সে অনেক অনেক দিন আগের কথা যখন আমাদের দাদু নানুদের জন্মই হয়নি, এমনকি তাদের দাদু নানুরাও পৃথিবীর আলো দেখেনি। তারও অনেক অনেক বছর আগে একদিন ভোরবেলাতে এক ছোট্ট পাখী গাছের ডালে বসে আপনমনে শিষ দিয়ে সুর করে গান গাইছিল। এমন সময় এক বাদুড় উড়ে এসে তার পাশে বসলো।
‘বাব্বাহ্ পাখী ভাই তুমি তো ভারী সুন্দর গান গাও দেখছি আর তেমনি মিষ্টি তোমার গলা’। বাদুড়ের প্রশংসা শুনে পাখিতো খুশীতে ডগমগ, কি করবে না করবে ভেবেই আকুল। যাইহোক তারপর দুজন মিলে এ্টা সেটা নিয়ে কত যে গল্প করতে লাগলো তা রূপকথাতে বলার নয় কলম দিয়ে লেখার নয়।
একসময় বাদুড় বলে উঠলো, ‘ভাই আমার মনে হয় কি জানো’?
“কি মনে হয় বাদুড় ভাই”? পাখী প্রশ্ন করে।
বাদুড় বল্লো, ‘ভালো করে একবার তাকিয়ে দেখো দিকিনি আমার দিকে’।
“দেখলাম, কিন্ত কি বুঝাতে চাইছো ভায়া?” মিনিট কয়েক তাকিয়ে থেকে কাঁচুমাচু হয়ে পাখী বলে উঠলো।
‘বুঝতে পারো নি? শোনো তাহলে খুলেই বলি, বলছিলাম কি, আমার মনে হচ্ছে আমি আসলে তোমার মতই একটি পাখী। দেখ দেখ তোমার মত আমারও দুটো ডানা আছে আর আমি খুব ভালো উড়তেও পারি'।
"তাই নাকি"! পাখী অবাক হয়ে যায়
'সেটাই তো বলছি' জোর গলায় বাদুড় বলে উঠে। 'আর আমরা দুজনাই যখন পাখী তাহলে আলাদা কেন থাকি ? এখন থেকে একত্তরে বাস করি কি বলো’?
পাখীতো শুনে খুব খুশী বল্লো, “ঠিকই বলেছো ভায়া, বেশ এখন থেকে আমরা একসাথেই থাকবো”।
তারপর মনের আনন্দে ডিগবাজী খেয়ে কিছুক্ষন উড়ে বেড়ালো দুজন।
বাদুড় আর পাখী মহাসুখে একসাথে খায় দায় আর উড়ে বেড়ায় । একদিন গাছের ডালে বাদুড় গা এলিয়ে আরাম করে বসে আছে, এমন সময় পাখী এসে বল্লো,
“বন্ধু এখনতো বাসা বানাবার সময় হয়ে এলো, আসো আমরা খড়কুটো দিয়ে দুজন মিলে একটা বাসা বানাই”।
পাখীর কথা শুনে বাদুড় তো অবাক। কথাটি তার একটুও পছন্দ হলো না। আসল কথা কি জানো বাদুড়টি ছিল ভারী আলসে। এসব খাটুনি করতে সে একটুও রাজী নয়। মনে মনে সে দ্রুত একটা ফন্দি বের করলো।
‘পাখী ভাই একটা কথা আমি কদিন ধরে ভাবছি কিন্ত বলতে লজ্জা লাগছে’।
“না না লজ্জার কিছু নেই, কি ভাবছিলে বলতো” পাখী উৎসুক চোখে বাদুড়ের দিকে তাকালো।
বাদুড় মন খারাপের ভান করে বল্লো, ‘ভায়া ইদানীং কেন জানি মনে হচ্ছে আমি বোধহয় তোমার মত পাখী নই'।
"কি বলছো তুমি"? চমকে উঠে পাখী ।
'সত্যি বলছি , আমার মনে হয় আমি আসলে একটি ইদুর, দেখনা ইদুরের মত গায়ে ঘন পশম আর কান । তাই তোমার সাথে না থেকে ইদুরের সাথে থাকাই আমার জন্য ঠিক, কি বলো?’বলে উঠে বাদুড়।
“ও আছা ! আমারও এখন তাই মনে হচ্ছে, তুমি একটা ইদুরই হবে হয়তো। আচ্ছা যাও, ভালো থেকো,” হতভম্ব পাখী বলে উঠলো কোনরকমে।
পাখীর থেকে বিদায় নিয়ে বাদুড় উড়তে উড়তে মাঠে থাকা এক ইদুরের কাছে হাজির।
‘ইদুর ভায়া, ইদুর ভায়া বাড়ী আছো কি’?
