তুং তুং এক গুল্লু বিড়াল
সামান্য একটা প্রানীও যে এত মায়া কাড়া হতে পারে, মানুষের মনে এক সুগভীর স্থান করে করে নিতে পারে সেটা জানা বাকি থাকতো যদি না আমার তুং তুং এর সাথে পরিচয় হতো । প্রথম যেদিন আমি তাকে দেখি আমার ছেলের এপার্টমেন্টে বেড়াতে গিয়ে, সে তখন শুয়ে ছিল তিনতালার সিড়ির ধাপে যেটা তার নিজস্ব এলাকা । আমার ছেলে তার গায়ে হাত বুলাতেই আমি বলে উঠলাম 'এটা কি করছো,! জানো রাস্তা ঘাটের বিড়াল থেকে কত অসুখ বিসুখ হয়' ? ও বল্লো "অসুবিধা নেই এটা এই বিল্ডিং এই থাকে, "। বিল্ডিং এ থাকলে রোগ হবেনা এটা কেমন যুক্তি ভাবতে ভাবতে ঘরে ঢুকলাম।
সিড়িতে শুয়ে থাকা তুং তুং
তার কিছু দিন পর ছেলের পাঠানো কয়েকটা ছবিতে দেখি উনি তার ঘরের মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কখনো বা একমনে খেলছে তার জন্য কিনে আনা খেলনা নিয়ে । আর কোনটাতে চোখ বন্ধ করে ঘুম।কখনো গুল্লুটা বারান্দার দেয়ালে ঠেস দিয়ে নিজের গা হাত পা চেটে চেটে পরিস্কার করছে। আমি বললাম, 'এটাকে ঘরে ঢুকিয়েছো ! কার না কার বিড়াল' ?
ঘরে ঢোকার অনুমতি পেয়ে মেঝের উপর খেলছে তার খেলনা ইদুর নিয়ে
পাপোশের উপর তুং তুং
পাপোশের উপর গড়াগড়ি দিয়ে রোদ পোহাচ্ছে
বারান্দার দেয়ালে ঠেস দিয়ে গা হাত পা চাটছে গুল্লুটা
ছেলে বল্লো ভয় নেই, সে নাকি ঐ বিল্ডিং এরই এক প্রাক্তন বাসিন্দার পোষ্য ছিলো । কিন্ত উনি তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় সে এখন ঐ ভবনের সবার বিড়াল । আমাকে বল্লো "বিড়াল বিড়াল করবা না , ওর নাম রেখেছি তুং তুং থাই ভাষায় যার অর্থ হলো মুটু সুটু গুল্লু "।
প্রথম যেদিন খাটে উঠেছে
তার কিছুদিন পরে প্রমোশন পেয়ে তুং তুং ছেলের বিছানায় উঠলো। কম্বল আর তোয়ালে দিয়ে বানানো হলো তার নরম মোলায়েম বিছানা। সেখানকার ভ্যাপসা গরমে কষ্ট হচ্ছে ? চিন্তা নেই , ফ্যান ছেড়ে দেয়া হলো তার সামনে। নিজে গরমে ঘামছে।
ফ্যানের সামনে নিদ্রামগ্ন গুল্লু
ফ্যানের বাতাসে কি আরামের ঘুম
ক্লাশ শেষ করে ফেরার পথে আসতে লাগলো রঙ বেরং এর থালা বাটি ,খেলনা আর বিড়ালের জন্য নির্ধারিত খাবার, রঙ চঙ্গা প্যাকেটের ভেতর মাছের শুটকি যা দেখতে অনেকটা চ্যাপটা লম্বা চিপ্সের মত ।ও বাইরে থেকে ফেরা মাত্র রুমে হাজির হতে তুং তুং এর এক মুহুর্তও সময় লাগতো না। হাওয়ার বেগে সে যেন উড়ে আসতো। তারপর খেয়েদেয়ে টেবিলের পাশে ছেলের পায়ের কাছে বসে থাকা।
খেয়ে দেয়ে টেবিলের পাশে মেঝেতে বসে আছে তুং তুং
ফ্রীজের উপর তার খাবার থাকতো , সেদিকে কাউকে যেতে দেখলেই তার স্বভাব জাত শিকারী চোখটি জ্বলে উঠতো।
তার এত খাওয়া দাওয়ার গল্প শুনে আমি তো তাজ্জব ! 'কি ব্যাপার তোমার নিজের খাবারের ঠিক নেই আর বিড়ালের জন্য এত তরিবত !! তার উপর ওকে বিছানায় উঠিয়েছো ! ঘরের মধ্যে নোংরা করবে যখন তখন বুঝবে '।
