বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে থাকা ভয়ংকর প্রেতাত্মা মায় নাক
মাস কয়েক আগে ব্যাংককের এক শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকায় শিরোনাম মায় নাক আবার হাজির , সাথে রাস্তার পাশে সাদা পোশাকে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চা কোলে এক তরুনীর সাহায্যের জন্য হাত বাড়ানো ছবি। কৌতুহলী হয়ে উঠলাম এই মায়-নাক জিনিসটা আবার কি! পত্রিকার খবর থেকে যতটুকু জানা হলো তাতে বোঝা গেলো যে মায়-নাক এক নারী প্রেতাত্না। যার নাম শুনলে আজও বেশিরভাগ থাইবাসীরা আতকে উঠে। নেট থেকে জানলাম তার নামে একটি মন্দিরও রয়েছে ব্যাংককের প্রানকেন্দ্র প্রাখানং এলাকার ওয়াট মহাভুতে। সাথে সাথেই মাথায় পোকা ঢুকে গেল ওখানে আমাকে যেতেই হবে যেমন করেই হোক। তাই এবার আমার ব্যাংকক ভ্রমনের প্রাইম লিষ্টে ছিল এই মহাভুত মন্দির দর্শন ।
স্কাই ট্রেনে আমি বহুবার পাড়ি দিয়ে গেছি প্রাখানং স্টেশন , কিন্ত মন্দিরে যেতে হলে আমার একজন স্থানীয় গাইড দরকার, সেটাও জোগাড় হলো। আপনারা যদি কেউ যেতে চান তবে সুকুমভিত লাইনের স্কাই ট্রেন স্টেশন অননুট এ নেমে যে কোন ট্যাক্সিচালককে বললেই হবে আপনি ওয়াট মহাভুতে যেতে চান। মন্দিরটি প্রাখানং এ হলেও অননুট বিটিএস থেকে কাছে হয়। ওখান থেকে ট্যাক্সি ভাড়া ৫০ কি ৬০ বাথ। অবশ্য ২০ মিনিটের পথ আপনি হেটেই যেতে পারবেন শ্বেতাংগ পর্যটকদের মত যদি ব্যাংককের বিখ্যাত রোদে পুড়ে অংগা্র হতে চান ।
মহাভুত মন্দির প্রাঙ্গনে অপরূপ নকাশায় তৈরী চিতাপীঠ
৩রা জুন সোমবার সকাল ১০টায় গাইডকে নিয়ে রওনা দিলাম মহাভুত মন্দির পরিদর্শনে। সকাল এগারোটায় এসে হাজির হোলাম মহাভুত মন্দির প্রাঙ্গনে। বিশাল প্রাঙ্গন জুড়ে বুদ্ধ ধর্মাবম্বীদের স্বর্নালী ছোট বড় নানান রকম মন্দিরগুলো স্থাপিত। তার মাঝে শবদেহ দাহ করার জন্য অপরূপ সৌন্দর্য্যমন্ডিত একটি চিতাপীঠও রয়েছে। এমনকি খাবার জন্য ফুড কোর্টের ব্যবস্থাও রয়েছে।
মায়-নাকের মন্দিরের সামনে ধাতব মুর্তি
এই প্রাঙ্গন দিয়ে খানিকটা এগিয়ে মোড় নিতেই দেখতে পেলাম এক কোনায় বিশাল এক অশ্বথ গাছের নীচে অন্যান্য মন্দিরের তুলনায় বেশ অনাদরে অবহেলায় দাঁড়িয়ে আছে মায়-নাকের মন্দির যেটা আমাদের আসল গন্তব্য। তবে মন্দিরটি হিন্দু বৌদ্ধ কোনরকম স্থাপত্যের নকাশায় তৈরী নয়, সিমেন্টের তৈরি সামনের দিক খোলা সাধারন একটা একচালা ঘরের মতই লাগলো দেখতে। তবে ভক্তের সংখ্যা ভালোই বলতে হবে। মন্দিরে প্রবেশ পথের পাশেই সামনের দিকে বেদীর উপর ছোট একটি ধাতব ভাস্কর্য্য সেখানে মায়-নাক বাচ্চা কোলে বসে আছে। সামনে পুজার উপকরন ও খাবার সাজানো এরই সাথে অবধারিত ভাবে রয়েছে কোমল পানীয়ের বোতল। এই কোমল পানীয় আমি সে দেশের সব প্রেত দেবতার পুজার অর্ঘ্যে দেখি বিশেষ করে লাল মিরিন্ডাতো থাকবেই !
