রূপসী বাগান
আদিগন্ত সবুজ পটভুমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন লাল টেরকোটার অজস্র মন্দির আর মঠ এক অপরূপ নান্দনিক সৌন্দর্য্য নিয়ে। মোহাবিষ্ট আপনি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কিন্ত মন ভরছে না। এমন একটি জায়গা কোথায় আর কিই বা তার নাম বলতে পারবেন ? অনেকে হয়তো জানেন আবার অনেকে খোজই রাখে নি তার, যেমনটি আমি। আসুন আমার চোখে একবার দেখে নিন সেই অজানা অচেনাকে ।
বাগান নগরীর একটি অংশ
যাবার আগে থেকেই আমার সহ পর্যটক শুরু্ করেছিলো মায়ানমারে আমাদের ট্যুর পরিচালক রিকের সাথে ১৫ দিন এর পরিকল্পনা। কোথায়, কোথায় যাবো, কতদিন করে থাকবো ইত্যাদি। বহু আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত মোট চারটি শহর বাছাই হলো, এর মধ্যে রাজধানী ইয়াঙ্গন তো ছিলই, এছাড়া এক সময়ের রাজধানী ও ঐতিহাসিক শহর মান্দালে আর মান্দালে প্রদেশেরই একটি সম্পুর্ন পুরাতাত্বিক শহর বাগান আর শান প্রদেশের ইনলে ।
ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ীতে পর্যটক
বাগান নামটা শুনে আমি খানিকটা বিরক্তই হোলাম ।
‘এত পয়সা খরচ করে বাগান দেখার কি হলো! আমরা কি কখনো বাগান দেখিনি ? দেশ বিদেশে বহু বাগান দেখেছি, সুতরাং এটা বাদ দাও’।
জীবনে এই প্রথম আমার অজ্ঞতায় সে অবাক হয়ে বললো ‘তুমি কি ভাবছো এটা ফুল- ফলের বাগান’?
আমি সম্মতি সুচক মাথা হেলাতেই সে জানালো, ‘তোমার ভুল ধারনা, দেখো তুমি এটা কিসের বাগান’। আমার চোখের সামনে মায়ানমার এম্বেসী থেকে আনা ব্রোশিওরটা মেলে ধরলো।আমি ছবি দেখেই চমকে গেলাম, মুগ্ধ হোলাম সেই শহরটির সৌন্দর্য্য আর বিবরনী পড়ে। মায়ানমারে একটা কথা প্রচলিত আছে,
“কেউ যদি মায়ানমার সম্পর্কে পরিপুর্নভাবে জানতে চায় তবে তাকে একবার অবশ্যই বাগান ঘুরে আসতেই হবে”।
বাগানের রূপ
উপরেই বলেছি বাগান বললে আমরা সাধারনত ফুল বা ফলের বাগানকেই বুঝি। কিন্তু মায়ানমারে বাগান শহর একটি প্রাচীনতম ঐতিহাসিক স্থান যাকে লাল ইটে নির্মিত অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দিরের বাগান বললে ভুল হবেনা। একটি শহরের প্রেমে কি করে মানুষ পড়ে তা বাগান না গেলে বোঝা দুস্কর। আর তা জানতেই রওনা হোলাম বাগান শহরের উদ্দেশ্যে।
বাগানের পথে
হোটেল থেকে সকাল আটটায় ট্যুর কোম্পানীর গাড়ী করে হাজির হোলাম মান্দালে বাস স্ট্যান্ডে। ঠিক নয়টায় কালো চক চকে বাধানো পীচ ঢালা রাস্তা দিয়ে আমাদের যাত্রা হলো শুরু। মোটামুটি তিন থেকে চার ঘন্টার পথ। বাসের জানালার দিয়ে চোখ মেলতেই নজরে এলো রাস্তার দুপাশ ঘেষে কাটা ওয়ালা ঝোপ ঝাড় ছাড়াও রয়েছে আম, একেশিয়া, কড়ই আর নিম গাছের সারি। তবে শেষ দুটোকে গাছ বললে ভুল হবে, একে বলা যেতে পারে মহীরুহু। শুধু এই পথেই নয়, সারা মায়ানমার জুড়েই রয়েছে সবুজ পাতায় ছাওয়া বিশাল বিশাল অজস্র নিম আর কড়ই গাছ যা দেখে মনে হয় তারা শতাব্দী প্রাচীন।
এমনি নীম আর কড়ই গাছ সারা দেশ জুড়ে
সেখানেই আমি প্রথম রাস্তার দু ধারে আম গাছে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিটি দেখেছি যা এ বছর থেকে আমাদের দেশেও প্রচলিত হচ্ছে। রাস্তার দুদিকে খোলা প্রান্তর জুড়ে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি প্রিয় তালগাছ। গাইড ট্যান্ডা আগেরদিন জানিয়েছিল এর রস থেকে ওরা টডি নামে একটি মাদক দ্রব্য তৈরী করে থাকে। পথ চলতে চলতে একটা জায়গা ছিল যার দুধারে অজস্র কাঠালী চাঁপার গাছ, পাতা নেই ন্যাড়া সেই গাছে ফুল ধরে আছে ঠিকই।
কনকচাঁপা নাকি কাঁঠাল চাপা কি যেন নাম ?
