পাথরের তৈরী যাঁতা
সাগর নিয়ে কত কবি সাহিত্যিক কত গল্প কবিতা লিখেছে তার শেষ নেই তারপরো যেন সাগরের সেই মহিমান্বিত রূপটি নিজ চোখে না দেখলে বর্ননা করা কষ্ট বৈকি । সেই আদিগন্ত বিস্তৃত সাগর তার স্বচ্ছ নীল বা পান্না সবুজ ফেনীল জলরাশি সাথে মাথায় শুভ্র সাদা মুকুট পরে সৈকতে এসে আছড়ে পরছে সে দৃশ্য দেখে সিন্ধু, সমুদ্র বা অর্নব, বারিধি যে নামেই সাগরকে ডাকি না কেন তার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়নি এমন কেউ আছে কি না সন্দেহ।
আমাদের এই পৃথিবীর চার ভাগের তিন ভাগেই সাগর ছড়িয়ে আছে কিন্ত তার একটাই দুঃখ এত জল বুকে নিয়েও সে কারো তৃষ্ণা মেটাতে অক্ষম। কেন তা পরীক্ষা করতে মুখে দিয়ে দেখেছেন কি কখনো ? যদি দিয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই বলতে পারবেন কি ভীষন লবনাক্ত সেই সুনীল জলরাশি ? তবে এক সময় কিন্ত এই পানি সুপেয় ছিল। কি করে সেই পানি পানের অযোগ্য হয়ে পরলো তাই এবার শুনি কোরিয়ান এক উপকথা থেকে। এই কাহিনীটি কিন্ত অনেক দেশে অনেক ভাবে লেখা আছে, তবে এটাই আমার ভালোলেগেছে আর তাই আপনাদের সাথে শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না ।
সেই অনেক অনেক বছর আগের কথা, মনে করো কয়েকশ বছরতো হবেই সেসময় এক দেশে এক রাজা ছিল। তাঁর হাতীশালে হাতী, ঘোড়াশালে ঘোড়া আর তার কোষাগারে কত যে হীরা, মুক্তা, জহরত ছিল তার কোন হিসেবই নেই। কিন্ত সবচেয়ে ব্যতিক্রমী যে জিনিসের মালিক ছিলেন তিনি তা হলো একটা পাথরের যাঁতা।যে কোন সাধারণ যাঁতার মত দেখতে হলেও তার ছিল এক আশ্চর্য্য ক্ষমতা। সেই যাদুই যাতার ক্ষমতাটি ছিল এমন যে, সেই যাঁতা ঘুরিয়ে যে যা চাইতো তাই বের হয়ে আসতো । সাধারনত গম বা শস্য চুর্ন করার জন্যই যাঁতা ব্যাবহার করা হয়। কিন্ত এই যাঁতা ঘুরিয়ে কেউ যদি বলতো ' আমি স্বর্ন চাই তাহলে যাঁতার দুই পাথরের ফাঁক থেকে স্বর্নরেনু বের হয়ে আসতো। তেমনি করে কেউ যদি গম বা চাল চাইতো যাতা তাই তৎক্ষনাৎ হাজির। মোদ্দা কথা হলো এই যাদুই যাঁতাটির কাছে যাই চাওয়া হতো মুহুর্তের মধ্যে তা হাজির হতো।
সেই দেশে ছিল এক মস্ত চোর। একদিন তার কানেও এই যাঁতার খবর পৌছালো। শোনার সাথে সাথেই চোর মনে মনে ভাবলো যে করেই হোক রাজবাড়ী থেকে এটা চুরি করতেই হবে। মন থেকে যাঁতা চুরির কথা সে মুছতেই পারে না। নানা রকম ফন্দী ফিকিরের কথা ভাবতে ভাবতে তার দিন যায়।
একদিন আর থাকতে না পেরে সেই চোর গ্রাম থেকে রাজধানীতে আসলো। তারপর এক জ্ঞ্যানী পন্ডিতের মত পোশাক পড়ে আর সাজগোজ করে এক রাজকর্মচারীর সাথে দেখা করলো। সেই কর্মচারীর রাজপ্রসাদে ছিল অবাধ যাতায়ত। চোর এই কথা সেই কথা নিয়ে রাজকর্মচারীর সাথে আলাপ করতে করতে সুযোগ পেয়ে এক সময় বলে উঠলো,
“ভাই আমি শুনেছি আমাদের রাজা মশাই নাকি তার সেই আশ্চর্য্য যাদুর যাঁতাটি মাটিতে পুঁতে রেখেছে। কারন সে নাকি তার উজির -নাজির, মন্ত্রী পারিষদ কাউকেই এই ব্যাপারে বিশ্বাস করে না, সত্যি নাকি ভাই ?”।
ছদ্ববেশী চোরের কথা শুনে রাজকর্মচারীরতো ভীষন রাগ হলো, বল্লো,
'কি বলছেন আপনি? রাজা তার পারিষদদের বিশ্বাস করে না ! কোথায় পেলেন এমন আজগুবী কথা!'