মনস্কামনা পুরণের জন্য মরে যাওয়া অশ্বথ বৃক্ষের গুড়িতে সুদৃশ্য রঙ্গীন কাপড় পেচিয়ে দিয়ে গেছে ভক্তকুল,
পুজার জন্য ফুল রাখা
যাই হোক বেদীর পাশ ঘেষে মুল মন্দিরের সামনে এসে দাড়ালাম গাইড নিয়ে। সেখানে এক বিশাল বট বা অশ্বথ গাছের মুল রয়েছে রঙ্গীন কাপড় পেচানো । মানুষজন সেই কাপড় লাগিয়েছে তাদের মনের ঈচ্ছা পুরনের নিমিত্তে । সেটার পেছনেই মায়-নাকের মন্দির ,সামনের দিক পুরোটা খোলা থাকায় সহজেই নজরে পড়লো বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসে আছে মায়-নাক ঘরের মাঝ বরাবর। মাথায় কালো পরচুলা, সোনালী পাতে ঢাকা পরা মুখ , গর্তে ঢোকা চোখগুলো মোটা করে কাজল দিয়ে ল্যাপটানো। তাকিয়ে থাকলে মনে হবে ভয়ংকর এক তীক্ষ দৃষ্টি নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে বুঝি।
পুজা দিচ্ছে মায় নাকের পুন্যার্থীরা
পেছনে কিছু পোশাকের পাশে তার একটি ছবি ঝোলানো যা শিল্পীর আকা কি না বুঝলাম না । মা আর বাচ্চা দুজনার চেহারাই বিশেষ করে চোখের দিকে তাকালে একটা গা শিড়শিড়ে ভয় ভয় ভাব শিরদাড়া বেয়ে নেমে আসে, হতে পারে পরিবেশের কারনে । বাইরে থেকে দেখা আর কিছু ছবি তোলার পর ভেতরে মানুষকে ঢুকতে দেখে আমিও ঢুকে পরলাম । মায়-নাকের মুর্তির পাশে দাঁড়িয়ে আমি একের পর এক তার ছবি তুলেই চলেছি আমার মোবাইলে যা দেখে আমার গাইড ভীত দৃষ্টিতে বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে।
দুজন কপোত কপোতী ভালোবাসার অঙ্গীকারে
পাশেই ভক্তরা তার গায়ে স্বর্নালী পাত লাগিয়ে ফুলের তোড়া দিয়ে হাতজোড় করে প্রার্থনা করছে । এমন সময় দেখতে পেলাম দেয়ালে টাংগানো নোটিশ "নো ফতো" ! আমি কিছুটা পেছনে দাঁড়ানো গাইডের কাছে এসে দাড়াতেই সে আমাকে ফিসফিসিয়ে জানালো আমি যে নিষেধ সত্বেও মায়-নাকের ছবি তুলেছি তার জন্য সে নাকি অলরেডী মায়-নাকের কাছে আমার হয়ে মাফ চেয়ে নিয়েছে। এবার আমাকে জানালো আমি যেন হাত জোড় করে আবার মাফ চাই। কি আর করি! পরেছি মোগলের হাতে খানা খেতে হবে সাথে।
মাফ টাফ চেয়ে এবার তাকালাম মন্দিরের ভেতরে, দেয়ালের গায়ে আংটার মাঝে মায়-নাকের উদ্দেশ্যে নিবেদিত পোশাক ঝুলছে। ঝুলছে কাঁচ দিয়ে দিয়ে বাধানো তার কিছু ছবি, সেগুলো মনে হলো কোন শিল্পীর কল্পনায় আকা। আরেক দিকের দেয়াল জুড়ে কাচ লাগানো শোকেস তার ভেতরেও ভক্তদের দেয়া অনেকগুলো পোশাক যা এক একদিন পরানো হয় মায়-নাককে। এছাড়াও মায়নাকের ব্যবহারের জন্য আছে, বিভিন্ন পাথর বসানো সোনার গহনা, কসমেটিক্স, বাচ্চার খেলনা আর দান বাক্স ভরা টাকা, এগুলো সব ভক্তদের দেয়া উপহার। আর যথারীতি সামনে সাজানো রয়েছে খাবার।
মায়-নাকের উদ্দেশ্যে ভক্তদের নিবেদিত পোশাক
