গোলকুন্ডা দুর্গ
শিরোনামটি কি একটু অন্যরকম ? নিশ্চয় ভাবছেন রাখাল ছেলের পাহাড় চুঁড়ো আবার কেমন করে ইতিহাস হলো ! না না একটুও অবাক হবেন না আপনারা। অবশ্য এ নামে বললে খুব কম লোকই তাকে চিনতে পারবে। তবে যদি বলি অন্ধ্র প্রদেশ তথা তেলেঙ্গনা রাজ্যের গোলকুন্ডা দুর্গ তখন অনেকেই বলবে আরে এতো আমার অনেক চেনা,এই নাম তো অনেক শুনেছি ।
জী এই গোলকুন্ডা দুর্গের সাথেই আজ আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো। স্থানীয় তেলেগু ভাষায় গোল্লা অর্থ রাখাল আর কুন্ডা হলো পাহাড়। এই দুইয়ে মিলে সৃষ্টি হলো গোল্লা কুন্ডা বা রাখাল ছেলের পাহাড়।
প্রধান তোরনের কাছ থেকে
ভারতের তেলেঙ্গনা রাজ্যের রাজধানী হায়দ্রাবাদের কেন্দ্র হুসেন সাগর থেকে ১১ কিমি দূরে ইব্রাহীম বাগ। আর সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে অন্ধ্র তথা হায়দ্রাবাদের গর্ব, একদা কুতুবশাহী সুলতানদের গৌরবময় রাজধানী গোলকুন্ডা দুর্গ। যার উপর থেকে আপনি পাখির চোখে দেখে নিতে পারবেন গোটা হায়দ্রাবাদ শহরটিকে।
গোলকুন্ডা দুর্গ থেকে পাখীর চোখে হায়দ্রাবাদ
প্রাথমিক অবস্থায় রাখাল ছেলের পাহাড় (শেফার্ড হিলস) নামে পরিচিত এই গোলকুন্ডা দুর্গের রয়েছে অত্যন্ত চমকপ্রদ এক ইতিহাস। একদিন এক রাখাল বালক মঙ্গলাভরম নামে এক পাহাড় চুড়োর মাটি খুড়ে এক মুর্তি খুজে পায়। আর সে খবর শুনে ১১৪৩ খৃষ্টাব্দে সেসময়ের কাকাতীয় বংশের রাজা পবিত্র জ্ঞ্যানে জায়গাটিকে মাটির দেয়াল দিয়ে ঘিরে দেয়। আবার কারো মতে ৯৪৫ -৭০ খৃষ্টাব্দেই কাকাতীয় বংশের রাজারা পশ্চিম দিক থেকে শত্রুর আক্রমন প্রতিহত করার জন্য গোলকুন্ডা দুর্গটি নির্মান করেছিল। তবে সেটা মাটির তৈরী ছিল। এর দুশ বছর পর বাহমনী সুলতানরা যুদ্ধ জয় করে সন্ধির চুক্তি হিসেবে গোলকুন্ডা দুর্গের দখল লাভ করে ।
অন্দর মহল
১৫১৮ খৃষ্টাব্দে কুলী কুতুব শাহ ক্ষমতাসীন বাহমনী সালতানাত থেকে বেরিয়ে এসে কুতুবশাহী বংশের সুচনা করেন এবং গোলকুন্ডা দুর্গকে তার রাজধানী হিসেবে ঘোষনা করেন । এরপর ৬০ বছর ধরে প্রথম তিন জন কুতুব শাহী সুলতানের হাত ধরে ইতিহাস বদলের সাথে সাথে বদলে দিল গোলকুন্ডা দুর্গের রূপ। মাটির দুর্গটিকে প্রথমেই বদল করা হয় কঠিন শিলা গ্রানাইট পাথরে। শুধু তাই নয়, বিস্তৃতি ঘটে তার আয়তনেও। ১২০ মিটার উচু সেই মঙ্গলাভরম পাহাড় ও তার পাদদেশকে কেন্দ্র করে ৫ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত জায়গা জুড়ে গড়ে তোলা হয় সুরক্ষিত এই দুর্গ নগরী গোলকুন্ডাকে। ১৬ থেকে ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত কুতুবশাহী বংশের সুলতানী শাসনামলের বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই দুর্গের পতন ঘটে মুঘল সম্রাট আওরংজেবের হাতে তাঁর একাধিকবারের চেষ্টায় ১৬৮৭ খৃঃ এ।
বর্তমানে গোলকুন্ডার ভেতরের একটি অংশ
চারিদিকে ঘিরে থাকা পরিখার মাঝে আর একের পর এক মোট তিন তিনটি সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা এই বিশাল গোলকুন্ডা দুর্গটি শুধু দৃষ্টিনন্দনই নয়, শত্রুর আক্রমন ঠেকাতে এর নির্মান শৈলীতেও রয়েছে অত্যন্ত চমকপ্রদ পুরকৌশলের ব্যবহার। উদাহরণ এই গোলাকুন্ডা দুর্গটির উচু খিলান ওয়ালা ফতেহ দরওয়াজা দিয়ে প্রবেশ করেই খিলানের নীচে এক বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে আপনি দু-হাত দিয়ে তালি বাজান , সেটা শোনা যাবে দুর্গের সর্বোচ্চ চুড়ো ১ কিলোমিটার উপরে নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে থাকা কোন ব্যক্তির কানে। অবাক কান্ড এই যে এ তালির আওয়াজ আপনি তোরনের আশে পাশের কোন স্থাপনা থেকে শুনতে পাবেন না ।
তোরনের এখান থেকে আপনাকে হাত তালি দিতে হবে
এর উদ্দেশ্য ছিল দুর্গের ফটকে কোন অনাহুত আগন্তকের আগমনের বার্তা সাথে সাথে উপরে থাকা রাজকীয় ব্যক্তিবর্গের কানে পৌছে দেয়া। অতিথির পরিচয় অনুযায়ী সে ব্যবস্থা নেয়া হতো। এই তালি বাজানোটি পর্যটকদের দারুন ভাবে আকৃষ্ট করে। আমাদের গাইড একবার নীচ থেকে আরেকবার উপরে থেকে তালি বাজিয়ে শুনালো। সত্যি ব্যপারটা বিস্ময়করই বটে।
পাহাড় চুড়োর ঠিক এখান থেকে আপনি শুনতে পাবেন নীচ থেকে আসা তালির আওয়াজ
গোলকুন্ডা দুর্গে প্রবেশের জন্য ছিল আটটি তোরন যার মধ্যে দক্ষিন পুর্ব দিকের তোরনটি্ উচু খিলানওয়ালা এবং সেই সাথে লোহার শলাকা দিয়ে গাঁথা।উদ্দেশ্য যেন কোন শক্তিশালী হাতীও তা ভেঙ্গে প্রবেশ করতে না পারে । এই তোরনটির নাম ফতেহ দরোওয়াজা যার অর্থ বিজয় তোরন। এই বিজয় তোরন দিয়েই আওরংগজেব বিজয়ীর বেশে দুর্গে প্রবেশ করেছিল বলেই কি এই নাম ! অবশ্য এই দুর্গ দখলের জন্য তাকে নয় মাস অপেক্ষা করতে হয়েছিল দুর্গ প্রাচীরের বাইরে । অবশেষে এক বিশ্বাসঘাতকের মাধ্যমে আওরংজেব এই দুর্গ দখল করতে সক্ষম হয়েছিল ।
