পপি চাষে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা দই আংখাং আজ নন্দন কানন
থাই মায়ানমার সীমান্ত মেসাই বর্ডার থেকে এবার ভ্যান ছাড়লো সামান্য দুরত্বেই আমাদের চুড়ান্ত গন্তব্য গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের উদ্দেশ্যে । ভেতরে ভেতরে দারুন উত্তেজনা বোধ করছি, তবে মনে হলো আমি একাই নই বাসের বাকীদেরও একই অবস্থা। সবাই নড়ে চড়ে বসছে, কেউবা ক্যামেরার লেন্স এডজাস্ট করে নিচ্ছে তাড়াতাড়ি। পাহাড় আর নদীর মাঝখানে বাধানো পথ। বাস এসে থামলো নদীর পারে্ চত্বরে। কাগজে কলমে এলাকাটির থাই নাম সাম লিয়াম থং খা তবে স্থানীয়রা একে সোপ রুয়াক বলেই উল্লেখ করে।
চত্বরের রেলিং ব্যানার টানিয়ে আমন্ত্রন জানানো হয়েছে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গালে
এখান থেকে বিশাল মেকং নদী পেরিয়ে আমাদের গন্তব্য লাওসের গা ঘেষে জেগে ওঠা এক দ্বীপ নাম ডন সাও। বাস থেকে নেমে উকি দিয়ে দেখলাম সোপ রুয়াক জেটি থেকে পর্যটকদের নিয়ে একের পর এক নৌকা আর স্পীড বোট ছেড়ে যাচ্ছে ডন সাওর উদ্দেশ্যে। ডন সাও যেতে আসতে এক ঘন্টা আর সেখানে অবস্থান আধা ঘন্টা মোট দেড় ঘন্টা সময় বরাদ্দ তা গাড়িতেই আমাদের জানিয়ে দিয়েছিল। সেখানে যারা যেতে ইচ্ছুক তাদের কাছ থেকে মাথাপিছু ৩০০ বাথ নিয়ে গাইড গেলো নৌকার টিকিট কাটতে।এই ফাকে আমরা সবাই একটু এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলাম ছবি তুললাম ।
স্থানীয় মেয়েদের হাতে তৈরী ব্যাগ
ডন সাও দ্বীপটি কাগজে কলমে নোম্যান্স ল্যান্ড হিসেবে উল্লেখ থাকলেও মুলত এটি লাওসের অংশ হিসেবেই বিবেচিত হয়। মুল লাওস ভুখন্ডে যেতে হলে আপনাকে ভিসা নিতে হবে কিন্ত ঐ দ্বীপে পা দিতে হলে আপনাকে ৩০ বাথ ল্যান্ড ট্যাক্স দিতে হবে। কেউ কেউ খাবারের দোকানে ঢু মারলো। কেউবা স্থানীয়দের হাতে তৈরী সুদৃশ্য ব্যাগ আর টুপি কিনে নিল।আমি কিছু ড্রাই ফ্রুটস কিনলাম আর কিনলাম লম্বা ফালি করে কাটা কাঁচা মিঠা আম সাথে লবন মরিচ আলাদা পুটুলি করে দেয়া।
চত্বরের একদিকে বানিজ্যিক নৌকার উপর বসে থাকা সোনালী রঙের বিশাল ব্রোঞ্জের বুদ্ধ মুর্তি
চারিদিকে প্রচুর ট্যুরিষ্ট ঘোরাফেরা করছে । সিমেন্ট বাধানো রেলিং দেয়া নদীর চওড়া পাড়ে ব্রোঞ্জের বুদ্ধ মুর্তি ছাড়াও রয়েছে বৌদ্ধধর্মের বিভিন্ন প্রতীকের মাঝে আছে সিমেন্টে তৈরী বিশাল এক জোড়া হাতির মুর্তি। কাছেই থাকা দান বাক্সে কিছু বাথ ফেলে আপনি সিড়ি বেয়ে ঊঠে হাওদায় বসে ছবি তুলতে পারবেন। সময়ের অভাবে আমি এই এডভেঞ্চার থেকে বঞ্চিত হোলাম ।
সোপ রুয়াকের বাধানো চত্বরে সেই হাতী, সোনালী রাজকীয় প্রতীক এর মাঝখানে ব্রোঞ্জের কালো রঙে তৈরী লান্না রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা মহান রাজা মেঙ্গরাই এর মুর্তি
অদুরেই প্রাচীন নগরী চিয়াং সান, যা একসময় থাইল্যান্ড, লাওস, মায়ানমার আর চীনের কিছু অংশ নিয়ে গড়ে ওঠা বিখ্যাত লান্না সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। তাই এই অঞ্চলে চাইনীজ সংস্কৃতির প্রভাব বেশ লক্ষ্যনীয়। এর মাঝে টিকিট চলে আসলে বাধানো ঢালু পথ বেয়ে আসলাম জেটিতে বাধা আমাদের নৌকার কাছে। এবার আমাদের দায়িত্ব আরেক জনের হাতে , টিকিট চেক করে সে নৌকায় ওঠার সাথে সাথে হাতে ধরিয়ে দিল লাইফ জ্যাকেট যা পরা বাধ্যতামুলক। সেখানকার ঐতিয্যবাহী লম্বা লেজওয়ালা নৌকার মাঝখানে সরু পথ আর দুদিকে দুটো দুটো করে চারটি প্লাস্টিকের সিট।
