এর মধ্যেই কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের আম্রকাননে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়ে গিয়েছিল।স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুতেই বাংলাদেশের অবিসম্বাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হয়ে পাকিস্তানের জেলখানায় অন্তরীন। ফলে জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ বাংলাদেশের তৎকালীন অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন । হঠাৎ একদিন শুনলাম জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ চাকুলিয়া আসছেন।
আমাদের পাস আউটের সময় হয়ে এসেছিল। তার পুর্বেই একদিন অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক হেলিকপ্টারে করে আমাদের মাঝে অবতরণ করলেন। আমরা সবাই সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম জানিয়েছিলাম। উনি ছোট একটা মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমাদের উদ্দ্যেশ্যে সংক্ষিপ্ত একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তাঁর সেই অনুপ্রেরণাদায়ক ছোট্ট বক্তৃতা আমাদেরকে সেদিন এমনভাবে উজ্জিবীত করেছিল, মনে হয়েছিল যে আমরা সত্যি পারবো হানাদার মুক্ত করে দেশকে স্বাধীন করতে। তাছাড়াও মনে হয়েছিল আমাদের সত্যিকারের নেতৃত্ব দেয়ার মত কেউ কেউ আছেন।মনে আছে ওনার উপলক্ষে আমাদেরকে সেদিন উন্নত খাবার পরিবেশন করেছিল।
পরদিন আমাদের সবাইকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে প্রত্যেকের হাতে হাত খরচ বাবদ খুব সম্ভবতঃ একশ পঁচিশ ভারতীয় রুপি দেয়া হয়েছিল।এ ঘটনা আমাদের সুকঠিন সেই জীবনযাত্রায় এক আনন্দের জোয়ার বয়ে নিয়ে এসেছিল। সেই টাকা দিয়ে আমরা যখন প্রয়োজনীয় টুকটাক জিনিস কিনেছিলাম সেই আনন্দ উচ্ছাস আজ হয়তো লক্ষ টাকায়ও মিলবে কি না সন্দেহ।
আমাদের ট্রেনিং তখন প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে পৌছেছে। সন্ধ্যার দিকে তাবুতে বসে সবাই মিলে সামনের দিনগুলো নিয়ে আলাপ আলোচনা করছি। আমাদের তাবু থেকে কিছুটা দুরে ভারতীয় এক কর্নেল থাকতেন। হঠাৎ এক প্রশিক্ষক আমাদের তাবুর সামনে এসে আমার নাম ধরে হিন্দীতে জানালেন যে কর্নেল সাহেব আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।এ কথা শুনে সবাই কেমন আড়ষ্ট হয়ে উঠলো। অবশ্য সকলেই বিশেষ করে বন্ধু বাকী আমাকে আশ্বস্ত করলো ‘যাও কোন অসুবিধা হবে না’ এই বলে।
আস্তে আস্তে আমি কর্নেলের তাবুর দিকে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি একটি ইজি চেয়ারে সাদা হাফ প্যান্ট আর সাদা টিশার্ট পড়ে কর্নেল সাহেব বসে আছেন।আমি যথারীতি সোজা হয়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি চোস্ত ইংরাজীতে আমার নাম জিজ্ঞেস করলো, তারপর আমার বাবার নাম।তার হাতে ছিল একটি চিরকুট। উনি তার সাথে আমার পরিচয় মিলিয়ে দেখলেন। অজানা ভয়ে আমারতো অন্তরাত্মা শুকিয়ে গিয়েছিল,না জানি কি অপরাধ আমার।
তারপর মুখ তুলে ইংরাজীতে আরো কি একটা প্রশ্ন করেছিল। যেহেতু তখন ইংরাজীতে আমি তত দক্ষ ছিলামনা তাই বুঝতে না পেরে আমতা আমতা করছিলাম।তখন হঠাৎ করে উনি খাস বাংলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ‘তোমার গ্রামের বাড়ী কই?’