গাইডকে জিজ্ঞেশ করলাম এখানে লোকজনের আসার উদ্দেশ্য কি ? সে জানলো এখানে মুলত ভক্তরা আসে তাদের সত্যিকারের ভালোবাসার লোক খুজে পেতে, ভালোবাসা টিকিয়ে রাখতে আর গর্ভবতী মায়েরা আসে সুস্থ স্বাভাবিক বাচ্চা লাভের আশায় মানত করতে। এজন্যই এখানে সব অল্প বয়সীদের দেখছিলাম। ঠিক সে সময়ে নজরে পড়লো এক জোড়া কপোত কপোতী এক সেট ঐতিহ্যবাহী থাই পোশাক মেঝের উপর দিয়ে টানতে টানতে মন্দিরের ভেতরে ঢুকছে । কেউ বা দিচ্ছে টাকা তাদের টাকায় ভরে উঠছে দান বাক্স।
দানবাক্স তবে মোটা টাকা নেয়ার জন্য রয়েছে আলাদা ব্যাবস্থা
সব কিছু খুটিয়ে দেখে বের হয়ে আসলাম ছোট্ট মন্দির থেকে, বের হয়েই ডান দিকে দেখি ছোট একটি টেবিল পেতে কিন্নরের পোশাক পড়া এক না তরুন না কিশোর বসে আছে, সে নাকি ফরচুন টেলার। গাইডকে বললাম “চলো এর কাছে হাত দেখিয়ে আমাদের ভবিষ্যতটা জেনে আসি”। সাথে সাথে তার মুখটি ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো, আমার হাত চেপে ধরে বিপরীত দিকে জোর করে টেনে নিতে নিতে ভয়ার্ত গলায় বললো, “ওহ নো মামা, ইত ইজ নত পসিবল”। জিজ্ঞেশ করলাম ‘হোয়াই নট’! গাইড ফ্যাকাশে মুখে বল্লো “মে বি হি ইজ আ স্পিরিত”। আমিতো হতবাক, বললাম ‘তুমি কি করে বুঝলে’! সে আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বল্লো “এখানে যত মানুষ দেখছো তাদের মাঝে কে যে প্রেত আর কে যে মানুষ কিছুই বোঝার উপায় নেই”। ইউনিভার্সিটি পাশ করা অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষিত গাইডের কথা শুনে অবাক আমি হোলাম আরেকবার।এরপর গাইড বল্লো সে পুজো দিবে আমি যেন তাকে দশ মিনিট সময় দেই । আমি সানন্দে রাজী হয়ে গেলাম।
এই সেই গাছ যার গুড়িতে আঙ্গুল ঘষলে নাকি উঠে আসে লটারী পাওয়ার নম্বর
গাইড গেল পাশের দোকানে ফুল আর সোনালী পাত কিনতে আর আমি পাশেই এক বিশাল গাছের গুড়ির কাছে কিছু লোক দাঁড়ানো দেখে সেখানে গেলাম। দেখলাম গাছের মুল কান্ডের মাঝে মাঝে কালো রঙের তেলতেলে মসৃন ছোট ছোট আকারের গর্ত। একজন লোক মনে হলো সে এটার তদারক করে আমাকে থাই ভাষায় কি বল্লো আমি বুঝলাম না। দু তিন জনকে দেখলাম সেই গর্তগুলোর মধ্যে আঙ্গুল ঘসছে। আমিও ঘসলাম দেখি আঙ্গুলের মাথাটি তেলতেলে হয়ে উঠলো। আমি সামনে এসে দেখি গাইডের পুজা দেয়া শেষ , তাকে ডেকে এনে জিজ্ঞাস করলাম এটা কি? গাইড লাজুক লাজুক ভাবে জানালো এই গর্তের মাঝে পাউডার দিয়ে ঘসলে একটা নম্বর ঊঠে সেই নম্বরে লটারীর টিকিট কাটলেই নাকি বাজিমাত । আমি বললাম ‘চলো তবে আমরাও একটা পাউডারের কৌটা কিনে এনে ঘষি। সে জানালো ঐ নম্বর নাকি একমাত্র মনশ্চক্ষু ছাড়া দেখা সম্ভব না। মনটা খারাপ হয়ে গেল এত বড় এক সুযোগ হাত ছাড়া হওয়ার জন্য। বিষন্ন মনে হাটতে হাটতে মন্দির ছেড়ে সামনে এসে দাড়ালাম ।
তাবিজ বিক্রী হচ্ছে