নৌকার সহযাত্রী ডন সাওর পথে।
সিটে বসে বা দিকে তাকিয়ে দেখি উত্তরে শান পাহাড় থেকে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ তুলে নেমে আসছে রুয়াক নদী যা মায়ানমার আর থাইল্যান্ডের মাঝে সৃষ্টি করেছে প্রাকৃতিক সীমানার। সামান্য পথ এসেই রুয়াক মিলে গেছে বিস্তীর্ন সাথে প্রমত্তা নদী মেকং এর সাথে। তিব্বতের মালভুমি থেকে উৎপন্ন মেকং ছয়টি দেশ পেরিয়ে সাগরে ঝাপ দেয়ার আগে থাইল্যান্ড আর লাওসকে ভাগ করেছে আলাদা দুটো দেশে। আর এখানেই রুয়াক আর মেকং এর মোহনায় এসে মিলেছে তিনটি দেশঃ লাওস, মায়ানমার আর থাইল্যান্ড।
অদুরে এক ঝাক সাদা গাংচিল চিৎকার করে কখনো নদীতে ঝাপিয়ে পড়ছে কখনো বা উড়াল দিচ্ছে আকাশে, আবার ঘুরে এসে আবার বসছে নদীর বুকে আর ঢেউয়ের দোলার সাথে সাথে দুলছে।
তীর দিয়ে তিনটি দেশ চিনহিত করা।
বাঁদিকে চোখ ফেরাতেই নজরে এলো মায়ানমারের ভুখন্ড, ডান দিকে লাওস । ঠিক আধা ঘন্টায় নদী পার হয়ে আসলাম ডন সাও দ্বীপে। সিমেন্ট বাঁধানো নদীর পাড়ে নামতেই উস্কখুস্কো চুল আর মলিন জামা কাপড় পড়া ছিন্নমুল শিশুগুলো খেলা ফেলে দৌড়ে এসে হাত পেতে দাড়ালো। বাচ্চাগুলো আমাদের দেশের মতই, দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল ।
দু ধাপ সিড়ির পরেই ডান দিকে ল্যান্ড ট্যাক্স কাউন্টার
পা ফেলতেই হাজির হোলাম গাছ পালায় ঘেরা এক মাটির চত্বরে। সেখানে বাঁশের ছাপড়া দিয়ে তৈরী কিছু অস্থায়ী দোকান পাট। যার এক দিকে স্থানীয় খাবারের রেস্তোরা অন্যদিকে হাতে তৈরী ব্যাগ, টুপি, কাঠের তৈরী কিছু স্যুভেনীর নিয়ে বসে আছে দরিদ্র লাও মেয়েরা। তবে তাদের পন্যের মান এতই নীচু যারা কিনছে তারা মায়া করে কিনছে বলাই ভালো। এখানে আপনি থাই মুদ্রায় কেনাকাটা করতে পারবেন।এ ছাড়াও ছিল প্রচুর বিদেশী দামী ব্রান্ডের মদ ও সিগারেট, দেখে মনে হলো ক্যাসিনোর জন্য আমদানী করা এসব পন্য অসৎ কর্মচারীরা গোপনে বিক্রী করেছে এদের কাছে।
দরিদ্র লাওদের ঝুপড়ী দোকানে আমাদের ঘুর ঘুর
ক্যাসিনোর কথায় মনে পড়লো জুয়াড়ীদের স্বর্গ বলে পরিচিত বিলাশ বহুল ক্যাসিনো কিংস রোমানের কথা। যার চুড়োর সোনালী রঙের উজ্জ্বল মুকুট সেখানকার মলিন বস্ত্র পরিহিত হত দরিদ্র লাওবাসীদের মাথার উপর দিয়ে তাকালেই অদূরে দেখতে পাবেন। সেই স্বর্নালী মুকুটের ছটা আপনি থাইল্যান্ড অংশ থেকেও দেখা যায়। মাদক মুক্ত এই অঞ্চলটিকে লাওস বর্তমানে কর মুক্ত ইকোনমিক জোন হিসেবে ঘোষনা করেছে। বিদেশী ব্যাবসায়ীদের কাছস ৯৯ বছরের জন্য জমি লীজ দিচ্ছে। ২০০৭ সালে লাওস সরকা্রের অনুমতিতে হং কং বেসড কোম্পানী কিং রোমানস এর তৈরী ক্যাসিনো ছাড়াও এই জনশুন্য নির্বান্ধবপুরে আরও একটি ক্যাসিনো আছে।
ডন সাও দ্বীপে স্বর্ন মুকুট মাথায় হং কং বেসড কোম্পানী কিং রোমানস ক্যাসিনো
চীন আর থাইল্যান্ডে জুয়া খেলা সরকারীভাবে সম্পুর্ন নিষিদ্ধ। তাতে কি আর নেশাগ্রস্ত জুয়াড়ুদের আটকে রাখা যায়! তাই এই দুটি দেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশের পাকা জুয়াড়িরা ঘন্টার পর ঘন্টা এক ঠায় চেয়ারে বসে ক্যাসিনোর বিভিন্ন জুয়ার টেবিলে অকাতরে ঢেলে দিচ্ছে লক্ষ লক্ষ ডলার। এসব জুয়াড়ীদের মনোরঞ্জনের জন্য রয়েছে দামী দামী পানীয়, সুন্দরী লাও, চাইনীজ, মায়ানমার আর থাই রমনীরা। এ ছাড়াও আরো অনেক ধরনের অবৈধ ব্যাবসা এখানে পরিচালিত হয় বলে শোনা যায়।
[img|