আওরঙ্গজেবের বিখ্যাত কামান যা দিয়ে জয় করেছিল গোলকুন্ডা
ইতিহাস থেকে জেনেছি পুর্বদিকের বালাহিসার তোরনটি ছিল নাকি কেল্লার প্রধান ফটক। সেই তোরনে রয়েছে এমন সব চিত্র শিল্পের মোটিফ যা কিনা হিন্দু মুসলিম শিল্পের অপুর্ব মেল বন্ধনের নমুনা ।
বর্তমানে নিরাপত্তার কারনে দুর্গের আসল সব গেটই বন্ধ। তার বদলে আপনাকে এই বিজয় তোরণের বাঁ দিক দিয়ে ছোট লোহার একটি গেটের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করতে হবে।
গেট পেরিয়ে বাঁ দিকের এই পথে আপনি যেতে পারেন রানীদের মহল অর্থাৎ অন্দর মহলের দিকে
রানী মহলের নকশা করা একটি দেয়াল
দুর্গের নিঃশ্ছিদ্র নিরাপত্তার জন্য ছিল চারটি ঝুলন্ত সেতু যা প্রয়োজন মত বিছিয়ে দেয়া যেত আবার উঠিয়ে নেয়া যেত । অর্থাৎ উপরে উঠিয়ে দিলে ভারী দরজার মত বন্ধ হয়ে যেত কেল্লায় প্রবেশের সেই চারটি মুখ।
গাইড জানালো পাহাড় চুড়োর বালাহিসার হল থেকে পালিয়ে যাবার জন্য নাকি এক সুড়ংগ পথ রয়েছে যা দুর্গের দেয়ালের বাইরে ১ কিঃমিঃ দূরে কুতুবশাহী সমাধিতে গিয়ে বের হয়েছে। সমাধি ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাবার জন্য হায়দ্রাবাদ শহরের প্রানকেন্দ্র চারমিনার পর্যন্ত আরেকটি সুরঙ্গ পথ রয়েছে ।
কুতুবশাহী বংশের কোন এক সুলতানের সমাধি সৌধ
অন্দর মহলের বিভিন্ন মোটা মোটা গ্রানাইট পাথরের দেয়ালের জায়গায় জায়গায় রয়েছে ফুটো এতে আপনি ফিস ফিস করে কোন কথা বলবেন তা অন্য কোন ফুটোয় কান পেতে রাখা কেউ শুনতে পাবে। গুপ্তচর বৃত্তির অথবা সেখানকার বাসিন্দাদের নিরাপত্তার জন্য এক চুড়ান্ত উদাহরন। গাইড আমাদের শুনিয়ে দেখালো, এত ছোট সেই ছিদ্র যে গাইড না দেখালে কারো দেখারই কথা নয় ।
দেয়ালের গায়ে হাতের ঝুল কালিতে ময়লা হয়ে যাওয়া দেয়ালে ছোট ছিদ্রটি যা কারো নজরে পড়ারই কথা নয় ।
বহি শত্রুর আক্রমন রাজধানী অর্থাৎ দুর্গটি রক্ষার জন্য সেই সুউচ্চ সীমানা প্রাচীরে একটু পর পর একটি চৌকি ঘর ছিল যেখানে সৈনিকরা সব সময় পাহারায় থাকতো। সেই চৌকি ঘরগুলোতে কামান বসানোর বন্দোবস্থ ছিল, যার দু একটি এখনো উদাহরণ হিসেবে আপনার চোখে পড়বে । এমন ভাবেই কুতুবশাহী সুলতানরা তাদের নিরাপত্তার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছিল। এত কিছুর পরও কি শেষ রক্ষা হয়েছিল ? কুতুবশাহী বংশের শেষ সুলতান কি পেরেছিল আওরংজেবের হাত থেকে নিজেকে বা দুর্গকে বাঁচাতে?
