সেই যে সে এক সোনার দেশ যে দেশে চোখটি মেলতেই দেখা যায় অপরূপ সব কারুকাজ করা অগনিত বৌদ্ধ মন্দির। আর তার গম্বুজগুলো কিনা সব স্বর্নালী রঙ এ মুড়িয়ে রাখা হয়েছে যেন সব সোনার তৈরী। সেদেশে বাতাসে পাতার মর্মর আওয়াজ তুলে দোল খেয়ে ওঠে সার বাঁধা হাজারো নারকেল গাছ। অপুর্ব সুন্দর এই দেশটির নামটি হলো মায়ানমার যাকে বার্মা নামেই একসময় সব্বাই চিনতো ।
সেই বার্মায় যে এত্ত এত্ত নারকেলের গাছ তাকে কিন্ত সেদেশের মানুষ বলে ‘গন-বিন’ গাছ। বর্মী ভাষায় এর অর্থ হলো লোক ঠকানোর গাছ। কেন, কেন? এত্ত সুমিষ্ট যার পানি আর তেষ্টা পেলে সব মানুষের প্রিয় সেই ফলের গাছটির কেন এমন অদ্ভুত নাম হলো!
তাহলে জানা যাক এমন অদ্ভুত নামকরণের কারন মায়ানমারেরই এক উপকথা থেকে।
অগনিত বৌদ্ধ মন্দির
সে অনেক অনেক বছর আগের কথা,আমরা কেউই তখন জন্মাই নি। ধরা যাক প্রায় এক শতাব্দী আগের কথা, তখন বার্মার লোকজন নারকেল গাছ কি তা চিনতোই না। সারা দেশ জুড়ে আঁতিপাতি করে খুজলেও নারকেল গাছ্ তো দুরের কথা একটি পাতা্রও দেখা পেতো না কেউ। পাবে কেমন করে ! থাকলেতো তো দেখবে!
সেই সময় একদিন এক ভেলায় চড়ে সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে দুজন পুরষ আর একজন মহিলা বার্মার উপকূলে এসে পৌছালো। ভিনদেশী সেই তিনজনা তীরে পা ফেলা মাত্রই কোটাল তাদের ধরে নিয়ে এক্কেবারে রাজার সামনে হাজির করলো।বেশ খানিক্ষন প্রশ্ন ট্রশ্ন করে রাজা বুঝতে পারলো তারা তিনজনই অপরাধী আর এ কারনেই দেশ থেকে তাদের তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
এই তিনজনের এক জন ছিল চোর, সে অন্য লোকের জিনিসপত্র চুরি করতো, অর্থাৎ তার পেশা ছিল চুরি করা। দ্বিতীয়জনা ছিল এক ডাইনী বুড়ী। সে বুড়ী মানুষের উপর নানা রকম যাদু টোনা করতো আর যাদু করে তাদের সাপ ব্যাং বানিয়ে দেবে বলে ভয় দেখাতো। আর সবশেষে যে ছিল সে ছিল একজন মিথ্যেবাদী। শুধু শুধু মিথ্যা কথা বলে আর বানানো গল্প বলে সবাইকে প্রতারিত করাই ছিল তার একমাত্র কাজ।
রাজা মনযোগ দিয়ে এই তিন বন্দীর জীবন কাহিনী শুনলো, তারপর মন্ত্রীকে আদেশ দিলেন,
‘শোনো, এই যে চোরকে দেখছো এখনি তাকে এক হাজার রৌপ্য মুদ্রা দিয়ে এদেশে বসবাস করার ব্যাবস্থা করে দাও। আর যাদুকর ডাইনী বুড়ির জন্যও রইলো একই ব্যবস্থা। তবে ঐ প্রতারককে এখনি নিয়ে তার কল্লা কেটে ফেলো’।
রাজার আদেশ শুনে রাজ্যের উজির-নাজির, মন্ত্রী-যন্ত্রী যারাই সভায় উপস্থিত ছিল তারা তো হতবাক। কি ব্যাপার দুজন অপরাধীকে পুরস্কৃত করা হলো আর বেচারা প্রতারকের মৃত্যুদন্ড! কিন্ত সবাই চুপটি করে রইলো কারণ রাজার উপর কথা বলবে এমন সাহস কার আছে বলো ?