এই মন্দিরের চারিধার জুড়ে রয়েছে ছোট ছোট দোকান যাতে আছে পুজার উপাচার ছাড়াও বিভিন্ন আকারের তাবিজ কবচ আর গম্ভীর মুখ ওয়ালা ভবিষ্যত বক্তা জ্যোতিষীর দল। এক পাশে সারি সারি দোকানের মাঝ দিয়ে পথ চলে গেছে অদুরের খালে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি বালতি বা গামলায় বিভিন্ন মাছ ছাড়াও ব্যাং, কচ্ছপ প্রভৃতি জলজ প্রানী আর পাখি নিয়ে দোকানীরা বসে আছে ।
কোলা ব্যাং বিক্রী করছে
মনের বাসনা পুরন করার আশায় ভক্তরা টাকা দিয়ে এগুলো কিনে পানিতে ছেড়ে দেয় অথবা আকাশে উড়িয়ে দেয় । কেউ আবার খাবার বিক্রী করছে কবুতর আর খালে মাছদের খাবারের জন্য। আমরা দুজনও বড় এক ঠোঙ্গা পাউরুটি্র টুকরো কিনে মাছদের খাওয়ালাম , সাথে রাশি রাশি কবুতর এসে ভাগ বসালো ।
তারপর মন্দিরের কাছে ফিরে এসে দাড়াতেই দেখি বাদিকের এক পাশে কাঠের ফ্রেমের বোর্ডে ছবিসহ লেখা মায়-নাকের পুরো ইতিহাস। সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে গেলাম সেখানে আর রুদ্ধশ্বাসে পড়লাম সেই ইতিহাস আর আপনাদের জন্য তুলে নিয়ে আসলাম মনের খাতায় ।
এমনি ভাবেই বোর্ডে লেখা মায়-নাকের ইতিহাস
আঠারো শ থেকে উনিশ শ সালের মাঝামাঝি ঘটনার কাল আর স্থান হলো ব্যাংকক । সে সময় ব্যংকক আজকের মত এত অত্যাধুনিক শহর ছিল না। ছিল নদী নালা আর অসংখ্য খালের জাল বিছানো বিস্তীর্ন এক জলাভুমি। বছর বছর বন্যা আর শ্বাপদ সংকুল সেই দেশে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বাস করতো কাঠের কুটিরে যা ছিল ৭/৮ ফুট কাঠের খুটির উপর নির্মিত। সেই সময় অধুনা ব্যংককের প্রানকেন্দ্র প্রাখানং যা ছিল সে সময় শহরের এক প্রান্ত ঘেষা গ্রাম । সেই গ্রামে বাস করতো অপরূপ রুপসী মায়-নাক ও তার স্বামী টিড মাক। তাদের মাঝে ছিল গভীর ভালোবাসা,যেন দুজন দুজন কে চোক্ষে হারায়।
সুখে শান্তিতেই দিন কাটছিলো তাদের । মায়-নাক গর্ভবতী আর কয়েক মাস পরেই তাদের প্রথম সন্তান ভুমিষ্ঠ হবে। মায়-নাক আর টিড মাকের খুশী আর ধরে না। কিন্ত তাদের এই সুখের আকাশে হঠাৎ করেই ঝড় উঠলো, যখন শুনলো রাজ আদেশে টিড মাককে যুদ্ধে যেতে হবে। কি আর করা একদিন সুন্দরী মায়-নাককে রেখে টিড মাক চল্লো সুদুর সীমান্তে শত্রুর মোকাবেলা করতে । যুদ্ধে টিড মাক সাঙ্ঘাতিক রকম আহত হয়ে আশ্রয় নেয় ছাওপ্রায়া নদীর অপর তীরে এক গৃহস্থের বাসায়। কেউ কারো খবর জানতে পারে না।
এরই মাঝে মায়-নাকের প্রসব কালীন ভয়ংকর জটিলতায় বাচ্চা পেটে নিয়েই মারা গেলো মায়-নাক । সেসময়ের কথা বাদই থাকলো, আজকের এই আধুনিক থাই সমাজেও বেশিরভাগ মানুষের ধারনা যদি কোন মহিলা বাচ্চা হতে গিয়ে বা বাচ্চা পেটে নিয়ে মারা যায় তবে সে হয় সবচেয়ে ভয়ংকর অশরিরী এক প্রেতাত্মা। বাচ্চা পেটে মায়-নাক মৃত্যু বরন করায় গ্রামবাসীরা সবাই ভয়ে আতংকিত হয়ে উঠে। বৌদ্ধ ধর্মের নিয়মানুযায়ী যথাযথভাবে তার মৃতদেহ সৎকার না করেই বিশাল জোড়া তেলসুর গাছের নীচে কোন রকমে মাটি চাপা দিয়ে রেখে যায় প্রতিবেশীরা।