ছিন্ন মুল শিশু ও কিছু ফল মুল নিয়ে বসে থাকা গরীব লাও।
দুঃখ হয় যখন জানতে পারি বনজ ও খনিজ সম্পদে পরিপুর্ন অপার সম্ভাবনার একটি বিশাল দেশ লাওসের সাধারন জনগন আজীবন দারিদ্র সীমার অনেক নীচে বসবাস করছে। তাদের ভাগ্যোন্নয়নের ব্যাপারে সীমাহীন দুর্নীতিবাজ লাও সরকার ও তাদের কর্মাচারীদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। তারা শুধু নিজেদের উন্নয়ন নিয়েই ব্যাস্ত। আমার পরিচিত ছাত্রী লাওসের এক সাধারন সরকারী কর্মচারীর সন্তান। ব্যাংককের অত্যন্ত দামী অভিজাত শপিং মলের ব্র্যান্ডেড দোকান থেকে অত্যন্ত অবহেলা ভরে ৬০ হাজার বাথ ( বাংলাদেশী মুদ্রায় আনুমানিক ১লাখ চল্লিশ হাজার টাকা) দিয়ে কিনলো একটি হাত ব্যাগ। যেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত গাধার খাটুনি খেটে ইউনিভার্সিটি পাশ করা একজন থাই গ্র্যাজুয়েটের মাসিক বেতন টেনেটুনে ২৫ হাজার বাথ। এটা হলো একটি মাত্র উদাহরন, লাওসে এমন শত শত উদাহরন আপনি খুজে পাবেন।
শুকনোর দিনেও উপচে পড়া পানি নিয়ে বইছে মেকং
এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে দেখতেই আধাঘন্টা সময় ফুরিয়ে গেল কখন টেরই পেলাম না।সেখানে তেমন কিছুই হয়তো নেই তারপরও গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের অন্তর্ভুক্ত লাওসের এই অংশটিও দেখা হলো । নৌকায় বসে মধ্য ফেব্রুয়ারীর এই শুকনো মৌসুমেও জলভরা মেকং এর উত্তাল ঢেউ পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ডের দিকে আসতে আসতে মনের মধ্যে ভেসে উঠলো শুকনো বালুচর বুকে নিয়ে থাকা পানি শুন্য তিস্তা পদ্মা সহ অসংখ্য নদীর কথা। সহ ব্লগার কলিমুদ্দিন দফাদারের কথা মত তখন আর কিছুতেই সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারছি না। এই মেকং ছয়টি দেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাগরে পরেছে। বাঁধও দিয়েছে অনেকে কিন্ত কেউতো তাকে শুকিয়ে মারেনি ।
অপিয়াম মিউজিয়াম
এরপর অল্প সময়ের জন্য গেলাম কাছেই অপিয়াম মিউজিয়াম দেখতে। যেতে যেতে জানালা দিয়ে যতটুকু দেখছি তাতে পথের দুপাশে দেখা যাচ্ছে কখনো সবুজ কোথাও বা নীল রঙের ঘন বনে মোড়ানো পাহাড় সারি, উর্বর ফুল ফসলের ক্ষেত আর তারই কোলে লুকিয়ে থাকা বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী আদিবাসীদের গ্রাম।কি যে অদ্ভুত সুন্দর এক দৃশ্য যা চোখে না দেখলে ভাষায় কুলিয়ে ওঠা যায় না।
কাঠের ছোটখাট সেই অপিয়াম মিউজিয়ামে খুব একটি দর্শক সমাগম ছিল না বললেই চলে।সেখানে থাকা প্রদর্শক আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালো আর শোনালো শতাব্দীব্যাপী অপিয়ামের ইতিহাস।
থাইল্যান্ডের প্রয়াত রাজা ভুমিবল স্বচক্ষে দেখছেন ভয়ংকর মাদক তৈরীর উপাদান পপির বাগান
দেখালো কিভাবে একে নিয়ে ব্যাবসা থেকে শুরু করে জীবন রক্ষার ঔষধ তৈরীর উপকরন তৈরী হয়। জানা ইতিহাস আবারো জানা হলো কেমন করে চীনে আফিম উৎপাদন ও বিক্রীর ব্যাবসা চালিয়ে যাবার জন্য পৃথিবীর তথাকথিত সভ্যদেশ ইংল্যান্ড উনবিংশ শতাব্দীর মাঝে দু দুবার চীন আক্রমন করে যা ইতিহাসে কুখ্যাত ওপিয়ামের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে জয়ী হয়ে বৃটেন ৯৯ বছরের জন্য হং কং দ্বীপটি লাভ করেছিল যা শেষ বৃটিশ গভর্নর ক্রিস প্যাটেন ১৯৯৭ সালের ১লা জুলাই অশ্রুসিক্ত নয়নে চীনকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল।