বাদুড়ের ডাকা ডাকিতে তড়িঘরি করে ঝোপ থেকে বের হয়ে আসলো, ইদুর
“কি হলো, কি হলো ভাই বাদুড়, ডাকছো ক্যানো শুনি”?
‘বলছিলাম কি ইদুর ভায়া, চেয়ে দেখ আমার গায়ে ঠিক ঠিক তোমার মত ঘন আর গাঢ় রঙ এর পশম, আবার দেখো আমার কান দুটোও ঠিক তোমার মত। আমার মনে হয় আমি একটি ইদুর’।
বাদুড়
“ঠিকই বলেছো তোমাকেতো দেখি দিব্যি ইদুরের মতই লাগছে, তাছাড়া তোমার চেহারাটাও খুব সুন্দর” বলে উঠে ইদুর
‘ভাই তুমি আর আমি দুজনাই যখন ইদুর তাহলে আর আলাদা থাকা ক্যানো? আমরাতো একসাথেই বাস করতে পারি কি বলো?’ বাদুড় বলে উঠে?
“অবশ্যই, অবশ্যই, এখন থেকে আমরা দুজন এক সাথেই থাকবো ” বলে ইদুর দু হাত বাড়িয়ে আহবান জানালো নতুন অতিথিকে।
বেশ কিছুক্ষন তারা দুজন মহা উল্লাসে খেলাধুলা করে সময় কাটালো। এবার ইদুর বাদুড়কে ডেকে বল্লো “বন্ধু, আসো এবার আমরা দুজন মিলে একটা গর্ত খুড়ি”।
‘কেন, গর্ত কেন! কিসের জন্য গর্ত খুড়বো’? বাদুড় বিস্মিত গলায় বলে উঠে।
“কেন আবার! রোঁদ বৃষ্টি ঝড়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য গর্ত করে বাসা বানাবো” অবাক গলায় বলে উঠে ইদুর।
কিন্ত ইদুরের কথা বাদুড়ের একটুও পছন্দ হলোনা। কারন গর্ত খুড়তে তো কষ্ট আর সে ছিল দারুন আলসে তা আমরা আগেই দেখেছি।
‘তুমি কি আমার পাখা দেখনি ভায়া’? আমার মনে হচ্ছে আমি ইদুর নই, আমি আসলে পাখী। আর পাখী যখন তখন তো পাখীর সাথে থাকাই উচিৎ কি বলো ভাই'? ।
‘ঠিক আছে খোদা হাফেজ” বিরক্ত ইদুর হাত নেড়ে বাদুড়কে বিদায় জানিয়ে গর্ত খোড়ার জায়গা খুজতে লাগলো।
বাদুড় যখন পাখীর কাছে আসলো দেখলো পাখী একাই তার বাসা বানিয়ে ফেলেছে।
‘বন্ধু, বন্ধু কি করো ? আমি এসে পড়েছি, ভেবে দেখলাম আমি আসলেই একটা পাখী, তাই এখন থেকে আমি তোমার সাথে থাকবো ভাবছি’ বাদুড় হাসি হাসি মুখে মুখে বলে উঠে।
“কি বলছো! না ভাই আমার বাসায় তোমার জায়গা হবে না ।তাছাড়া তুমি বলেছো তুমি পাখী নও।ইদুরের মত তোমার গায়ে আছে পশম আর সাথে দুটো কান। এখান থেকে জলদি যাও আর ইদুরের সাথেই থাকো গিয়ে” চোখ মুখ কুচকে ডানা ঝাপটে বলে উঠে পাখী ।
পাখীর কথায় মনক্ষুন্ন বাদুড় উড়তে উড়তে আবার ইদুরের কাছে হাজির হলো। বেলচা নিয়ে ইদুর তখন গর্ত খুড়তে মহাব্যাস্ত। পাজী আলসে বাদুড়কে দেখেই মেজাজ খারাপ হলো ইদুরের, গলায় ঝাঁঝ মিশিয়ে বলে উঠলো,
‘কি ব্যাপার আবার এসেছো যে! এখানে কি চাও তুমি’?