কিন্ত স্বামীর প্রতি গভীর ভালোবাসার আকর্ষনে মায়-নাক বৌদ্ধমতে পুনর্জন্ম না নিয়ে পুরনো দেহেই ফিরে আসে এই জগতে। প্রাখানং বাসীরা একদিন দেখলো বিশাল জোড়া তেলসুর গাছের নীচে শুন্যে দুলে দুলে মায়-নাক বাচ্চা কোলে নিয়ে তীক্ষ শীষের শব্দ তুলে ঘুম পাড়ানি গান গাইছে। কোন লোকজন তার বাড়ীর কাছ দিয়েও হাটে না ।
অল্প দিনের মাঝে টিড মাকও সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে এসে দেখে ঘরের ভেতর বাচ্চা কোলে মায়-নাক দাড়িয়ে। টিড মাক দৌড়ে যেয়ে মায়-নাককে জড়িয়ে ধরলো কিন্ত তার সারা শরীর বরফের মত শীতল। টিড মাক বুঝে উঠতে পারে না বিষয়টি। সে খেয়াল করলো গ্রামের বন্ধুরা তাকে এড়িয়ে চলছে, তার বাড়ীতে এসে আগের মত ডাকাডাকি করে না । তাই দেখে টিড মাক তাদের কারন জিজ্ঞেশ করলে দু একজন সব কিছু খুলে বলে। অবিশ্বাসের দোলায় দুলতে দুলতে মাক ঘরে ফিরে আসে।
কিন্ত পর পর দু রাতের ভেতর সেই সব বন্ধুরা যারা তাকে তার স্ত্রীর সম্পর্কে জানিয়েছিল তাদের ঘাড় মটকানো অবস্থায় মৃতদেহ পাওয়া গেলে মাক ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে পরে। মাককে চুপচাপ থাকতে দেখে মায়-নাক তাকে খুশী করার জন্য তার প্রিয় একটি রান্না করতে বসলো। মাক সে সময় ঘরে ছিল না, এই ফাকে নাক সব কিছু গুছিয়ে রান্না করবে তখনই মেঝের ফাক গলিয়ে একটি লেবু অনেক নীচে মাটিতে পরে যায়। ঘরে কেউ নেই এই ভেবে অন্যমনস্ক মায়-নাক মেঝের ফাক গলিয়ে তার হাতটি লম্বা করে ৮ ফুট নীচে থেকে লেবুটি তুলে আনে। ঠিক সে সময়েই ফিরে আসা মাক দরজার আড়াল থেকে এই দৃশ্য দেখে বুঝতে বাকি রইলো না যে তার বন্ধুদের কথাই সত্যি ।
রাতে খেয়ে দেয়ে টিড মাক বল্লো সে টয়লেটে যাবে। কিন্ত বাইরে এসেই সে দৌড়াতে দৌড়াতে এক বুনো ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পরলো। চোখের পলক ফেলতেই মায়-নাক সেখানে হাজির। এই গাছটির বিশেষত্ব হলো এর কাছে কোন ভুত প্রেত আসতে পারে না । তাই বাইরে থেকেই মায়-নাক তাকে বেরিয়ে আসার জন্য অনুনয় বিনয় করতে লাগলো। কিন্ত মাক আর বেরিয়ে আসে না।
অনেকক্ষন পরে একটু ফাক পেয়েই মাক সেখান থেকে সোজা তার বাড়ীর কাছেই মহাভুত মন্দিরে আশ্রয় নেয়। তবে কারো কারো মতে মাক ঘর থেকে বের হয়ে সোজা মহাভুত মন্দিরেই আশ্রয় নিয়েছিল। প্রধান ভিক্ষুর কাছে সব কিছু খুলে বলার সাথে সাথে ভিক্ষু চক খড়ি দিয়ে গোল করে দাগ কেটে তার ভেতরে মাককে নিয়ে বসে মন্ত্র পড়তে লাগলো । পবিত্র স্থান বলে মায়-নাক সেখানে কিছুতেই প্রবেশ করতে পারছিল না। অবশেষে সেই ভিক্ষু কৌশলে মায়-নাকের আত্মাকে বোতলে ঢুকিয়ে পাশেই প্রাখানং খালের গভীরে ছুড়ে মারলো। প্রাখানং এর লোকজনের মনে শ্বস্তি ফিরে আসলো।
