মাধবীলতার ফুল-ঝাড় থেকে উকি দিয়ে আছে
টুকটুকওয়ালাদের ডাকাডাকি, স্থানীয় ফেরীওয়ালাদের সুর করে বেচা বিক্রী সাথে শত শত পর্যটকের ভীড়ে হাপিয়ে উঠেছেন? ভাবছেন কোথায় যাবেন যেখানে এমন শোরগোল নেই, নেই কোন হৈ চৈ এমন কোথাও ! তাহলে চলুন আমার সাথে ক্যাম্বোডিয়া দেশটির সবচেয়ে প্রধান যাদুঘরটি দেখে আসি ।
এদিকে থেকে তোনলে-সাপ নদী । ছোট্ট এক দ্বীপের ঐপাশ থেকে এসেছে বিখ্যাত নদী মেকং। আর দুজনে মিলেমিশে একাকার হয়েছে খানিকটা ডানদিকের এ মোহনায়
কোথায় সেই যাদুঘর ? না না খুব একটা বেশি দূরে নয় এই তো এদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী বিখ্যাত তোনলে সাপ এর তীরে, রাজবাড়িটির উত্তরদিকের পাঁচিলের একেবারে গা লাগোয়া দৃষ্টি নন্দন লাল টুকটুকে স্থাপনাটাই হলো ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ক্যম্বোডিয়া স্থানীয় ভাষায় সালা রচনা।
ইংরাজী আর খেমার ভাষায় লেখা যাদুঘরের সাইনবোর্ডটি
সংস্কৃত আর স্পেনিশ ভাষা থেকে সালা রচনা নামের উৎপত্তি। স্পেনিশ ভাষায় সালা অর্থ প্রধান বা হল রুম আর সংস্কৃত ভাষায় রচনা অর্থ সৃষ্টি। আর খেমারদের ভাষার এক প্রধান অংশ ছিল সংস্কৃত তা আমি আগেও এ সংক্রান্ত বিভিন্ন পোষ্টে উল্লেখ করেছি।
।
প্রধান দরওয়াজা
মিউজিয়ামে ঢোকার প্রধান গেটটি বন্ধ তাই ডান দিক দিয়ে এমন একটি গেট দিয়ে আপনাকে ঢুকতে হবে । টিকিট কেটেছিলাম ৫ ডলার করে দুজন দশ ডলার । তবে স্থানীয়দের জন্য ৫০০ রিল যা প্রায় এক ডলারের আট ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় আট দশ টাকা।
উত্তরের এই গেটটির মতই দেখতে দক্ষিন দিকের বর্তমান প্রবেশপথটি।
নির্জন নিরিবিলি সেই পরিবেশে অন্যান্য পর্যটকদের সাথে নিশব্দে এগিয়ে চলেছি। দুদিকে সবুজ ঘাসের গালিচা বেছানো বাগানের মাঝখান দিয়ে বাঁধানো লাল পাথরের ছোট একটুখানি পথ। সে পথ ধরে এগিয়ে চলেছি মিউজিয়ামের সিড়ির দিকে ।
সিড়ি পথ
গেটের একটু ভেতরেই ডান দিকে একটি অস্থায়ী ছাউনীতে বিক্রী করছে রাতের শো এর টিকিট, অনুষ্ঠিত হবে মুখোশ পড়া বাদর নৃত্য আর স্বর্গের অপ্সরার মন-মুগ্ধকর নাচ। কিছু কিছু পর্যটক তখনি কিনে নিল টিকিট। আমরা দেখবো না তাই টিকিট কেনার দরকার হলো না।
এখান থেকে বিক্রী হচ্ছিল স্থানীয় ঐতিহ্যের নৃত্যানুষ্ঠান দেখার টিকিট।
ক্যম্বোডিয়া যখন ফরাসী শাসনাধীন ছিল তখন ১৯১৭ এর ১৫ ই অগাষ্ট এই যাদুঘরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয় । ১৩ ই এপ্রিল ১৯২০ রাজা সিসোওয়াথের উপস্থিতিতে ফরাসী রেসিডেন্ট এর উদ্ভোদন করেন। প্রাচীন খেমার মন্দিরের আদলে অপুর্ব লাল পাথরের টেরকোটা নির্মানশৈলীতে যাদুঘরটি নির্মিত।
লাল টেরাকোটা পাথরে স্থানীয় নির্মানশৈলীতে নির্মিত যাদুঘর