তিনশ জাতের পপি থেকে মাত্র Papaver somniferum নামে এই জাতের পপি ফুল থেকে অপিয়াম উৎপাদন হয় ।
মিউজিয়ামের প্রদর্শক দেখালো Papaver somniferum নামের সেই পপি গাছ ।দেখালো মাদক বানানোর পদ্ধতি থেকে শুরু করে মাদক গ্রহনের পদ্ধতি পর্যন্ত। সেই সাথে মাদক গ্রহন একজন মানুষ ও তার পরিবারে কতটুকু সর্বনাশ ডেকে আনে তার বিশদ বর্ননা। অল্প সময় নিয়ে দেখা হলেও অপিয়াম মিউজিয়াম মনে এক গভীর দাগ কেটে গেলো।
মাদকাসক্ত এক ব্যাক্তির জীবনের করুন পরিনতি রেপ্লিকার মাধ্যমে ধরে রেখেছে অপিয়াম মিউজিয়াম
বিকেল হয়ে আসছে এবার আমাদের চিয়াং মাই ফিরে আসার পালা। গাইড জানালো আমাদের পৌছাতে পৌছাতে তিন ঘন্টার ও বেশি সময় লেগে যাবে। সমতল ছাড়িয়ে রাতের আঁধারে শুরু হলো পাহাড়ী পথের পাকদন্ডী ঘুরে ঘুরে ভয়ংকর সেই দ্রুত গতির যাত্রা। সেই সাথে আমিও মনে মনে ইতিহাসের পাতা উলটে পালটে দেখতে বসলাম যথারীতি। প্রথমেই মনে প্রশ্ন আসলো তিনটি দেশের কিছু ভুখন্ড নিয়ে এই ত্রিকোনাকৃতি অঞ্চলটির নাম গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল কে দিয়েছিল ? চলতে চলতে অন্ধকার ভ্যানের ভেতরে বসেই গাইডের কাছ থেকে জেনে নিলাম এই বিজাতীয় নামকরণের অজানা ইতিহাস সহ আরো অনেক কিছুই।
রাজা ও তাঁর প্রকল্পের আন্তরিক প্রচেষ্টায় চিয়াং রাই পাহাড়ের বুকে এক চা বাগানের ছবি
আজ পর্যটকদের পদভারে মুখরিত স্বর্গের নন্দন কাননের মত সবুজ শ্যামল ফল-ফসল আর নানা রঙের ফুলের সৌরভে মাতোয়ারা থাইল্যান্ডের উত্তর সীমান্ত চিয়াং রাই শহরটি এক সময় এমন ছিল না।এখন থেকে পাঁচ দশক আগে মাদক ব্যাবসায়ীদের কালো থাবায় এই বিস্তীর্ন পাহাড়ী এলাকাটি পরিনত হয়েছিল এক আইন কানুনবিহীন নরকে।
দুটি নদীর মোহনায় তিনটি দেশ নিয়ে গড়ে ওঠা গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল
তিনটি দেশের এই মিলনেকেন্দ্রটি ছিল দুর্গম এক পাহাড়ী এলাকায় ঘেরা যা ছিল তিনটি দেশেরই প্রশাসনের নজরদারীর বাইরে। সেই সুযোগ নিয়ে চাইনীজ পিতা আর মায়ানমারের দুধর্ষ জাতি শান মায়ের গর্ভজাত সন্তান হুন সা বা খুন শা সেখানে সারা দুনিয়ার মাদক সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র সম্রাট রূপে আত্নপ্রকাশ করে। প্রথমে হুন শহা মায়ানমারের শান প্রদেশে মাদকের কাঁচামাল পপি ফুলের চাষ ও উৎপাদন শুরু করলেও তা ধীরে ধীরে সীমান্ত ঘেষা তিনটি দেশের ৯৫০,০০০ স্কয়ার কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে দেয়।
মাদক সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হুন শা
ঐ অঞ্চলের দরিদ্র পাহাড়ী জনগনকে মাদকের কাঁচামাল পপি চাষে লাগায় হুন সা । পাহাড়ের পর পাহাড়ের বনে আগুন জালিয়ে সাফ করে পপি চাষ হতো যা থেকে উৎপাদন করা হতো হেরোইনের মত ভয়ংকর মাদক। এক থাইল্যান্ডেই প্রতিবছর ২০০ টন অপিয়াম উৎপাদন হতো ।তার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার ও মাদক ব্যাবসাকে নির্বিঘ্নে করার জন্য আধুনিক অস্ত্রসহ প্রশিক্ষিত এক নিজস্ব বাহীনি গড়ে তোলেন। সেসময় গোটা ত্রিভুজাকৃতির এলাকাটি ছিল যেন মাদকের এক সোনার খনি যা থেকে হুন সা কোটি কোটি ডলার আয় করতো। এ কারনেই মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট এর নাম দিয়েছিল গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল।
পাহাড়ে পাহাড়ে আজ অপিয়ামের বদলে উৎপাদন হচ্ছে ধান