এই ব্যাপারে রাজকর্মচারীর প্রতিক্রিয়া দেখে চোরটি মনে মনে খুশি হলো, কিন্ত মুখটি করুন করে বল্লো,
"ভাই আপনি রাগ করবেন না , আমি শুনেছি দেশের বিভিন্ন গ্রামে গঞ্জে। লোকে বলে রাজা নাকি এক গভীর গর্ত করে যাঁতাটি লুকিয়ে রেখেছে যাতে কেউ চুরি করতে না পারে”।
‘এ সব বাজে কথা, আমাদের রাজামশাই প্রাসাদের অন্দরমহলের পদ্ম পুকুরের পাশেই যাঁতাটা ফেলে রেখেছে'। রাজকর্মচারী বলে উঠলো ক্ষুদ্ধ গলায়।
উত্তেজনা চেপে চোরটি কোনোরকমে বলে উঠলো “আচ্ছা তাই নাকি!” 'অবশ্যই' রাগতঃ গলায় বলে উঠলো রাজকর্মচারী।
‘রাজার যাঁতা চুরি করবে এমন সাহস কার আছে এই দেশে শুনি ? কত লোকই তো এর পাশ দিয়ে আসছে যাচ্ছে কিন্ত এটা চুরি করবে এমন চিন্তা করার কেউ আছে কি?’
চোরটি কোনরকমে “আচ্ছা” বলে সেখান থেকে বের হয়ে আসলো।
সব কিছু জেনে শুনে চোর বাবাজী দিনের পর দিন বসে বসে ভাবতে লাগলো ব্যাপারটি নিয়ে।এক অমাবষ্যার রাতে যখন চারিদিক নিকষ কালো অন্ধকারে ঢেকে গেল সেই ফাকে চোর মশাই প্রাসাদের দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকে পদ্ম পুকুরের পাশ থেকে আস্তে করে যাঁতাটি তুলে নিলো।
যাঁতা নিয়ে দেয়াল পর্যন্ত আসতে আসতে গর্বে আর আত্নবিশ্বাসে চোরের তখন ব্যাঙ্গের মত ফুলে উঠার দশা। কিন্ত দেয়াল পেরুতেই তার বুক কেঁপে উঠলো। সর্বনাশ এখন যদি সে ধরা পরে তবে আর রক্ষা নাই।রাজা তার গর্দান নিতে এক মুহুর্ত দেরী করবে না। রাস্তায় যাকে দেখে তাকেই মনে করে এই বুঝি তাকে ধরতে আসছে। চোর বুঝলো এত ভয় নিয়ে এখানে থাকা চলবে না যত তাড়াতাড়ি পারা যায় নিজ গ্রামে ফিরে যেতে হবে। কিন্ত সাগর পাড়ি দিয়ে তাকে গ্রামে যেতে হবে আর তার জন্য দরকার একটি নৌকা। চোরের মন স্বাভাবিক ভাবেই প্রথমেই তার মাথায় আসলো
একটি নৌকা চুরির কথা।
এই নৌকা করে সে নিজ গ্রামে ফিরে গিয়ে যাঁতাটি লুকিয়ে রাখবে।কারন রাজা মশাই যখন টের পাবে এই চুরির কথা তখন এই শহরের বাসা বাড়ী আর রাস্তাঘাটের সব লোককে তল্লাশী করে ছাড়বে।আর ধরা পরলে যে কি হবে সে তো চোর আগেই জানতো।
যেই ভাবা সেই কাজ। তাড়াতাড়ি সমুদ্রের পাড়ে গিয়ে চোর এক নৌকা চুরি করে তাতে যাঁতা নিয়ে বসলো। দড়ি ছেড়ে বৈঠা বেয়ে সমুদ্রের তীর থেকে কিছুটা পথ আসতেই চোরের মনটা খুশী খুশী হয়ে উঠলো। খুশীর চোটে হাসতে হাসতে মাথাটি এলিয়ে দিল নৌকার গলুইয়ে। খানিক পরে সে উঠে গান গাইতে লাগলো আর সেই সাথে শুরু হলো নাচ। চোর মনে মনে চিন্তা করতে লাগলো,
"হে খোদা এখনতো আমি বিশাল ধন দৌলতের মালিক হয়ে যাবো।কি চাইতে পারি আমি যাঁতার কাছে, কি চাইবো? তবে এটা ঠিক আমি এক ব্যাতিক্রমী জিনিস চাইবো কোন সাধারণ জিনিস নয়। কিন্ত কি সেটা "?