রাজা বুঝলো তাদের মনের কথা, সবাইকে বল্লো, ‘শোনো চোর হলো এক গরীব মানুষ, দুই বেলা খাওয়া জুটে না বেচারার। তাইতো সে চুরি করে। আমরা যদি তাকে সাহায্য করি তাহলে সে আর চুরি করবে না, ভালো হয়ে যাবে। এই যে দেখছো ডাইনী, সেও গরীব, দুঃখী আর এই জন্যই সে ধনী লোকদের হিংসা করে আর তাদের উপর নানা রকম যাদুটোনা করে।তাকে যদি সাহায্য করি সেও চোরের মতন একজন ভালো মানুষ হবে’।
রাজা এবার তৃতীয় ব্যক্তির দিকে আঙ্গুল তুলে বল্লো।‘একে দেখো এ হলো একজন প্রতারক, আর একজন প্রতারক, সবসময়ই প্রতারক’। সবাই রাজার জ্ঞ্যান বুদ্ধি আর ব্যখ্যায় সন্তষ্ট হলো এবং তখনই সেই প্রতারককে সাগর পাড়ে নিয়ে গিয়ে গর্দান কেটে ফেলা হলো।
পরদিন রাজার এক মন্ত্রী সেই বধ্যভূমির পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছিল। সেই বিরান ভুমিতে হঠাৎ এক অদ্ভুত শব্দ শুনে ফিরে তাকালো মন্ত্রী। দেখলো সেই প্রতারক মুখ হা করে তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলছে “ওহে মন্ত্রী তোমার রাজাকে গিয়ে বলো এখানে আমার কাছে এসে মাথা নত করতে, নইলে আমি তার গলা কেটে দু টুকরো করে ফেলবো”।
এই আশ্চর্য্য ঘটনা দেখে ভয়ে মন্ত্রীর অবস্থা তখন শোচনীয় সে কোনরকমে দৌড়াতে দৌড়াতে এসে দরবারে হাজির হলো। মন্ত্রীর সেই আতংকিত চেহারা দেখে রাজা তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করলো,
‘কি ব্যপার মন্ত্রী কি হলো তোমার’? মন্ত্রী কাঁপতে কাঁপতে সিংহাসনে বসা রাজার পায়ের কাছে বসে সেই অত্যাশ্চার্য্য ঘটনা খুলে বল্লো। রাজা একথা শুনে বিশ্বাসতো দূরে থাক উলটো হো হো করে হেসে উঠলো। রাজা যখন হাসলো তখন সভার বাকীরা কি না হেসে থাকতে পারে বলো ? রাজা আর সভাসদরা যখন মন্ত্রীকে নিয়ে হাসি ঠাট্টায় মত্ত তখন মন্ত্রী একটু ক্ষুন্ন হয়ে নত মস্তকে বলে উঠলো, ‘মহারাজ আপনি যদি আমার কথা নাই বিশ্বাস করেন তবে কাউকে আমার সাথে পাঠান, তাহলেই সত্যি মিথ্যা যাচাই হয়ে যাবে’।
রাজা তার আবেদন শুনে আরেকজন মন্ত্রীকে তার সাথে যেতে আদেশ দিলেন। যখন তারা দুজন বধ্যভুমিতে হাজির হলো দেখলো সেই প্রতারকের মাথাটি নির্জীব অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে আছে, কোন সাড়া শব্দই নেই। দ্বিতীয় মন্ত্রী যখন এসে রাজাকে এই ঘটানাটি খুলে বল্লো রাজা সাঙ্ঘাতিক রেগে উঠলো, কারণ আগেই বলেছি রাজা মিথ্যাবাদীদের একদমই সহ্য করতে পারতেন না।
“জল্লাদ কোথায় তুমি ?এক্ষুনি একে সেই প্রতারকের পাশে নিয়ে গর্দান কাটো”।
রাজার আদেশে সেই দুর্ভাগা মন্ত্রীর গর্দান গেল। এই দৃশ্য দেখে সেই প্রতারকের কাটা মাথাটি হো হো করে হেসে উঠলো,
‘কি মশাই দেখলেতো?আমি মরে গেলেও মানুষকে ঠকাতে পারি’।
উপস্থিত দ্বিতীয় মন্ত্রী প্রতারক কাটামুন্ডুর কথা শুনেতো তাজ্জব। এক দৌড়ে রাজার কাছে গিয়ে এই আজব কাহিনীর কথা খুলে বল্লো।
একথা শুনে রাজার মন অনুশোচনা আর দুঃখে কাতর হয়ে উঠলো। সে বুঝতে পারলো প্রতারকটি ভীষন ভয়ংকর এবং মৃত্যুর পরও এর কাটা মুন্ডু আরো অনেক সমস্যা তৈরী করতে পারে। তাই সে আদেশ দিল ‘এই কে কোথায় আছো? এক্ষুনি ঐ পাজী প্রতারকের কাটা মুন্ডুটা মাটিতে গভীর গর্ত করে পুতে ফেলো’। সাথে সাথে রাজার আদেশে পালন করা হলো। ২ হাত গর্ত করে মুন্ডটা সেখানে পুতে মাটি চাপা দেয়া হলো।
পরদিন সবাই অবাক হয়ে দেখলো সেই গর্ত থেকে একটা অপরিচিত গাছ গজিয়ে উঠলো, এমন গাছ তারা জীবনেও কখনো দেখেনি। আর তার মাথার দিকে ঝুলে ছিল অচেনা এক রকম ফল যা কিনা দেখতে হুবুহু প্রতারকের সেই মাথাটির মত। এই অদ্ভুত গাছটিই হলো নারিকেল গাছ যাকে বার্মিজরা গন-বিন গাছ বলে থাকে। বহু বছর ধরে মানুষের মুখে পরিবর্তিত হয়ে এখন এর নাম হয়েছে অন-বিন।
তুমি যদি কখনো একটি গন-থি অর্থাৎ নারিকেল ধরে ঝাঁকি দাও দেখবে ভেতর থেকে একটা গল্ গল্ আওয়াজ ভেসে আসছে, এর অর্থ হলো সেই দুষ্ট ঠগের মাথাটি এখোনো বুদ্ধি আটছে কি করে তোমাকে ঠকানো যায়।
আমার কথাটি ফুড়োলো
নটে গাছট মুড়লো ।
ছবিঃ প্রথমটি আমার তোলা, দ্বিতীয়টি নেট
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০১৬ সকাল ৯:৪৫