এই মাদকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা ছিল মার্কিন যুক্তরাস্ট্র এ কারনেই আমেরিকা এই মাদক সম্রাটকেগ্রেফতার এবং তার সাম্রাজ্য উচ্ছেদের জন্য ঊঠে পড়ে লেগেছিল।পরবর্তীতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ থাইল্যান্ড, লাওস এবং মায়ানমার জাতিসংঘের সহায়তায় এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়। ফলে ১৯৯৬ সালের জানুয়ারীতে মায়ানমার সেনাবিহীনির হাতে হুন শা ধরা পড়ার সাথে সাথে তার বিশাল সাম্রাজ্যেরও পতন ঘটে। তবে রহস্যময় কারনে তাকে পুর্ব প্রতিশ্রুতি মত মার্কিনীদের হাতে তুলে দেয়নি জান্তা বাহিনী। কারো কারো মতে শান থেকে পালিয়ে আসা হু শান লাখ লাখ ডলারের বিনিময়ে রাজধানী ইয়াঙ্গনে মুক্ত জীবন কাটিয়ে গেছেন ২০০৭ এর ২৬ অক্টোবর আমৃত্যু।
একরাশ স্বপ্ন বুকে নিয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে চেয়ে আছে মাদকের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া উত্তরের পাহাড়ের দিকে রাজা ভুমিবল
মাদক সাম্রাজ্য উচ্ছেদের আগে থেকেই মাদকের করাল গ্রাসে আক্রান্ত উত্তর সীমান্তের প্রজাদের জীবন আমুল বদলে দিতে দেবদুতের মত অসম্ভব রকম দুরদৃষ্টি আর অক্লান্ত সেবার মানসিকতা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন প্রয়াত রাজা ভুমিবল। ১৯৬৯ সালে প্রথমবারের মত তিনি উত্তরের সেই এলাকা ও তার জনগনকে দেখতে যান।
দুর্গম পাহাড়ী পথ বেয়ে মেয়ে শ্রিনিধর্ন ( বা দিকে লাল জামা পরিহিতা )কে নিয়ে চলেছেন রাজা ।
সর্বত্র ছায়া-সংগীনি স্ত্রী রানী সিরিকিটকে নিয়ে কখনো বা মেঝ মেয়ে রাজকন্যা শ্রীনিধর্ন মহাচক্রীকে নিয়ে সম্পুর্ন অবকাঠামোবিহীন সেই দুর্গম পাহাড়ী এলাকায় কখনো গাড়িতে, কখনো কাদা পানিতে হেটে হেটে জনগনের কাছে গিয়ে তাদের নিজ মুখ থেকে শুনেছেন তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা। পথে ঘাটে পরে থাকা মাদক সেবী ও তাদের পরিবারের দুরবস্থা দেখে ব্যাথিত রাজা ভুমিবল তার প্রিয় প্রজাদের এ অবস্থা থেকে কি করে বের করা যায় তা ভেবে বা কথার ফুলঝুরি ছড়িয়েই শেষ করেন নি, তা থেকে উত্তরনের যথাযথ পথও বের করেছেন তিনি।
দুর্গম জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেটে যাচ্ছেন রাজা ভুমিবল তার মেয়েকে নিয়ে
সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৬,৩২৫ ফুট উচুতে চিয়াং রাই এর দই আং খাং ছিল সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দুর্গম এলাকা। সেখানকার পাহাড়ী জনগন মানবেতর জীবনযাপন করছিল। তরুন রাজা ভুমিবল সেই আগুনে পোড়া, বৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাওয়া পাহাড় আর পপি চাষের ফলে ক্ষারযুক্ত সেই অনুর্বর মাটির উর্বরা শক্তি কি করে ফিরিয়ে দেয়া যায় তার জন্য টেকসই এক প্রকল্প নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
হাতে কলমে বুঝিয়ে দিচ্ছেন তাঁর প্রিয় প্রজাদের কি করে তাদের ভাগ্য ফেরাবে
৩০ বিলিয়ন ডলারের ব্যাক্তিগত সম্পদের মালিক রাজা ভুমিবল বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাজা বলে স্বীকৃত। তাঁর এই বিপুল সম্পদ জাতীর সম্পদ বলে বিবেচিত এবং তা ক্রাউন প্রপার্টি ব্যুরোর মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে। এসব সম্পদের সমস্তই থাইল্যান্ডের বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠান ছাড়াও রাজকীয় প্রকল্পের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। দুরবীন দিয়েও আপনি খুজে পাবেন না থাই রাজ পরিবারের এমন কোন সদস্যকে যারা দেশ জুড়ে থাকা বিভিন্ন রাজকীয় প্রকল্পগুলোতে শুধু অর্থকড়ি দিয়ে নয় সশরীরে নিজেরাও নিয়মিত কাজ না করছে। তারা দেশের বা জনগনের কোন টাকা পয়সা চুরি করেছে বলে শুনিনি এই পর্যন্ত।