দুর্গের ভেতর
না শেষ পর্যন্ত গোলকুন্ডা দুর্গ হার মেনেছিল সম্রাট আওরংগজেবের উপুর্যপুরি আক্রমনে আর সাথে তার ফতেহ রাহবেন কামানের ক্রমাগত গোলার আঘাতে আঘাতে। সেই ভেঙ্গেচুড়ে যাওয়া বিজিত দুর্গটিকে সংস্কার না করে সম্রাট তেমনি ফেলে রেখেছিলেন, হয়তো ভবিষতে আবার তার জন্য হুমকী হয়ে উঠতে পারে সেই আশংকায়।
বালাহিসার হল বা দরবার কক্ষ থেকে কি জানি দেখাচ্ছে আমাকে গাইড
দুর্গের একেবারে উপরে রয়েছে নীচ থেকে পানি সরবরাহের নল ।
এই দুর্গে আরো রয়েছে নীচু থেক উচু পর্যন্ত পানি সরবরাহের জন্য পয়নালী যা সে যুগের প্রযুক্তিতে এক বিস্ময়কর ব্যপারই বটে। প্রবেশ পথের ডান দিকে রয়েছে মাঝখানে সরু পথ যার দুদিকে সৈন্যদের ব্যারাক । তাদের সাথে টক্কর দিয়েই যেন সুলতানদের মুখোমুখি হতে হয় শত্রুদের।
সৈনিকদের ব্যারাক আর মাঝখানে সরু পথ, নাকি বাতাস খেতে দোলনায় দোলা বাতাসী কক্ষ ভুলে গেছি
বিশাল বিস্তৃত এই দুর্গের অভ্যন্তরে রয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বালাহিসার বা সিলাহখানা , সুলতানী নির্মান শৈলীতে নির্মিত বাগান নাগিনা বাগ যা বর্তমানে ধ্বংস প্রায়, আম্বরখানা বা খাদ্য গুদাম, পানির জন্য সিড়ি ওয়ালা কুয়া, বিশাল গ্রানাইট পাথর খোদাই করে তৈরী মন্দির, রামদাসুর কারাগার, প্রশাসনিক দুই সহোদর কর্মকর্তার নামে আখান্না মাদান্না প্রশাসনিক ভবন, দরবার হল, বারাদারি, হাম্মামখানা , রানী মহল , অন্দর মহল, অন্দর মহলের মাঝে ছাদ বাগান , রাজ দরবার ইত্যাদি।
একদা ঝাড়- বাতি আর আলোক সজ্জার জৌলুসে পুর্ন অন্দর মহল
রানীদের মহল ,
একদা ফুলের সুবাসে মৌ মৌ করা গাছ গাছালি আর অপরূপ দৃষ্টিনন্দন ফোয়ারায় গোলাপ পানির শীতল কনা ছেটানো সেই ভগ্ন ছাঁদ বাগানটি সুলতানী স্থাপত্যকলার এক অপরূপ নিদর্শন। যেখানে কিম্বদন্তী দুই সহোদরা প্রেমমতীর অপ্সরা তুল্য নৃত্যে আর কিন্নরী কন্ঠি গায়িকা তারামতীর গানে মাটিতে স্বর্গ নেমে আসতো।
বর্তমানে জল-শুন্য ফোয়ারা আর বৃক্ষহীন ভাঙ্গাচোড়া সেই ছাদ বাগান
ভেঙ্গে পরা ছাদ বাগানের একটি অংশ
সুলতানের প্রিয় গায়িকা তারামতীর নামে মহিলা মসজিদ বা জেনানা মসজিদ
বিখ্যাত ইবরাহীম মসজিদ যা ছিল দুর্গের প্রধান উপাসনালয় ।
জেনানা মহলের ভেতরের রূপ
ঐ যে খুপরী খুপরী ফুটোগুলো দেখা যাচ্ছে সেটার ভেতরেই ছিল অন্দর মহল
সেখানেই অন্দরের বাসিন্দাদের বছরের পর বছর জীবন কেটে যেত । যা দেখেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়।
অন্দর মহলে প্রবেশ পথ যা এখন দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ
দুর্গের ভেতর আরো রয়েছে সৈনিকদের ব্যারাক, খাবার মজুদ রাখার গুদাম, ঘোড়ার আস্তাবল ইত্যাদি অসংখ্য স্থাপনা।
কুতুবশাহী সালতানাতের অত্যন্ত দক্ষ দুই প্রশাসনিক কর্মকর্তা আপন দুই সহোদর মাদানা আর আক্কান্নার অফিস