খালি সেই মসৃণ রাস্তায় বাস চলছে দ্রুত গতিতে, তবে চালকের পুর্ন নিয়ন্ত্রনেই। চারদিকে কেমন যেন একটা মরুময় পরিবেশ, প্রচন্ড গরম, মাটি থেকে যেন ভাপ উঠছে। আমাদের বাসটা ছিল নন এসি। এসি বাসের জন্য অনেকক্ষন অপেক্ষা করতে হতো যা আমরা চাইনি। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে থেকে চোখে মুখে যেন আগুনের হল্কা এসে লাগছিল।আতংকিত হয়ে পড়লাম এই গরমে কি ভাবে ঘুরবো ভেবে। মান্দালে থেকে শুনে এসেছিলাম বাগানের তাপমাত্রা নাকি ৪০/৪২ ডিগ্রী সেঃ সিঃ উঠানামা করছে । চলতে চলতে ঘন্টা দুয়েক পড় পথের মাঝামাঝি এক জায়গায় একটি ছোট্ট দোকানের সামনে আধাঘন্টার বিরতি হলো। আমরা যাত্রীরা কেউ চা খেলাম কেউ বা কোমল পানীয় তবে ড্রাইভার আর হেল্পার ভাত খেলো।
মাঝ রাস্তায় চা এর দোকান
আবার যাত্রা হলো শুরু। নির্ধারিত সময়ের এক ঘন্টা আগেই বাস চালক আমাদের নামিয়ে দিল এক নির্জন নিরিবিলি বাস স্টান্ডে। এটাই নাকি আমাদের নির্ধারিত গন্তব্য। হাক ডাক, চিৎকার -চেঁচামেচি নেই, লোক জন নেই বললেই চলে। যে দু একটা দোকানে ছোট আকৃতির সাইনবোর্ড তাতে বার্মিজ ভাষায় লেখা,আমাদের তা পড়ার সুযোগ নেই ।সেই শুনসান বাস স্টান্ড দেখে আমি্তো রীতিমত ভড়কে গেলাম, সন্দেহ করতে লাগলাম বাসচালক আমাদের ভুল জায়গায় নামিয়ে দিয়ে গেছে ভেবে। মনে পড়লো গাবতলী সায়েদাবাদের কথা।
এমন একটি নীরব সুনসান বাস স্ট্যান্ডের কথা চিন্তা করা যায় কি !
