ষিন পুর্ব এশিয়ার মাঝে সবচেয়ে বৃহত্তম। ফি বছর লক্ষ লক্ষ পর্যটককের এক বিরাট অংশকে চুম্বকের মত টেনে আনে এই যাদুঘর ।
Ratchadamnoen Avenue র ফুটপাথ ধরে এগিয়ে চলেছি
যাদুঘরটি দেখতে আসার আগেই বিষয়টি নিয়ে কিছুটা প্রাথমিক ধারনা নিয়েছিলাম যা আমার অভ্যাস। এর ফলে যা দেখতে যাচ্ছি তা কিছুটা ভালোভাবে বুঝতে পারা যায়। আধুনিক থাইল্যন্ডের ইতিহাসে এক অনন্য উচ্চতায় আসীন চক্রী বংশের পঞ্চম রামা রাজা চুলালংকর্ন সম্পর্কে আমার জানাশোনা ছিল আগে থেকেই । তার প্রগাঢ় দেশপ্রেম ও দেশকে আধুনিকীকরনের জন্য অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ তিনি নিয়েছিলেন আর তারই একটি হচ্ছে এই যাদুঘরটি নির্মান। তাঁর পিতা গ্রেট কিং মংকুটের (চতুর্থ রামা) ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল থাই ইতিহাস ও শিল্পের অনেক দুস্প্রাপ্য ও দুর্লভ শিল্পকর্ম। প্রধানত সেগুলো সংরক্ষন ও জাতির সামনে শ্যামদেশের গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরার উদ্দ্যেশ্য নিয়েই রাজা চুলালংকর্ন ১৮৭৪ খৃষ্টাব্দে এই যাদুঘরটি নির্মান করেন। ব্যাংককের এই যাদুঘর থাইল্যান্ডের জাতীয় যাদুঘরের অন্যতম প্রধান শাখা ।
পেছনেই থাই রাজকীয় প্রাসাদ
প্রথম দিকে যাদুঘরটি গ্রান্ড প্যালেসের ভেতরের দিকে ছোট অবস্থায় থাকলেও পরে পঞ্চম রামা একে সামনের প্রাসাদে (ফ্রন্ট প্যালেস) নিয়ে আসেন যা ছিল রাজা মংকুটের ভাই পিনক্লাও এর রাজকীয় প্রাসাদ। সে সময়কার নিয়ম অনুযায়ী পিনক্লাও ছিলেন রাজা মংকুটের সহরাজা। পরে চুলালংকর্ন এই সহরাজার প্রথাটি বাতিল করে সন্তান বা বংশধরের মাধ্যমে উত্তরাধিকারী প্রথার প্রচলন করেন সে আরেক ইতিহাস।
ব্যাংকক জাতীয় যাদুঘর তোরন
পরিচিত রাস্তার ফুটপাথ দিয়ে হেটে হেটে ইতিহাসের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া আমি অবশেষে হাজির হোলাম জাতীয় যাদুঘরে্র তোরনের সামনে। যার অদুরেই রয়েছে থাই রাজার আবাসস্থল গ্র্যান্ড প্যালেস। টিকিট কাটতে লাইনে দাড়িয়েছি, ছোট জানালার কাছে মুখ এনে ভাংগা ভাংগা ইংরেজীতে ভদ্রলোক আমাকে প্রথমেই ধন্যবাদ জানিয়ে মাথা ঝুকিয়ে জানালো সংস্কার কাজের জন্য তাদের কিছু কিছু প্যাভিলিয়ন বা স্থাপনা বন্ধ আছে, আমি কি তারপরও তাদের যাদুঘর দেখতে রাজী কি না? কারন টিকিটের দাম কমানো সম্ভব না। কিন্ত আমি আজ দেখবোই তাই মাথাপিছু ২০০ বাথ বাংলাদেশি টাকায় ৬০০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম যাদুঘরের আংগিনায়।
প্রথমেই নজর কাড়বে চারিদিক খোলা কালো আর সোনলী রঙ্গে অপরূপ কারুকাজ করা একেবারে ট্রাডিশনাল নকশায় তৈরী প্যাভিলয়ন সালা লং সং ।
বর্তমানে এই যাদুঘরের বিভিন্ন প্যাভিলিয়নের গ্যালারীতে সাজানো রয়েছে এই অঞ্চলের নিওলিথিক যুগের মানুষের হাতে তৈরী বিভিন্ন দুস্প্রাপ্য শিল্পকর্ম। প্রদর্শিত আছে সুকোথাই রাজ্যের বিখ্যাত রাজা যিনি থাই অক্ষরের জনক তথা স্রষ্টা সেই মহান রামখামহ্যাংএর থাই অক্ষরে লেখা বিখ্যাত শিলালিপিটি যা জাতিসংঘের সন্মানসুচক সনদপ্রাপ্ত। এই যাদুঘরে প্রদর্শিত শিল্পকর্মগুলোর উপর বিশেষজ্ঞরা গবেষনা করে দেখেছেন এগুলো সেই প্রাচীন শ্যামদেশের দিভারাভতী, সুকোথাই, আয়ুথিয়া ও প্রাচীন সুমাত্রার শ্রীবিজয়া রাজত্বকালের দুস্প্রাপ্য সব শিল্পসম্ভার। গৌতম বুদ্ধের জীবনের নানান ঘটনাকে উপজীব্য করে এশিয়ার এই ভুভাগে যে নতুন এক শিল্পকর্মের উদ্ভব হয়েছিল তার এক বিশাল সংগ্রহ রয়েছে এই যাদুঘরে। এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ভারতের গান্ধারা শিল্প, চীনের তাং, ভিয়েতনামের চাম, ইন্দোনেশিয়ার জাভার বরবোদুর আর ক্যাম্বোডিয়ার খেমার শিল্পের নাম উল্লেখযোগ্য।
আগামী পর্বে সমাপ্তি ।
সমস্ত ছবি আমার ক্যামেরা আর মোবাইলে তোলা
শেষ পর্ব
ব্যাংকক জাতীয় যাদুঘর, থাই ইতিহাস আর ঐতিহ্যের মিলনমেলা ( শেষ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০২১ বিকাল ৪:৪৮