আম্বরখানা অর্থাৎ খাদ্য গুদাম
এমন কি এই দুর্গের ভেতরে একটি মন্দিরও রয়েছে যার সৃষ্টির ইতিহাসটি অত্যন্ত বৈচিত্রময় বলে শুনলাম। রামদাসু নামে এক হিন্দু ব্যক্তি সুলতান আবুল হাসানের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। তহবিল তছরুফের অভিযোগে তাকে অভিযুক্ত করা হয়। এর সত্যতা নিয়ে অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন । যাই হোক সেই রামদাসু তার দীর্ঘ এবং একক কারাবাস জীবন কাটিয়েছিলেন সেই গোলকুন্ডা দুর্গের এ্ক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে্। সেখানে আলো আসার একটিই পথ ছিল আর তা হলো অনেক উপরে গম্বুজাকৃতি ছাদের ঠিক মাঝখানে ছোট্ট এক ছিদ্র পথ দিয়ে । সেই অন্ধকার বন্দী জীবনে রামদাসু তার কারাগারের দেয়াল খোদাই করেছিল বিভিন্ন হিন্দু দেব দেবীর মুর্তি ।
আলো আসার একমাত্র পথ ছাদের উপরে সামান্য এই গোল করা ছিদ্র।
দেয়ালের গায়ে সেই আলো আঁধারিতে বানানো মুর্তিগুলো গাইড টর্চলাইট জেলে দেখালো আমাদের ।
এই মুর্তিগুলোই সে তৈরী করেছিল
সেই ঘরটি ঘিরেই পরবর্তীতে নির্মিত হয়েছে হিন্দু মন্দির। বিভিন্ন ভক্ত পুজারীদের দেখলাম প্রাসাদের থালা নিয়ে আসতে এখানে ।
সেই বন্দী খানাটি এখন মন্দির
আরেকটি কথা এই যে পৃথিবী বিখ্যাত হীরা যা বৃটেনের রানীর মুকুটে শোভা পাচ্ছে সেই কোহিনুর, ইরানের রাজা রেজা শাহ পাহলভীর মুকুটে শোভা পাওয়া দরিয়া- ই- নুর, এবং জগৎবিখ্যাত হীরা দ্যা হোপ সবই আবিস্কৃত হয়েছিল এই গোলকুন্ডাতেই।
দুর্গের তোরন পেড়িয়ে ঢুকেই একটু সামনেই গেলেই দেখতে পাবেন একটি কামান।আর তার ডান পাশেই রয়েছে শবদেহ গোসলের ঘর । দুর্গের ভেতর বিশিষ্ট কেউ মারা গেলে এখানে তাকে গোসল করিয়ে কাফন পড়ানো হতো ।
শবদেহ গোসলের জন্য ঘর
ফতেহ দরওয়াজা দিয়ে প্রবেশ করে একটু এগুলেই দেখতে পাবেন একটি ওজন মাটিতে অর্ধেক প্রথিত অবস্থায় রয়েছে। গাইড জানালো যে ব্যক্তি এটা তুলতে পারতো শুধু তাকেই সুলতানের সৈন্যবাহিনীতে নিয়োগের সুযোগ দেয়া হতো ।
দেখুন সেই মাটিতে গাঁথা ওজনটি , পারবেন কেউ তুলতে !
আস্তে আস্তে এগিয়ে যেতে থাকুন দেখবেন আওরংজেবের কামানের গোলার আঘাতের সাথে সাথে কালের আঘাতেো ধ্বন্সপ্রাপ্ত বিভিন্ন স্থাপনাসমুহ। কিছু কিছু অবশ্য এখনো টিকে আছে ঝড় ঝাপটা সহ্য করে। তবে সেই ভাঙ্গাচুড়ো দুর্গও ভারতের প্রত্নতাত্মিক বিভাগ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রক্ষনাবেক্ষন করে চলেছে । যেখানকার জিনিস তেমনি অবিকৃত রেখে দিয়েছে। আর আমাদের দেশে আহসান মঞ্জিল আর লালবাগের কেল্লার কথাই ধরুন, তাদের সংস্কারের চোটে আসল রূপই হারিয়ে যাবার জোগাড় ।
পাহাড় চুড়োর একদিকে থাকা গ্রানাইট পাথর এর টুকরো