পাহাড়ের কোল ঘেষে আদিগন্ত সবুজ ধানের ক্ষেত
রাজা ভুমিবল উত্তর থাইল্যান্ডের পাহাড়ী জনগনের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে থাইল্যান্ডের বিখ্যাত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাসেটসার্টের প্রফেসরদের সহায়তায় বের করলেন সেখানকার মাটিতে কি কি অর্থকরী ফসল উৎপাদন করা যায়। গবেষকদের পরামর্শেই রয়েল প্রোজেক্ট প্রথম সেখানে পীচ, পিয়ার্স আর স্ট্রবেরী ফলের বীজ বুনে।
মেয়েকে সাথে নিয়ে নিজ হাতে লোকজনকে দেখিয়ে দিচ্ছেন স্ট্রবেরী ফলের চাষ করার পদ্ধতি।
এখন মাইলের পর মাইল এমন স্ট্রবেরীর বাগান
রাজা ভুমিবলের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত রাজকীয় প্রকল্পের ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে সেখানকার আপামর জনগনকে প্রশিক্ষন ছাড়াও তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় বিভিন্ন ফল ফসলের উন্নত জাতের বীজ এবং চারা। রাজা স্বয়ং হাতে কলমে স্থানীয় লাহু, পালং আর ইউয়ান আদিবাসীদের দেখিয়েছেন পপির বদলে কি করে নিত্য নতুন অর্থকরী ফসল উৎপাদন করা যায়। তিনি কোন রাজকীয় বা সরকারী কর্মচারীর সাহায্যের আশায় বসে থাকেন নি, বা হুকুম দিয়েও সারেন নি তার দায়িত্ব।
রাজা ভুমিবল দরিদ্র অপিয়াম চাষীদের নিজ হাতে তুলে দিচ্ছেন অর্থকরী ফসলের চারা
রাজার উৎসাহ, অনুপ্রেরনা ও প্রশিক্ষনের মাধ্যমে এক সময়ের মাদক চাষী পাহাড়ী জনগোষ্ঠীরা নতুন উদ্যমে শুরু করে অর্থকরী ফসলের চাষাবাদ। রাজকীয় প্রকল্প উত্তর থাইল্যান্ডের পাহাড়ী জনগনকে মোট ৩৮টি অর্থকরী বিষয়ে প্রশিক্ষন দিচ্ছে। পাহাড়ী জনগনের উৎপাদিত এসব ফসলের মাঝে রয়েছে বিশ্ব জুড়ে চাহিদাসম্পন্ন আন্তর্জাতিক মানের স্বাস্থ্য সম্মত বিভিন্ন সুগন্ধী চাল, স্বাদে গন্ধে অতুলনীয় নানা রকম ফল। সালাদের তৈরীর জন্য বিভিন্ন জাতের লেটুস, কেল, টমেটো, বীন, চীনা বাধাকপি ছাড়াও দৃষ্টিনন্দন সব সবজী।
সালাদের উপকরন অপুর্ব দৃষ্টিনিন্দন সবজীর ক্ষেত
রফতানীর উদ্দেশ্যে চাষ করা চোখ ধাধানো সব ফুল আর ফার্ন, পাহাড়ের ঢাল জুড়ে বিশ্বখ্যাত এরাবিকা কফি এবং চা এর সেই বাগান যা আপনাকে অবশ্যই মন্ত্রমুগ্ধ করবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রশিক্ষন দেয়া হয়েছে মাছ চাষের, ফলে জলাশয়গুলোতে বিপুল পরিমান মিঠা পানির দামী মাছ ট্রাউট, স্টার্জন, চিংড়ী সহ তাদের উৎপাদিত ক্যাভিয়ার (মাছের ডিম) থাইল্যান্ডের আন্তর্জাতিক হোটেল ছাড়াও বিশ্ব বাজারে সৃষ্টি করেছে বিপুল চাহিদা। বিদেশ থেকে আমদানী করা উন্নত জাতের গাভী, হাস-মুরগী পেলে দুধ, মাংস,ডিম উৎপাদন করছে যা দেশের জনগনের পুষ্টি চাহিদা মেটাচ্ছে। দিগন্ত জুড়ে ফোটা ফুল লক্ষ লক্ষ ডলারে বিক্রীর সাথে সাথে কৃত্রিম উপায়ে মৌমাছির চাক থেকে আহরন করছে বিপুল পরিমান মধু।
আমার কেনা রোদে শুকানো আম আনারস আর কিউই ফল