আমার কাছে ওর যত ছবি আছে তার মাঝে এটি আমার চোখে সেরা। নিদ্রামগ্ন তুং তুং এর ছবি তুলতে গিয়েছিল । সাথে সাথে টের পেয়ে উঠে বসেছে
"ও আমাকে ভালোবাসে, আমি ওর সাথে কথা বলি, এখানে আশে পাসে কেউতো আমার ভাষা বোঝে না ,ও আমাকে বোঝে", ছেলের এক যুক্তি । চিন্তা করতে না করলো কারন তাকে নিয়মিত ভ্যাকসিন দেয়া হয় আর তার কানে বার কোড পিন লাগানো । ট্রেইন্ড বিড়াল , বাথরুমের প্রয়োজন হলে নাকি দরজা খুলিয়ে বাইরে চলে যায় । কে জানে সত্যি না মিথ্যা ।
ঘুম পাচ্ছে ভীষন
আরামে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে
নাহ, আর পারছি না জেগে থাকতে
এরপর থেকে সে হলো আমার ছেলের প্রিয় মডেল । উঠতে, বসতে, খেতে- শুতে সেই বিড়ালের বিভিন্ন ভংগীমার ছবি পাঠানো শুরু হলো
আমি যদি কোন কারনে ছেলের উপর রাগ হোতাম অমনি সে তার প্রিয় বিড়ালের দুটো ছবি পাঠাতো আমার রাগ ভাংগাতে । আর সেই চালাক চতুর, চোখে মুখে বুদ্ধির ঝিলিক মাখানো প্রানবন্ত বিড়ালের ছবি দেখে আমার রাগও পানি হয়ে যেত। এত স্মার্ট বেড়াল আমি কখনোই দেখি নি।
কম্বলের উপর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন
অন্য রুম থেকে তাকে কেউ ম্যাও ম্যাও করে ডাকলে সে প্রথমেই চোরা চোখে লুকিয়ে আমার ছেলের দিকে তাকাতো। যদি দেখতো আমার ছেলে তাকিয়ে আছে তাহলে না শোনার ভাব করে সে ঘুমিয়ে থাকার ভান করতো । কিন্ত যেই দেখতো সে খেয়াল করছে না (ইচ্ছা করেই ছেলে খেয়াল করতো না ) । অমনি এক লাফে বের হয়ে সে ঐ রুমে গিয়ে হাজির। সেই ঘর থেকে খেয়ে দেয়ে ফিরে এসে এক লাফে খাটের উপর উঠে তার জন্য কম্বল আর তোয়ালে দিয়ে বানানো নরম বিছানায় শুয়েই নাক ডাকিয়ে এক লম্বা ঘুম ।
কান পেতে অন্য ঘরের বাসিন্দার ডাক শুনছে শিকারী বেড়াল তুং তুং
কিছুদিন আগে ক্লাশে যাবে বলে আমার ছেলে তাকে কোলে করে রুম থেকে বের করতে যাবে , অমনি সে তার গলার পাশে ধারালো নখ বসিয়ে এক টান। তুং তুং এর খামচি খেয়ে রক্ত বের হলো । এন্টিসেপ্টিক লাগিয়ে তারপর অপরাধীকে একটা দড়ি দিয়ে হালকা বাড়ি দিয়ে দিয়ে রুম থেকে তাড়ালো । রাত তিনটায় দরজায় টুক টুক আঘাতের শব্দ শুনে দরজা খুলতেই নত মস্তকে অপরাধী ঘরে ঢুকলো ।
আস্তে আস্তে এসে বিছানার কিনারে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা ছেলের পায়ে বার বার মাথা ঘষতে লাগলো । এ যেন তার কৃতকর্মের জন্য গভীর অনুশোচনার এক প্রকাশ ভংগী। তারপর সব সময়ের মতই বার কয়েক মিউ মিউ করে তার আদর প্রকাশ করলো আমার ছেলের দুই হাত চেটে চেটে।
বিছানার এক কোনে তার জন্য তৈরী নরম বিছানায় স্বস্তির ঘুমে