দুর্গের ভেতরে রয়েছে বিশাল এক অস্ত্রশালা যা কিনা জনসাধারনের প্রবেশ নিষেধ। বাইরে থেকে দেখলেই বোঝা যায় সে সময়কার অস্ত্র শস্ত্রের চেহারা। গ্রীলের বাইরে থেকে দেখতে পেলাম অনেকগুলো কামান, তাদের বিশাল বিশাল গোলা, বন্দুক তীর ইত্যাদি ।
অস্ত্রাগার
এই দুর্গের ভেতর বিভিন্ন সিনেমার শ্যুটিং ও হয়ে থাকে যা আমরা দেখেছিলাম প্রায় আধঘন্টা ধরে। এ তথ্যটি আমি আমার আগের একটি পোষ্টে উল্লেখ করেছি। সেই প্রচন্ড আগুনের হল্কা ঝড়ানো সুর্যকে মাথায় নিয়ে নাচের একটি মুদ্রা তুলতে বার বার ব্যর্থ হওয়া ছোট ছোট জামা কাপড় পরা সেই শিল্পীদের জন্য আমার প্রচন্ড কষ্টই হয়েছিল। তৃষ্ণায় কাতর তাদের দেখছিলাম দৌড়ে এসে পাথরের আড়ালে রাখা পানির বোতলে চুমুক দিতে, যখনই পরিচালক কাট কাট করছিলেন । এরপর আমরা চলে যাই আরো উপরে বালাহিসার হলের আঙ্গিনায়। অনেকক্ষন পর যখন নেমে বের হওয়ার জন্য গেটের কাছে আসি তখনো লাউড স্পিকারে সেই একই গানের কলি ভেসে আসছিল । অর্থাৎ তারা এখনো সেই মুদ্রাটি তুলতে পারে নি ।
স্যুটিং পর্ব
এখানে রাতে নেমে আসে আলো আর শব্দের খেলা, সেই সাথে জগৎ বিখ্যাত অভিনেতা/আবৃত্তিকার অমিতাভ বচ্চনের জলদগম্ভীর ভরাট কন্ঠে মূর্ত হয়ে ওঠে সুলতানী আমলের গৌরবজ্জ্বল অতীত ইতিহাস। যা আপনার মন আর হৃদয়ের তন্ত্রীতে শিহরন জাগিয়ে তুলবে তাতে আমি নিশ্চিত ।
পাহাড় চুড়োয় বালাহিসার বা দরবার কক্ষ, যেখানে বসে সুলতান রা শুনতেন সবার অভাব অভিযোগ
বালা হিসারের ভেতর দিক
বালা হিসার থেকে নীচে আসছি নেমে
প্রথমদিন হায়দ্রাবাদ ডে ট্যুরে গাইডেড ট্যুরে গিয়েছিলাম অনেক পর্যটকদের সাথে । সারাদিন এদিক ওদিক ঘুরে বিকেল হয়ে গিয়েছিল গোলকুন্ডায় আসতে আসতে । এতগুলো মানুষকে তাড়াহুড়ো করে উনি কি দেখালেন বুঝতে পারি নি । তাই পরে আমরা অটো ভাড়া করে নিজেরাই আবার গিয়েছি সেই গোলকুন্ডাকে দেখতে। একজন গাইড ভাড়া করে অনেকক্ষন লাগিয়ে মন ভরে দেখে আর শুনে আসলাম দুর্গের ইতিহাস। গাইডের আবেগমাখানো ভুল আর শুদ্ধে ভরা ইতিহাস তো আর প্রমান ছাড়া লেখা যায়না । সত্যের উপর ভিত্তি করেই লেখা হয় ইতিহাস। তাই এই সংক্ষিপ্ত ইতিহাসটুকু লিখতে গিয়েও আমাকে যাচাই করতে হয়েছে বিভিন্ন প্রামান্য দলিলের সাথে।
পুরো দুর্গ ঘুরে অবশেষে অন্দর মহল হয়ে বের হয়ে এলাম সুদৃশ্য আঙ্গিনায় ।
উল্লেখ্য ঃ
সপ্তাহের সাত দিনই ৯.৩০ থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে দুর্গের ফটক। হায়দ্রাবাদ শহর থেকে সড়ক পথে খুব সহজেই যেতে পারবেন।
প্রবেশ ফি ভারতীয়দের জন্য ১০ রুপি হলেও বিদেশিদের জন্য ১০০ রুপি । আর লাইট এন্ড সাউন্ড শো এর জন্য মাথাপিছু ১৩০ রুপি
সব ছবি আমাদের ক্যামেরায় তোলা ।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:২১