অতিরিক্ত ফল ফসল যেন পঁচে নষ্ট হয়ে না যায় সে লক্ষ্যে কোন রকম কেমিকেল ছাড়া সেই ফল কিভাবে রোদে শুকিয়ে প্যাকেটজাত করা যায় সে প্রশিক্ষন দেয়া হয়।ড্রাই ফ্রুটস ছাড়াও এখানে উৎপাদিত পন্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে বিপননে ব্যবস্থা করেছে রয়েল প্রজেক্টস। থাইল্যান্ডের বিখ্যাত ড্রাই ফ্রুটস ব্যাংকক গিয়ে খায়নি বা কিনেনি এমন মানুষ বিরল।
পুনঃ বনায়নের জন্য পরিকল্পনা রত রাজা ভুমিবল
অপিয়াম চাষের জন্য পুড়িয়ে ফেলা ন্যাড়া পাহাড়গুলোতে দেশ বিদেশে বিপুল চাহিদা আছে এ ধরনের উন্নত জাতের কাঠের গাছ লাগানোতে আবার আগের মত সবুজ হয়ে উঠেছে চারিদিক। তবে বনায়নের ব্যাপারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রেখেছেন রাজা ভুমিবলের মা প্রিন্সেস নগরিন্দ্রা ।
সেই দুর্গম পথ বিহীন অঞ্চলে তৈরী হয়েছে রাস্তা, গিয়েছে বিদ্যুৎ।
রাস্তাঘাট, সুপেয় পানি, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা সহ সম্পুর্ন অবকাঠামোর উন্নয়নে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন রাজা ভুমিবল। বর্ষায় প্রচুর বৃষ্টিপাতের পানি ধরে রাখার জন্য তৈরী করেছেন প্রচুর রিজারভয়ার। সেখানকার খরা দেখে তিনি কৃত্রিম বৃষ্টিপাত এর মত অত্যাধুনিক প্রযুক্তির আবিস্কার করেছেন যা আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে পেটেন্ট করা।এই টেকনোলজি ব্যাবহার করতে হলে আপনাকে অনুমতি নিতে হবে।
রাজা ও তার মা প্রিন্সেস নগরিন্দ্রার নিজ হাতে প্রতিষ্ঠিত দই আংখাং রয়েল প্রজেক্টের নাম লেখা সাইনবোর্ড
উত্তরের পাহাড়ী জনগনকে কাঠ খোদাই, কাপড় বোনা, সিরামিক, বাঁশ, দামী কমদামী পাথর খোদাই, রুপা সহ বিভিন্ন ধাতুর তৈরী অসাধারন সব চোখ জুড়ানো হাতে তৈরী পন্য অর্থাৎ কুটির শিল্পের উপর প্রশিক্ষন ও বিপননে রয়েল প্রজেক্টের মাধ্যমে সর্বাত্নক সহযোগিতা করেছেন রানী সিরিকিট।
দিনের পর দিন দরিদ্র পাহাড়ী মেয়েদের প্রশিক্ষনের ফসল দেখছেন রানী সিরিকিত
আকাশপথে থাইল্যান্ডে প্রবেশ করতে হলে সরকারী বিমান সংস্থা থাই এয়ারওয়েজের কেবিন ক্রুরা সেই পাহাড়ী আদিবাসীদের তৈরী বিখ্যাত থাই সিল্কের জাতীয় পোশাক পড়েই সোয়াদিখা বলে আপনাকে অভ্যার্থনা জানায়।এমনকি থাই এয়ার ওয়েজ প্রথম থেকেই আভ্যন্তরীন সহ সমস্ত আন্তর্জাতিক রুটের পরিবেশিত বেশিরভাগ খাবারই একসময়ের এই দরিদ্র অপিয়াম চাষীদের উৎপাদিত ফল আর ফসল।
লাল টুকটুকে স্ট্রবেরী ধরে আছে গাছে গাছে ফলে আছে।
অর্থাৎ শুধু লাগসই নয় রাজা ভুমিবলের নিজস্ব চিন্তার ফসল এই টেকসই প্রকল্প গ্রহন করে হতভাগ্য পাহাড়ীদের জীবন যাত্রা এতটাই বদলে গেছে যা পুরনো ছবির সাথে মিলিয়ে দেখলে অবিশ্বাস্য মনে হবে।পপি ছেড়ে তারা অন্যান্য অর্থকরী ফসল উৎপাদন করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে।অর্থাৎ জীবিকা নির্বাহের জন্য ঐ অঞ্চলের কাউকে যেন ভবিষ্যতে আর অপিয়াম চাষ করতে না হয় তার ব্যাবস্থাই করে রেখে গেছেন প্রয়াত রাজা ভুমিবল।
সুপার শপ থাই গুরমেটে চিয়াং রাই এ উৎপাদিত উন্নত মানের সুগন্ধী চাল
কালো সাইনবোর্ডে লেখা উপরের ছবির চালের গুনাবলী
জনগনের প্রতি রাজা ভুমিবলের এই অতুলনীয় অবদানের জন্য জাতিসঙ্ঘের স্বীকৃতি ছাড়াও আমরা চিয়াং মাই, চিয়াং রাই ছাড়াও যেখানেই গিয়েছি সেখানেই দেখেছি প্রয়াত রাজা ভুমিবলকে দেশবাসী দেবতার আসনে বসিয়ে পুজা করছে। উচ্চ শিক্ষিত অল্প শিক্ষিত প্রায় পুরো থাইবাসীদেরই দৃঢ় বিশ্বাস তাদের রাজা মানুষ নন, উনি দেবতার অংশ।
রাতের আধারে মেয়েকে নিয়ে হেটে চলেছেন, হাতে তার জনগনের উন্নতিকল্পে নিজস্ব পরিকল্পনার মানচিত্র