হাতের বা দিকে তাকাতেই দেখি সামনের বাগানের ভেতর সাজিয়ে রাখা কিছু ভাস্কর্য্য যা এংকরনগরীর শিল্প আর স্থাপত্যকে মনে করিয়ে দেয়।
মুল তোরণ বরাবর সাজিয়ে রাখা হিন্দু দেবতা গনেশ
সামনের প্রাঙ্গনে দন্ডায়মান, চিনতে পারিনি তাকে
হাতীর শুধু সামনের অংশটুকু পাথরের, বাকি অংশ গাছ আর লোহার তাঁর পেঁচিয়ে নির্মিত
আমার না চেনা কোন একজনের ভাস্কর্য্য
পুরো মিউজিয়ামের মানচিত্র এক ঝলক দেখে নিলাম সিড়ি ভেঙ্গে ওঠার আগে
আস্তে আস্তে সিড়ি বেয়ে মিউজিয়ামের প্রধান হল রুমে প্রবেশ করলাম। কোনায় ডেস্কে বসা তরুনীরা ব্রোশিওর এগিয়ে দিল তাই দেখে দেখে শুরু হলো দর্শন পর্ব । খেমার শিল্পের এক বড় সংগ্রহশালা হলো ক্যম্বোডিয়ার নমপেনের এই জাতীয় যাদুঘর । ঝক ঝকে তকতকে আলো বাতাসে পুর্ন টানা লম্বা হলঘরের বেদীর উপর সাজিয়ে রেখেছে নিদর্শনগুলো। নীচে ছোট করে তাদের পরিচয় উল্লেখ রয়েছে।
এংকর নগরীর সবচেয়ে বড় জলাধার এর মাঝে কৃত্রিম দ্বীপের উপর তৈরী মন্দির পশ্চিম মেবন থেকে সংগৃহীত হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর শায়িত ভঙ্গীমার আধভাংগা মুর্তি
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে খেমার রাজত্ব পর্যন্ত দীর্ঘ এই সময়ের বিভিন্ন উপকরনে তৈরী প্রায় ১৪.০০০ শৈল্পিক নিদর্শন এখানে রয়েছে। যদিও এখানকার বেশিরভাগ উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম আপনি দেখতে পাবেন প্রধানত ফরাসী যাদুঘরে। কারন ফ্রান্স ছিল একদা ক্যম্বোডিয়ার দন্ডমুন্ডের হর্তাকর্তা। তাদের নেয়ার পর যা অবশিষ্ট ছিল তাই দিয়েই সাজানো এ যাদুঘর।
হল ঘরে সাজানো বিভিন্ন সময়ের ভাস্কর্য্য
সম্ভবত বিষ্ণুর বাহন গরুড়
তবে স্বৈরাচারী ও নৃশংস পলপটের আমলে ১৯৭৫-৭৯ যাদুঘরটি ভয়ংকর ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । পরিত্যক্ত রাজধানীর সাথে সাথে যাদুঘরটি পরিত্যক্ত হয়। সাধারন লোকজনের জন্য বন্ধ হয়ে যায় এর সামনের দরজা। কিন্ত লুটেরাদের জন্য খুলে যায় পেছনের দরওয়াজা।
প্রাচীন সেই কাঠের দরজার চারকোনা নকশা করা সুদৃশ্য হাতল
অনেক দুস্প্রাপ্য নিদর্শন লুট হয়ে যায়, স্থানীয় চোরাকারবারীর মাধ্যমে বিক্রি হয়ে চলে যায় বিভিন্ন দেশে। আর কিছুবা ভেঙ্গে চুড়ে পরে থাকে, স্যাতস্যাতে আর ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে বাসা হয় বাদুরের, ঢাকা পড়ে সব ধুলো বালু আর মাকড়সার জালে ।
কাঠের দরজায় কাঁরুকাজ
পলপটের সেই দুঃশাসনের অবসানের পর ইউনেস্কোর সহায়তায় যাদুঘরটি আবার তার আসল রূপ ফিরে পায় । আমেরিকাসহ অনেক দেশ এবং ধনী ব্যাক্তিরা চোরাই পথে কেনা এই যাদুঘরের মুল্যবান নিদর্শনগুলো ফিরিয়ে দেয়।এখন এটা সবার জন্য সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা। প্রবেশ ফি ৫$.