কিন্ত এই সুখ গ্রামের বাসিন্দাদের বেশিদিন সহ্য হলো না । কিছু দিন পরেই সেখানে আসা দুজন নতুন জেলের জালে বোতলটা উঠে আসে। তাদের কাছে এই কাহিনী ছিল অজানা। তারা না বুঝেই বোতলের মুখ খুলে দেখতে গেলো আর সাথে সাথে মায়-নাকের আত্মা বের আসলো। । কিছুদিন পর থেকেই খালের দুপাশে বহু মানুষের ঘাড় মটকানো মৃতদেহ পরে থাকতে লাগলো। আতংকিত গ্রামবাসী তার ভয়ে ঘর থেকে বের হয় না।
এ খবর পেয়ে ওয়াট রাকহাং এর প্রধান ভিক্ষু সোমদেত ফ্রা বুদ্ধাচারিয়া প্রাখানং এর মহাভুত মন্দিরে ছুটে আসলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী আধ্যাত্নিক শক্তির অধিকারী। তিনি মায়-নাককে ডেকে পাঠালেন। তার ডাক শুনে মায়-নাক আসলে অনেক কষ্টে সে তার আত্মাকে তারই কপালের হাড়ের মাঝে বন্দী করে ফেলে। এরপর সেই হাড় দিয়ে তাবিজ বানিয়ে সোমদেত আমৃত্যু তার কোমরে বেধে রাখেন। পরবর্তীতে রাজ পরিবারের জিম্মায় তাবিজটি রয়েছে বলে একটি সুত্র থেকে জানা যায়। ভিন্ন মতে সোমদেত মায়-নাককে প্রতিশ্রুতি দেয় যে পরজন্মে সে তার প্রিয়তম স্বামীর সাথে মিলি্ত হতে পারবেন। ভিক্ষুর এই প্রতিশ্রুতি পেয়ে মায়-নাক ইহলোক ছেড়ে পরলোকে যাত্রা করে।
এই হলো অপুর্ব সুন্দরী মায় নাকের প্রেত জীবনের সংক্ষিপ্ত ঘটনা। মনে পড়লো আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে এমন হাত লম্বা করে উপর থেকে জিনিস পেড়ে নিয়ে আসা ভুত প্রেতের গল্প আমরাও ছোট বেলায় অনেক শুনেছি । কিন্ত এভাবে কোন গল্প আমাদের সামগ্রিক সমাজে কোন প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয় না ।
কিছুটা ভীত চেহাড়া নিয়ে আমার গাইড অদুরে দাঁড়িয়ে আছে, কাছে গিয়ে ডাকতেই চমক ভেঙ্গে আমার দিকে তাকালো, হয়তো ভাবছে মানুষ নাকি কোন প্রেত! ঘন্টা দুয়েক সময় কাটিয়ে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসলাম মহাভুত মন্দির চত্বর থেকে ট্যক্সি স্ট্যান্ডের দিকে।
মহাভুত মন্দির প্রাঙ্গনে হিন্দু দেবতার মুর্তি
ব্যাংকক ভ্রমনে গিয়ে আপনাদের কারো হাতে এক বেলা সময় থাকলে দেখে আসতে পারেন। খারাপ লাগবে না বলেই মনে হয়। মায়- নাককে নিয়ে থাইল্যান্ডে প্রচুর সিনেমা ও সিরিয়ালও হয়েছে। তাকে সাধারন মানুষ অত্যন্ত ভয় পায় যেমন এটা লিখতে গিয়ে আমারো ভয় ভয় লাগছে। ছবি আপলোড করতেও অস্বাভাবিক দেরী হচ্ছে । মায়-নাক কি এখানেও এসে পরলো নাকি !!
সব ছবি আমার মোবাইলে তোলা ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে আগস্ট, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৩৫