সেই উত্তরের পাহাড়ের ঢালে ১৯৬৯ সালে দুরদৃষ্টি সম্পন্ন রাজা ভুমিবলের মত দাঁড়িয়ে যদি আপনি একবার চারিদিকে চোখ মেলেন তবে ফল ফসলে ভরে ওঠা সবুজ শ্যামল সেই শস্য ক্ষেত, পাহাড়ের ঢাল জুড়ে অপরূপ নকশায় করা চা বাগান আর রঙ বেরংগের ফুল আর ফলের সেই অপরূপ সৌন্দর্য্য দেখে অনুধাবন করতে পারবেন সেখানকার জনগনের জন্য তাঁর সুদুর প্রসারী চিন্তা ভাবনা আর অবদান শুধু বর্তমানকে ঘিরেই নয়, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যেন তার সুফলভোগ করতে পারে সেই ব্যাবস্থাই তিনি করে গেছেন।
একজন প্রকৃত স্বপ্নদ্রষ্টা
ঐ সময় ব্যাংককে উপস্থিত আমরা টিভিতে দেখছিলাম সমগ্র দেশবাসীর হৃদয়, তাদের পিতা বলে উল্লেখিত রাজা ভুমিবলের মৃত্যুতে থাইরা আক্ষেপ করে কেঁদে কেঁদে বলছিল,“আমাদের রাজা সারাজীবন আমাদের উন্নতির জন্য দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন।একটি দিনও বিশ্রাম নেন নি।আমরাতো তার বদলে তাঁকে কিছুই দেইনি”।
রাজা ভুমিবলের মৃত্যুর পর বাসার পাশেই মলে থাইরা স্বপ্ন দ্রষ্টা রাজার চিত্র তৈরী করছিল ছোট ছোট কাগজের টুকরো দিয়ে । যাতে নম্বর দেয়া ছিল তা মিলিয়ে মিলিয়ে।
বর্তমানে থাই সরকারের কঠোর নজরদারী ছাড়াও সেখানে বিভিন্ন রয়েল প্রজেক্ট যাবার ফলে মাদক উৎপাদকদের নরক রাজ্য গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল এখন পাহাড়ি জনগনের স্বর্গরাজ্যে পরিনত হয়েছে। পথে পথে চেকপোষ্ট বসানো আছে, সেসময় মাদকাসক্তদের রাজকীয় এবং সরকারী সহায়তায় বিভিন্ন রিহ্যাবের মাধ্যমে সুস্থ করে তোলা হলেও বর্তমানে মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স, মাদকসহ ধরা পরলে মৃত্যুদন্ড। তারপর ও শুনলাম কিছু কিছু আদিবাসী লুকিয়ে ফসলের আড়ালে অল্প স্বল্প পপি চাষ করছে যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
দই আংখাং ন্যাশনাল পার্ক
কিন্ত আইটেনারিতে না থাকায় এবং আমাদেরও অজানা থাকায় অন্যান্য ন্যশনাল পার্কে যাওয়া হলেও যাওয়া হয়নি রাজা ভুমিবলের স্বপ্নের রয়েল প্রজেক্ট দই অং খাং জাতীয় উদ্যানে। দেখা হয়নি তার বিরল সৌন্দর্য্য।পপি চাষে সম্পুর্ন ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটি এলাকাকে কি করে এমন দৃষ্টি নন্দন করে গড়ে তোলা যায় তা ভাবতে গেলেও বিস্মিত হই।
বৃদ্ধ বয়সেও গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে দেখতেন তাঁর গড়ে তোলা বিভিন্ন প্রকল্পকে কি করে আরো লাগসই করা যায় ।
নিজ জনগনের জন্য অক্লান্ত চেষ্টা ও তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের অবিশ্বাস্য কাহিনী শুনতে শুনতে কখন তিন ঘন্টা পেরিয়ে গেলো টেরও পাইনি। ড্রাইভার হোটেলের সামনে গাড়ি থামালে শেষ হলো সেই কুখ্যাত মাদক সাম্রাজ্য গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল থেকে স্বর্গপুরীতে পরিনত হওয়া আজকের চিয়াং রাইতে পায়ের চিনহ রেখে আসার স্বপ্নের ভ্রমণ।
গাড়ির দরজা বন্ধ করার আগে শেষ বারের মত হাত নেড়ে বিদায় জানালো গাইড পানিতা আর আমরাও রুমে ফিরে চললাম এক স্মরনীয় ভ্রমনের অভিজ্ঞতা নিয়ে।
গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল ভ্রমনে সাথে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ সবাইকে।
ছবি আমাদের তোলা আর কিছু নেট থেকে নেয়া ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০২২ সকাল ১১:৪৩