নাও ছাড়িয়া দে, পাল উড়াইয়া দে, গা মাঝি গা রে যত গান
রাত তখনো ভোর হয়নি সুন্দরবনের দিকে যেতে যেতে খুব সকালে চোখে পড়লো অপুর্ব এক দৃশ্য। চারিদিক কুয়াশাচ্ছন্ন আর তার মাঝেই সারি বেধে নৌকা ভাসিয়ে গ্রাম ছেড়েছে একদল মৎস শিকারী। মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইলাম বটে কিন্ত সেই সাথে মনে হলো পরিবার পরিজন ছেড়ে কি জানি কতদিনের এই দুর্গম যাত্রা শুরু তাদের?
সুন্দরবন নামের এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের এক গর্ব যার অবস্থান পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকায় বদ্বীপ এলাকায় । ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা এই বনের ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালি ও বরগুনা জেলা জুড়ে স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে বাঁদাবন।
উপগ্রহ থেকে তোলা গাঢ় রঙ্গে রঙ্গীন সুন্দরবন
সেই বাঁদাবনে বাওয়ালী, মৌয়াল এর সাথে আরো রয়েছে আরো এক সম্প্রদায় তারা হলো জেলে। মাছ ধরা যাদের পেশা। মাছের সাথে আরো রয়েছে কাঁকড়া ধরা। পদে পদে মৃত্যুর চোখ রাঙ্গানী উপেক্ষা করে দিনের পর দিন সুন্দরবনের খালে খালে নৌকা ভাসিয়ে চলে জেলের দল।
কেওড়া আর নাম না জানা গাছের মাঝে দিয়ে বয়ে চলা এমন অসংখ্য খাল
দুর্গম সেই বাঁদাবনের রাজা মানুষ খেকো বাঘ, যা সারা বিশ্বে যা রয়েল বেঙ্গল টাইগার নামেই পরিচিত তার হিংস্র থাবা এড়িয়ে, বিভিন্ন প্রজাতির অসংখ্য বিষাক্ত সাপ এর কামড় থেকে সতর্ক থেকে জীবন যুদ্ধে লিপ্ত তারা, পানিতেও ছাড় নেই তাদের,কারন সেখানে রয়েছে ভয়ংকর কুমীর। আর প্রকৃতির রুদ্র রোষ ঝড় ঝঞ্জা তো তাদের নিত্য সহচর। তাই স্থানীয় জেলেরা বনদেবী বনবিবির প্রার্থণা ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে যাত্রা শুরুর আগে। সুন্দরবনের ভেতর খালে বিলে নিরাপদ বিচরণের জন্য বাঘের দেবতা দক্ষিন রায় এর প্রার্থণা করাও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে জরুরি।
কাজল নদীর জলে, ভরা ঢেউ ছলছলে,প্রদীপ ভাসাও কারে স্মরিয়া..,সোনার বরণী মেয়ে, বলো কার পথ চেয়ে, আঁখি দুটি উঠে জলে ভরিয়া
মাঝি বাইয়া যাওরে .।
সারি বেধে শুরু হলো এ পথ চলা,কত দিনে শেষ হবে যায় কি বলা!
দুরন্ত নদী মেঘনা যার কুল নাই কিনার নাই। তারই বুকে আমাদের নির্ভিক জেলেরা ছোট এক ডিঙ্গি নৌকায় চড়ে শীত গ্রীস্ম বর্ষা সব ঋতুতেই জীবিকা নির্বাহের জন্য কি কষ্টই যে করছে না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
হাড় কাপানো শীতের ভোরে মেঘনায় মাছের সন্ধানে
হেমন্ত মুখোপাধায় আর লতা মুঙ্গেশকর মনে হয় এদের কথা ভেবেই গানটি গেয়েছিল আর লেখক মনে হয় বিখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দোপাধ্যায় ।
আমাদের জলযান থেকে ডাক আসায় এগিয়ে আসছে জেলের দল
আটার টোপ দিয়ে চিংড়ি মাছ ধরছে মোহনপুর চাদপুর মেঘনা নদীতে
এত দ্রুত তাদের হাতের কাজ যা আমরা অনেকক্ষন পর্যবেক্ষন করেও ধরতে পারি নি
ইলিশের সন্ধানে আতিপাঁতি করে খোজাখুজি চলছে জাল
নদীতে ইতস্তত ভেসে থাকা জেলেদের নৌকা
কুয়াশার মাঝে ভোরের নদীতে
সুপতি নদীতে ভোর সকালে বিলুপ্ত প্রায় মাছের সন্ধানে
জাল টেনে মাছের সন্ধানে সারাদিন
মেঘনায় ভেসে থাকা এক জেলে
কাঁকড়ার সন্ধানে বাঁদা বনের খালের মাঝে
কাঁকড়া ধরা নৌকার সারি
নিঃসংগ জেলে
দুবলার চরের জেলে নৌকা, তবে এদের লক্ষ্য খাল নয়, মোহনা
এবার আর ডিঙ্গি নয়, ট্রলারে শুরু হলো মাছ ধরার পালা
মাছে ভাতে বাঙ্গালী আমরা মাছ থাকলে আর কি চাই ? কিন্ত এতগুলো জেলে নৌকায় উল্লেখযোগ্য পরিমান কোন মাছেরই দেখা পেলাম না । তবুও অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে সেই শীতের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই সব জেলের দল । একসময় স্থানীয় জনসাধারণের প্রাণিজ প্রোটিন ৮০ শতাংশ মেটাতো মাছ। এখন মাছ খাওয়ার সৌভাগ্য এলাকার খুব কম লোকেরই ভাগ্যে জোটে।
২য়টি বাদে সকল ছবি আমাদের ক্যামেরায় তোলা
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ সকাল ৯:৫৫