আমি বললাম “বিক্রমপুর”। কর্নেল সাহেব নড়ে চড়ে বসলেন, তারপর জানতে চাইলেন আমার গ্রামের নাম, বাবা কি করেন ইত্যাদি ইত্যাদি। পরে জেনেছিলাম ওনার দেশও বিক্রমপুর। কর্নেলের নামটা কি ছিল আজ আর মনে নেই।
প্রায় দশ পনের মিনিট আলাপের পর মনে হলো হয়তো আর ভয়ের কিছু নেই। তারপর উনি আসল কথাটি জানালেন। মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙ্গে পরলো।যখন হাতের কাগজটি দেখিয়ে বললেন, ‘ উপরের নির্দেশ তোমাকে যত দ্রুত সম্ভব কলকাতার সিএনসি হেড কোয়ার্টারে ফেরত পাঠাতে বলা হয়েছে’। সেই কাগজে কোন কারন দর্শাণও হয়নি।তখন ভদ্রলোক আমারর সম্পুর্ন ঘটনা জানতে চাইলেন।কি ভাবে আমি ভারত এসেছি এবং কোথায় রিক্রুট হয়েছি, সেখানে কিছু ঘটেছিল কি না ইত্যাদি?
আমিও অভয় পেয়ে কোন কিছু গোপন না করে তাকে সব কিছু খুলে বললাম।সব শুনে উনি মন্তব্য করলেন ‘খুব সম্ভবত তোমার রাজনৈতিক দর্শনই এর মূল কারণ। তুমি এক কাজ করো, সেটা হচ্ছে আগামী দু এক দিনের মধ্যেই তো তোমাদের পাস আউট হয়ে যাবে এবং কলকাতায় রিপোর্ট করতে হবে।তোমাকে এখন আর আমি ফেরত পাঠাচ্ছি না, বলবো তথ্য পরে পেয়েছি। কিন্ত পরে তোমার নিজেই নিজেকে বাঁচাতে হবে’।
ওনার সহৃদয় আশ্বাসে দম চেপে রাখা নিঃশ্বাস টুকু ফেলার সুযোগ পেলাম আমি। এদিকে সবাই তাবুতে উদগ্রীব হয়ে বসেছিল ঘটনা জানার জন্য।কি ব্যাপার কেন একাকী তোমাকে ডেকে নিল তাবুতে? সবাইকে খুলে বলি নি শুধু বন্ধু বাকীকে বিস্তারিত জানিয়েছিলাম। বাকী পরামর্শ দিল এই ব্যাপারে কারো সাথে কোন কথা না বলতে।আমিও চুপ করে রইলাম।
পরদিন সন্ধ্যায় পাস আউট হলো এবং আমাদের কলকাতায় নিয়ে আসা হলো।ভাগ্য ভালো যে আসতে আসতে রাত হয়ে যাওয়ায় কলকাতা থেকে বেশ দুরে কল্যানপুর বলে এক জায়গায় একটি স্কুলে রাত্রি যাপন করতে হলো।সকালে বাকী বল্লো ‘তুমি এখানে অপেক্ষা করো, আমি ঘুরে খবর নিয়ে এসে তারপর যা হয় একটা ব্যবস্থা করবো’।
বাকী কলকাতা গিয়ে হেড কোয়ার্টারে রিপোর্ট করলো। ওখান থেকেই তারা আমরা যারা ঢাকা আসবো সেই বন্দোবস্ত করে দিল আর বাকি যারা ছিল তাদের কলকাতার লাগোয়া সেক্টরে অন্তর্ভুক্ত করা হলো। আমাদের সকলকে আগরতলা রওনা হবার জন্য বলা হলো এবং সেক্টর ২ এর মেলাঘর ক্যম্পে রিপোর্ট করার জন্য আদেশ দেয়া হলো।
আমরা সেই নির্দেশ অনুযায়ী প্রায় সবাই হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলাম।আমার ব্যাপারটা নিয়ে আর কোন কথা হলোনা। বাকী অবশ্য এ ব্যাপারে অনেক সাহায্য করেছিল।
কলকাতা থেকে আগরতলা যে এত দূর পথ আমার ধারণার বাইরে ছিল।দুই দিন দুই রাত্রি চলার পর এক জায়গায় ট্রেন পালটিয়ে আরো একদিন এক রাত চলার পর আগরতলা থেকে ৬০/৭০ কিমি দূরে আমাদের নামানো হলো।সারা রাস্তায় খাবার জুটেছিল আম আর মুড়ি।