সামনেই এক নীম গাছের নীচে কিছু টেম্পু মত গাড়ী, আর এক দিকে সার বাধা কিছু দোকান । এক জায়গায় দেখলাম দুটো কুকুর শাবক বাঁকাচোরা টিনের প্লেটে ভাত খাচ্ছে। আমাদের জন্য অপেক্ষা করার কথা ট্যুর কোম্পানীর লোক, কিন্ত তেমন কাউকেও দেখছি না ।আমরা বার বার এক দোকানীকে প্রশ্ন করতে লাগলাম যে এটাই কি বাগান শহরের বাস স্ট্যান্ড নিয়ং ও নাকি ? সে জানালো এটাই সেই জায়গা। রিক প্রথম দিনই আমাদের একটা মোবাইল ফোন দিয়েছিল যাতে তার সহ বিভিন্ন শহরের আরো চারজন ট্যুর অপারেটর/গাইডের নাম্বার ছিল।
নিয়ং উ বাস স্ট্যান্ডে কুকুর শাবকদের মধ্যানহ ভোজন
সে কথা ভেবে আমরা অগত্যা সেখানকার ট্যুর অপারেটরকে ফোন করি, সাথে সাথে সে আমাদের আশ্বস্ত করলো এবং বল্লো "তোমরা অপেক্ষা করো আমি এখুনি আসছি" । ঠিক ৫ মিনিটের মধ্যে গাড়ী করে জীন্স আর টপ্স পড়া ভারী মিষ্টি দেখতে এক অত্যাধুনিক তরুনীর আগমন। নাম তার মিজ পে পে। মায়ানমারের অনেক মানুষের নামই এমন জোড়া জোড়া। যেমন ইয়াঙ্গনের গাইড মিজ ওয়াহ ওয়াহ , ইনলের গাইড মিঃ বো বো। মিজ পে পে হাসিমুখে আমাদের সাথে হাত মিলিয়ে পরিচয় দিল এবং ভীষন দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলো এই অনাকাংক্ষিত ঘটনাটির জন্য। জানালো আমরা নাকি নির্ধারিত সময়ের ঘন্টা দেড়েক আগেই এসে গেছি। পে পে র কথা শুনে মনের মাঝে সাথে সাথে তুলনা চলে আসলো।
হোটেল কুমুদ্রা প্রাঙ্গন আসন্ন পর্যটক মৌসুমের জন্য তৈরী হচ্ছে
পে পে তার আধুনিক মডেলের সেই গাড়ীতে তুলে নিয়ে আমাদের ১০ মিনিটের ভেতর পৌছে দিল পুরনো বাগানের একেবারে গা ঘেষে প্রাচীন আর আধুনিক নকশার মিশেলে তৈরী বিখ্যাত রিসোর্ট কুমুদ্রায়। তখন প্রায় দুপুর, ফর্মালিটিজ সেরে বিদায় নেয়ার সময় মিজ পে পে সমস্ত কাগজ পত্র বুঝিয়ে দিয়ে বল্লো ‘কাল সকাল আটটায় তৈরি থেকো, গাইড আসবে তোমাদের বাগান ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য’।
হোটেলের রিসেপশনের প্রবেশ পথের দুপাশে বাগানের ঐতিহ্যবাহী ভাস্কর্য্য
এখানে একটা ব্যাক্তিগত কথা না বললেই নয় ,তাহলো অফ সিজনে যাবার জন্য আমরা অনেকগুলো সুবিধা পেয়েছিলাম। তার মধ্যে প্রধান হলো হোটেলগুলোতে কম ভাড়া।ভালো হোটেল আর রুম পাওয়া। বহু পাহাড় পেরিয়ে উপত্যকার মাঝে গড়ে ওঠা শহর ইনলে থেকে ফেরত আসার আগের দিন মনে হয়েছে ১২/১৩ ঘন্টা পাহাড়ী পথে বাসে জার্নি করা আমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভবই না। শেষমেষ ট্যুর কোম্পানীকে ফোন করে এক দিনের মধ্যে ইনলে থেকে ইয়াঙ্গনে ফেরার আভ্যন্তরীন ফ্লাইটের টিকিট কাটা হলো। যা পর্যটন মৌসুমের সময় কল্পনারও বাইরে। সেদেশে অনেকগুলো কোম্পানী আভ্যন্তরীন ফ্লাইট পরিচালনা করে যার অনেকগুলোই আন্তর্জাতিক মানের। যার একটা হলো এয়ার কে বি জেড যারা একটি আন্তর্জাতিক মানের ব্যাংক কোঃ মালিক।
এয়ার কে বি জেড এর ভেতরে যাত্রীরা ব্যাস্ত তাদের মাল পত্র নিয়ে