এই হাত দিয়েই তো প্রতিদিন তাকে খাবার দেয়। ছাত্র মানুষ , নিজে না খেয়েও তার জন্য খাবার কিনতে ভুলে না । এ ব্যাপারগুলো তুং তুং যেন পুরোপুরি বুঝতে পারছিলো । সামান্য বিড়ালের এই গভীর অনুশোচনা দেখে আমার ছেলেও আর রাগ করে থাকতে পারলো না। বাটিতে পানি আর খাবার দিল। খেয়েদেয়ে বিছানায় উঠে দীর্ঘ এক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ছেলের পাশে শুয়ে গভীর ঘুমে অচেতন পড়লো সে ।
ঘুমন্ত তুং তুং
ভুড়ি ভাসিয়ে ঘুমে অচেতন তুং তুং
একদিন একটা ছবি পাঠিয়েছিল তাতে দেখলাম ছেলে বিছানায় পা ছড়িয়ে বসে মনযোগের সাথে তার প্রিয় গেম ক্ল্যাশ অভ কিংস খেলছে আর পাশে তুং তুং। আমার ছেলের পা এর উপর তার এক পা তুলে দিয়ে আরামে ঘুমাচ্ছে। সেই ছবি তুলে সাথে সাথে আমাকে সেন্ড । বললাম 'একি তোমার পায়ের উপর পা দিয়ে শুয়ে আছে ! পা সরিয়ে দাও " । বল্লো 'না এখন ধরতে গেলে খামচি দিবে '। যেই খামচির ভয় করতো সেই খামচি খেয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হলো । তাতেও তুং তুং এর প্রতি তার ভালোবাসার কোনো কমতি নেই ।
প্রিয়জন খেলায় ব্যাস্ত , পাশেই ল্যাপটপের কভারের উপর ঘুমিয়ে কাদা তুং তুং
ইউনিভার্সিটিতে যেতে আসতে কষ্ট বলে এ মাসে সেই বাসা ছেড়ে নতুন বাসায় উঠলো । আমার মত আরো দু একজনের একই প্রশ্ন তুং তুং এর কি হবে ? ওকে তো নেয়া যাবে না , কারন সে ঐ ভবনের । সে নিজেও তার পরিচিত গন্ডী ছেড়ে কোথাও যাবে না। তাছাড়া নতুন বাসায় পোষ্য পালা নিষেধ।
মেঝেতে গড়াগড়ি নিত্যদিনের মত
গতকাল ছেলে গিয়েছিল পুরনো বাসার রিসেপসনে চাবি বুঝিয়ে দিতে । ওকে দেখে তুং তুং জেনো উড়ে এসে হাজির হলো । খালি ঘরে খাবারের কিছু ছিলো না । পানি দিল ওর বাটিতে। পানি খেয়ে ঘুরে ফিরে দেখলো ঘর খালি, কিছু নেই। অবুঝ প্রানী হয়েও সে বুঝলো যে এই ঘরের মালিকও তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে একবারে, আর ফিরবে না।
এলোমেলো বিছানায় তার প্রিয় খেলনা নিয়ে নতুন বাসায় শুয়ে শুয়ে আর খেলতে আসবে না তুং তুং ।
মাস কয়েকের জন্য আপন হয়ে ওঠা প্রিয় ঘর আর আর ঘরের মানুষটির দিকে একবারো পেছন ফিরে না তাকিয়ে আস্তে আস্তে বেড়িয়ে গেলো সে । গেলো তার সেই পুরনো জায়গা যা অনেকদিন ধরেই ফাঁকা পরে ছিল সেই সিড়ির ধাপে, এক সুগভীর অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে রইলো । কাছে গিয়ে বার কয়েক তুং তুং বলে ডাক দেয়ার পরেও সে নাকি আর ফিরে তাকায়নি।
ছেলে মনমরা গলায় জানালো থিতু না হয়ে আর কখনো কোন প্রানীকে সে এতটা কাছে টেনে নেবে না ।
তুং তুং আমিও তোমাকে অনেক অনেক মিস করি।
ছবি সব আমার ছেলের মোবাইল ফোনে তোলা ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ১১:২৭