স্টেশনে নেমে এবার উঠলাম এক খোলা ট্রাকে। পাহাড়ী সেই ভয়ংকর রাস্তার কথা মনে হলে আজও গা শিউড়ে উঠে। কখনো মেঘের ভেতর দিয়ে চলতে গিয়ে ভিজে উঠেছি আবার সমতলে নেমে আসায় ভেজা কাপড় গায়েই শুকিয়েছি। এভাবে সারারাত সেই চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সকাল নয়টার দিকে আগরতলা পৌছালাম।
ক্ষুধা আর পিপাসায় কাতর আমরা অনেক খুজে খুজে অবশেষে ছোট এক হোটেলের সন্ধান পেলাম।মনে আছে পরোটা আর খাসীর মাংসের অর্ডার দেয়া হয়েছিল।সকলেই প্রায় গোগ্রাসে খেতে শুরু করলাম। অর্ধেক খাবার পর কে যেন জিজ্ঞেস করলো কিসের মাংস? বেয়ারা জানালো এটা জলখাসী অর্থাৎ কচ্ছপের মাংস। অনেকে না খেয়েই উঠে পরলো। কিন্ত আমি বাকী আর কয়েকজন পুরো খাবার শেষ করেই উঠলাম।
খাবার পর আমরা সবাই এসে মেলাঘরে রিপোর্ট করেছিলাম।বাংলাদেশী ক্যাপ্টেন হায়দার তখন সেক্টর দুই এর সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন তবে মূল দায়িত্বে ছিলেন তখনকার মেজর খালেদ মোশাররফ।
সেখানে আমাদের তিনদিনের মত থাকতে হয়েছিল। তাবুতে থাকতাম।সকালে একটা পুরি আর এক মগ চা ছিল নাস্তা। দুপুরে ভাত- ডাল কখনো বা সব্জী, রাতে ভাতের সাথে ডালের মত করে রান্না করা হল্যান্ড থেকে আগত টিনিজাত শুটকি।সেই শুটকি ডালের না ছিল কোন গন্ধ, না কোন স্বাদ শুধু গিলে গিলে পেট ভরাতাম।
এসব নিয়ে তখন অবশ্য ভাবার আমাদের সময়ও ছিল না।কল্পনায় শুধু ভাসতো কবে দেখবো আমার দেশকে স্বাধীন। কবে আমার দুখিনী মা শৃংখলমুক্ত হবে।
যাই হোক এবার আমাদের সকলকে কয়েকটি দলে ভাগ করা হলো এবং প্রত্যেক দলে একজনকে নেতৃত্ব দেয়া হলো।আমাদের দলের নেতৃত্ব দেয়া হলো অসীম সাহসী বাকীকে। আর বাকীকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তার সেকেন্ড ইন কমান্ড নিযুক্ত করার।আমাদের গ্রুপে প্রায় উনিশ জন ভারত থেকে প্রশিক্ষন প্রাপ্ত মুক্তি যোদ্ধা ছিল।
আমাদেরকে বলা হয়েছিল স্থানীয়ভাবে আরো ছেলেদের রিক্রুট করার জন্য। আমাদের ইউনিটের জন্য অস্ত্র এবং গোলা বারুদ বরাদ্দ দেয়া হলো।আমরা পেয়েছিলাম তিনটি এল এম জি। সাতটা এস এল আর, সাতটা থ্রি নট থ্রি,প্রায় পনেরোটার মত সাব মেশিনগান এবং বেশ কিছু হ্যান্ড গ্রেনেড, এন্টি পার্সোনেল মাইন, ট্যাংক মাইন, বিস্ফোরক, গোলা বারুদসহ আরো অনেক কিছু যা কি না ঐ সমস্ত অস্ত্র শস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল।