“আমি এখন থেকে তোমার সাথেই থাকবো ভায়া, আমি আসলে পাখী নই, আমি ইদুর” করুন গলায় বলে উঠে বাদুড়।
বাদুড়ের কথা শুনে ইদুর রাগে তার কুটকুটে দাতগুলো কিড়মিড় করে বল্লো,
‘যাও, যাও ভাগো এখান থেকে। ইদুর হবে কেন? তুমি নাকি পাখী, বললে তোমার পাখা আছে, তা তুমি পাখীর সাথেই থাকো, এখানে তোমার জায়গা হবে না'।
একথা শুনে হতাশ বাদুড় একবার উড়ে পাখীর কাছে যায়, আরেকবার উড়ে ইদুরের কাছে আসে।বাদুড়ের এই দৌড়াদৌড়িতে পাখী আর ইদুর দুজনাই রেগে কাঁই,
‘যা, যা দূর হ,দুর হ হতচ্ছাড়া বাদুড়’ চোখ পাকিয়ে বলে উঠে তারা। কিন্ত কে শোনে কার কথা! বাদুড়ের আসা যাওয়া আর বন্ধ হয়না।
শেষমেষ ইদুর আর পাখী রেগে কাঁই হয়ে বল্লো, “শোনো, তুমি হচ্ছো এক মহা আলসে, ফাকিবাজ, বাসা বানানো তোমার কর্ম নয়। তাছাড়া তুমিতো এখনো সিদ্ধান্তই নিতে পারোনি যে তুমি আসলে কি?তুমি কি আকাশে ওড়া পাখী? নাকি মাটির গর্তে থাকা ইদুর?
তারচেয়ে বরং তুমি পাহাড়ের মধ্যে একটা গুহা খুজে বের করে তার ছাদে পা ঠেকিয়ে উলটো হয়ে ঝুলে থাকো। এতে তোমার পাখীর মত আকাশে থাকতেও হবেনা আবার ইদুরের মত মাটিতে থাকতেও হবেনা। এখন থেকে আকাশ আর মাটির মাঝেই থাকবে তুমি ঝুলে’।
বেচারা বাদুড় কি আর করে বাধ্য হয়ে পাখী আর ইদুরের কথা মেনে নিল, অর্থাৎ এখন পর্যন্ত সে ওভাবেই উল্টোবাগে সারা দিনমান ঝুলে থাকে তার অন্ধকার গুহায় । এরপর থেকেই দুষ্ট বাদুড় পাখী আর ইদুরের মুখোমুখি হতে লজ্জা পায়। তাইতো খাবারের খোজে দিনে নয়, রাতের অন্ধকারে বের হয়ে আসে তার গুহা থেকে।
রাতের আধারে ফল চুরি
আমার কথাটি ফুরোলো
নটে গাছটি মুড়লো ।
ছবিঃ অন্তর্জাল
আমার অনুদিত বিভিন্ন দেশের উপকথা ঃ-
চাঁদ আর সুর্য্য কেন আকাশে? এত্তোবড় পৃথিবীতে তাদের ঠাই হলনা কেন? (একটি নাইজেরিয়ান শিশুতোষ উপকথা) ?
ধুর্ত শেয়াল আর বুদ্ধিমান কুইরকুঞ্চো (একটি আর্জেন্টিনীয় উপকথা)
নারকেলটা কেমন করে মায়ানমারে এলো ! ( একটি বার্মিজ উপকথা)
এক যে ছিল ছেয়ে খরগোশ আর এক ছিল হোৎকা কুমীর (থাইল্যন্ডের উপকথা )
কি করে উট তার রূপ হারালো (একটি মঙ্গোলিয়ান উপকথা)
সাগর তোমার জলটি কেন নোনা !? ( একটি কোরিয়ান উপকথা) উৎসর্গ সহব্লগার মাইনুদ্দিন মইনুলের দুটো ছোট্ট পরীকে ….
হাঙ্গর মানব !! (হাওয়াই দ্বীপের এক কিংবদন্তীর কথা)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ সকাল ১০:২৮