যাই হোক অত্যন্ত ক্ষুধার্ত আমরা চট জলদি আমাদের জন্য নির্ধারিত কটেজে লাগেজ রেখে ফিরে আসলাম রিসেপশনের পাশেই কুমুদ্রার খোলা রেস্টুরেন্টে। অনেক সকালে উঠেছি সুতরাং খেয়ে দেয়ে কটেজে এসে একটা লম্বা ঘুম দিতে হবে । এখানে উল্লেখ্য যে সব হোটেলেই কমপ্লিমেন্টারি নাস্তার বন্দোবস্ত ছিল, দুপুরে আর রাতের খাবার কখনো আমাদের টাকায় খেয়েছি আর কখনো বা ট্যুর কোম্পানীর অতিথি হয়েছি। ওখানে একটাই সুবিধা খাবারের দাম খুবই কম অন্যান্য দেশের তুলনায়।বাঙ্গালী ঘরানার বর্মি খাবার অত্যন্ত সুস্বাদু এবং পরিবেশনও অত্যন্ত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। আর যেহেতু কেনা কাটার কিছু নেই তাই অযথা পয়সা খরচেরও কিছু নেই যদি না আপনি দামী মগক খনির রুবি বা নীলা না কিনে থাকেন। এন্টিক আইটেম আনা নিষিদ্ধ।
খোলা আকাশের নীচে রেস্তোরা
মুরগী আর সব্জী দিয়ে প্লেন ভাত অর্ডার করেছিলাম। খেয়ে দেয়ে হেটে হেটে ফিরে আসছি আমাদের জন্য নির্ধারিত কুটিরে। কুটির হলে কি হবে ভেতরের সব বন্দোবস্তই তারকা খচিত হোটেলের মতই। সবুজ লনের ভেতর কংক্রিটের বাধানো পথ ধরে এগুচ্ছি । চারিদকে ছোট বড় গাছে নানা রকম মনহারিনী ফুল ফুটে আছে। কিছু কিছু আবার সুগন্ধী বিলিয়ে চলেছে সেই নিরিবিলি ঘুঘুডাকা দুপুরে। ফিরে আসলাম রুমে, এসি ছেড়ে সোজা বিছানায় আর সাথে সাথেই চোখ দুটো মুদে আসলো গভীর ক্লান্তিতে।
ভীষন প্রিয় এক পরিচিত ফুল, কাঠ গোলাপ
এমন সময় গুরু গুরু মেঘের গর্জনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। প্রচন্ড বাজের শব্দের সাথে যেন আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামলো।এক ঘন্টা ধরে চল্লো সব কিছু ভাসিয়ে নেয়া সেই বৃষ্টির তান্ডব। বৃষ্টি থামার পর বাইরে সবুজ লনে আসতেই শীতল বাতাসে যেন প্রান জুড়িয়ে গেল। কোথাও পানি জমে নেই। তৃষার্ত সেই মাটি যেন ঘন্টাখানেক ধরে অঝোর ধারায় ঝরা প্রবল সেই বৃষ্টির সবটুকু রস শুসে নিয়েছে । রিসেপশনে শুনলাম বাগানের তাপমাত্রা এখন ২১ ডিগ্রী সেঃসিঃ।
বৃষ্টিস্নাত মাঠ
হাটতে হাটতে রিসোর্টের পথ ছেড়ে ঝোপঝাড় মাড়িয়ে চলেছি, হোটেলের সীমানা প্রাচীর বলতে যা বুঝায় তেমন কিছু নেই, সযত্ন চর্চিত ঘাস শেষে এক সারি ইট দেখে বুঝলাম এটাই হোটেলের শেষ সীমানা।
রিসোর্টের সীমানা
সীমানা ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম যেদিকে রয়েছে লাল লাল ইট আর পাথরের তৈরী অপুর্ব নকশার সেই মন্দিরগুলো। পথ কেটে এগিয়ে চলতে গিয়ে বাবলা কাটায় হাত ছড়ে গেল কিন্ত সেদিকে আমার ভ্রুক্ষেপ নেই, আমি এগিয়ে চলেছি আরো সামনে। সেই বৃষ্টিস্নাত বাগানের অপরূপ রুপে আমি মুগ্ধ।
সাঝের আলোয় বাগানের রুপ
সন্ধ্যা হয়ে আসছে চারিদিকে গোধুলীর ছায়া ছায়া অন্ধকার।এখানে প্রকৃতি যেন সেই প্রাচীন যুগেই স্থির হয়ে আছে গাঢ় থেকে হাল্কা সবুজ বনানী আর লাল টেরাকোটার মন্দিরের মাঝে।আমরা দুজন হেটে চলেছি শক্ত লাল মাটির পথ ধরে যে পথ দিয়ে পর্যটকরা ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ী চড়ে বাগানের অলিগলিতে ঢুকে তার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হতে যায়।
আঁধার নেমে এলো বাগানে
আগামীকালের অপেক্ষায় .।।।
চলবে বাগান --- মায়ানমারের এক অসাধারন দৃষ্টিনন্দন পুরাতাত্বিক প্রাচীন নগরীতে দুটো দিন ( শেষ পর্ব)
ছবি সব আমাদের ক্যামেরায় ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৩৪