চারকোনা যাদুঘরের মাঝখানে গাছ ফুল আর ভাস্কর্য্যশোভিত খোলা প্রাঙ্গন
ছোট সেই বাগানের মাঝখানে খেমার ঐতিহ্যে নির্মিত লাল ক্যানোপির মাঝে প্রাচীন এক খেমার রাজা
খোলামেলা আলো-বাতাসে পরিপুর্ন একতালা যাদুঘরটির মাঝখানে রয়েছে বাগান আর চারিদিকে চারটি বাহু সেই সুপরিসর প্রাঙ্গনটিকে ঘিরে আছে।
চারিদিকে ঘিরে আছে
দুটি বাহুর মিলনে সৃষ্ট কোন।
বিশাল বাহুর চারটি হল রুম যেন একে অপরের হাত ধরে আছে । আর সেই হল রুমগুলোতে সাজানো রয়েছে ৪ থেকে ১৪ শতাব্দী পর্যন্ত বিভিন্ন সময়কালের নিদর্শন । আসুন দেখে নেই কি আছে এর ভেতরে।
পাথরের উপর ছেনী আর হাতুড়ী দিয়ে তৈরী হয়েছিল এই নকশা
আরেকটি পাথরের কারু শিল্পের নমুনা
কোন এক স্থাপত্যের গা থেকে খুলে আনা হিন্দু আর খেমার শিল্পের মিশ্রনে তৈরী এই পাথরের কাঁরুকাজ
শিল্প আর দর্শকের মেলবন্ধন
পাথরের উপর শায়িত বুদ্ধের খোদাই করা নকশা
হাটু গেড়ে বসা কোন রাজাধিরাজের অধীনস্থ কর্মাচারী যুগল । আরো অনেক কিছুর সাথে লুট হয়ে যাওয়া এ ভাস্কর্য্যটি পরে যাদুঘর কর্তৃপক্ষ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
খেমার তথা ক্যম্বোডিয়ার ধর্ম ও ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই নাগ । এ হলো সেই নাগরাজ বাসুকীর ফনা।
কাঠের পালকি তবে দেখলেই মনে হয় সাধারনের ব্যবহারের জন্য তৈরী নয় ।
পাশ থেকে সেই সুবিশাল কাঠের পালকি টি
এমন অদ্ভুত, অপিরিচিত পাখীর ভাস্কর্য্য আমি সিয়েম-রেপের প্রাসাত বায়নেও দেখেছিলাম
কোন সেই পরাক্রমশালী রাজার সিংহাসন আজ যাদুঘরে শোভা পাচ্ছে
যাদুঘরে থাকা সেই ১৪ হাজার শিল্পের কিছু নমুনা ।
ভাবলাম রাজাধিরাজের আদেশে হাতুড়ী আর ছেনি চালিয়ে এত শত ভাস্কর্য্য আর বিশাল বিশাল সেই স্থাপত্যের দেয়াল নকশা করতে গিয়ে কত শ্রমিকেরই জানি হাতে ফোস্কা পড়েছিল , সেই মিহি ধুলো শ্বাসতন্ত্রীতে গিয়ে কতজন না জানি ধুকে ধুকে মরে গিয়েছিল তার কোন ইতিহাস এখানে লেখা নেই । তবে তাদের জন্য একটাই সান্তনা তা হলো যে তারা কোন ছোটখাট কুলী কামীনদের রোগে ভুগে মরেনি, মরেছিল সে সময়ের রাজরোগ, যক্ষায়।
সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখার পর বেরিয়ে আসলাম সেই একই দরওয়াজা দিয়ে । চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলাম সেই গনেশের সেই ভাস্কর্য্যটি যার দুদিকে দুটো কামান নদীর দিকে মুখ করে সাজিয়ে রাখা । কোন লুটেরার হাত থেকে শেষ সম্পত্তিটুকু বাচানোর জন্য কি ?
সামনে দু দিকে দুটো কামান মাঝখানে এক ভাস্কর্য্য
সব ছবি আমাদের ক্যামেরায় তোলা । সাধারনত যে কোন মিউজিয়ামেই ছবি তোলা নিষেধ। ক্যম্বোডিয়ার জাতীয় মিউজিয়ামের একটাই ব্যতিক্রম। তা হলো যেই যেই আর্টিফেক্টের উপর ছবি তোলা নিষেধ শুধু সেটাতে চিন্হ দেয়া আছে ক্যামেরার ছবিতে ক্রস দিয়ে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:১৫