আমাদের কে এবার মেলাঘর থেকে নিমতলী ক্যাম্পে রিপোর্ট করার জন্য বলা হলো।যা কি না বর্ডারের নিকটবর্তী একটি ক্যাম্প। এখানকার প্রধান ছিলেন ক্যপ্টেন আইনউদ্দিন।সেখানে এক রাত কাটিয়ে আমরা পরদিন রাতে সেখানে অবস্থানরত কিছু বাঙ্গালী এবং ভারতীয় নন কমিশন অফিসারের নেতৃত্বে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করি।রাত দুটো পর্যন্ত বাংলাদেশ সীমান্তের ৫ কিমি ভেতরে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন সেই পোষ্টে আমরা অবস্থান নেই।
আমরা যেখানে অবস্থান নেই তার তিনটি দিক ঘিরে পাক-বাহীনি অবস্থান নিয়েছিল। যদিও তারা কিছুটা দুরেই ছিল তারপরো আমরা তাদের ৫ইঞ্চি মর্টার শেলের রেঞ্জের মধ্যেই ছিলাম। কিন্ত সেটা টের পেয়েছিলাম কিছুক্ষন পর। ওদেরকে উত্যক্ত করার জন্য আমাদের এক নন কমিশনড অফিসার উদ্দেশ্যহীন ভাবেই এল এম জি চার্জ করলো তারপর দুই তিন মিনিট বিরতির পর ৩ইঞ্চি মর্টার শেল ছুড়ে মারলো।আমাদেরকে বললো ট্রেঞ্চের মধ্যে বসে পরার জন্য ।
ট্রেঞ্চে ঢুকতে না ঢুকতেই আধা কিঃমিঃ দুরত্বে পাক বাহিনীর মর্টার শেল এসে পরতে লাগলো।চুপচাপ বসে আছি, মিনিট দশেক পরে যখন উঠতে যাবো তখন ভারতীয় প্রশিক্ষক ইশারায় নিষেধ করলেন ট্রেঞ্চ থেকে উঠতে এবং আবারো শেলিং হবে বলে জানালো। তার কথাই সত্যি হলো ঠিক আধা ঘন্টা পরে আবারো পাক বাহিনীর ছুড়ে দেয়া শেল আমাদের সামনে এসে পরতে লাগলো অবিরত ।
এদিকে ট্রেঞ্চের মাঝে থাকাটা যে কি কষ্টকর ছিল।আমরা সবাই খালি পায়ে ছিলাম ফলে মশা আর কীট পতঙ্গের আক্রমনে অতিষ্ট হয়ে উঠি।ট্রেনিং এর সময় আমাদের বলে দেয়া হয়েছিল এই আক্রমন ঠেকাতে আমরা যেন শরীরে কেরোসিন তেল মেখে নেই । তখন কোথায় কেরোসিন ? কোথায় কি? আমাদের মনে তখন বর্ডার অতিক্রমের চিন্তা।
কখন বাংলাদেশে প্রবেশ করে শত্রু নিধনে আমরা মুক্তি পাগল তরুন যুবকরা গেরিলা কার্যক্রম শুরু করবো সেই ভাবনায় মন আচ্ছন্ন। যাই হোক সেই দিন রাত সোয়া তিনটায় আমরা সবাই নিমতলী ক্যম্পে ফিরে এসেছিলাম। আমাদের বলা হলো কাল অন্য একটি জায়গা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করা হবে এবং সেখানে আক্রমন হবে অন্যরকম যা আগামীকাল বুঝিয়ে দেয়া হবে।
তখন বর্ষাকাল আর এমনিতেও ঐদিকে তুলনামুলকভাবে বৃষ্টিপাত বেশিই হয়। তাবুর ভেতরেও কাপড় চোপড় বিছানাপত্র সবই কেমন স্যতস্যতে হয়ে আছে।ক্লান্ত শরীর সেদিকে নজর দেয়ার অবকাশ দেয়নি । কোনরকমে বিছানায় শরীরটা লুটিয়ে দেয়ার সাথে সাথেই গভীর ঘুম । আগামীকাল কি ঘটবে তা ভাবারও কারো অবকাশ নেই।
চলবে...
ছবিঃ নেট
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সেক্টর ২ রনাঙ্গনে সক্রিয় অংশগ্রহনকারী এক বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বহস্তে লেখা দিনলিপি। (চতুর্থ পর্ব)
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৮:০২