ভাবতে ভাবতে চোরের মাথা খারাপ হওয়ার অবস্থা। হটাৎ চোরের মনে হলো অন্য কিছু নয়, লবন, আমি যাঁতার কাছে লবন চাইবো, কারন লবন এমন একটা জিনিস যা সবার প্রয়োজন। এই লবন বেচেই আমি বড়লোক হবো’।
তাড়াতাড়ি হাটু গেড়ে বসে চোর যাঁতার হাতলটা চেপে ধরলো, তারপর ঘুরাতে শুরু করলো। হাতল ঘুরায় আর বলে, " যাঁতা, যাঁতা তুমি আমার জন্য কিছু লবন তৈরী করো’।
বলার সাথে সাথেই চোর অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে যাঁতা থেকে সাদা ধব্ধবে লবন বেরিয়ে আসছে। খুশীতে তো চোর আত্নহারা। কি করবে না করবে ভেবে পায়না। দেশের সবচেয়ে ধনী হওয়া থেকে আর কেউ ঠেকাতে পারবে না তাকে।
আবার গলুইয়ে মাথা দিয়ে চোর গান গাইতে লাগলো।এদিকে যাঁতা নিজের মনে ঘুরছে তো ঘুরছেই আর সেই সাথে বের হয়ে আসছে রাশি রাশি লবন। নৌকা যে প্রায় ভরে আসছে সেদিকে চোরের খেয়াল নেই, সে শুধু হাসছে, গান গাইছে, আর উন্মত্তের মত নেচেই চলেছে। চোর ভাবছে ধনী হলে সে বিশাল এক বাড়ী বানাবে, কত দাসদাসী থাকবে যারা তাকে মুহুর্তের মধ্যে হাজার রকম মজার মজার খাবার সামনে এনে হাজির করবে।
চোর যখন এসব ভেবে চলছে তারই ফাকে পুরো নৌকা লবনে বোঝাই হয়ে পড়লো, একসময় ভার সামলাতে না পেরে নৌকাটি মাঝ দরিয়ায় জন্মের মত চোর আর যাঁতাসহ সেই যে ডুব দিল আর তার কেউ কোনদিন খোঁজ পেলো না।
এদিকে যাঁতাটিকে তো আর কেউ বন্ধ হতে বলেনি, তাই আজও সে সমুদ্রের নীচে বসে ঘুর ঘুর করেই চলছে আর সেখান থেকে রাশি রাশি লবন বেরিয়ে সমুদ্রের পানির সাথে মিশেই যাচ্ছে অনবরত। এরই ফলে সমুদ্রের পানি এত নোনা, যা কিনা একেবারে পানের অযোগ্য। তাই তো ইংরেজ কবি স্যামুয়েল কোলরিজ তার বিখ্যাত এনসিয়েন্ট মেরিনার কবিতায় লিখেছিলেনঃ
Water, water, every where,
Nor any drop to drink.
আমার কথাটি ফুরালো, নটে গাছটি মুড়ালো।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ৯:৪৪