চারমিনার
চারমিনার নামটি আমাদের অনেকের কাছেই অত্যন্ত সুপরিচিত। গত বছরের কাছাকাছি এই সময়ে আমার কুড়ি দিনের দীর্ঘ ভারত ভ্রমণ তালিকায় অনেক কিছুর সাথে ছিল চারমিনার ।
চারমিনারের জানালায় ইসলামিক স্থাপত্যের নমুনা সেই পাথরের জাফরি কাটা নকশা
চারশ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক শহর হায়দ্রাবাদের হৃদপিন্ড হিসেবে পরিচিত জগৎ বিখ্যাত চারমিনার কে আরেকবার ঘুরে দেখার বাসনায় অন্ধ্র প্রদেশকে বেছে নিলাম।
সকাল দশটায় নাস্তা সেরেই হাজির হোলাম আগেরদিন সন্ধ্যায় ট্রেন থেকে নেমেই এক ঝলক দেখা মুসলিম স্থাপত্য কলার এক অনন্য সৃষ্টি চারমিনার চত্বরে ।
চারমিনারে প্রবেশের বিশালাকৃতির ফটক
ভারতবর্ষের দুটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থাপনা যা সারা বিশ্বের মানুষ একনজর দেখেই চিনে নিতে পারে। একটি হলো প্রিয়তমা স্ত্রীর সমাধিকে স্মরনীয় করে রাখার জন্য আগ্রায় সম্রাট শাহজাহান কর্তৃক সৃষ্ট জগৎ বিখ্যাত তাজমহল। দ্বিতীয়টি অন্ধ্রপ্রদেশের রাজধানী হায়দ্রাবাদের কেন্দ্রে মুসী নদীর পুর্ব তীরে নির্মিত বিখ্যাত এই চারমিনার।
চারমিনারের নির্মাতা সুলতান কুলী কুতুব শাহ (৫ম) ১৫৮০-১৬১২ খৃঃ
ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাসে অন্ধ্রপ্রদেশের বিখ্যাত কুতুবশাহী রাজবংশের পন্চম সুলতান ছিলেন হায়দ্রাবাদ নগরীর প্রতিষ্ঠাতা কুলী কুতুব শাহ। ফার্সী এবং উর্দু ভাষায় কবিতা লিখতে তিনি ছিলেন পারঙ্গম।
খিলানের ধার ঘেষে অপরুপ কারুকাজ
এই কুতুব কুলী শাহই ছিলেন বিখ্যাত চারমিনার, মক্কা মসজিদসহ আরো অনেকগুলো ঐতিহাসিক স্থাপনার নির্মাতা। সব কিছু রেখে আজ শুধু দেখুন সেই জগৎবিখ্যাত চারমিনার আমার চোখে। এখানে উল্লেখ করি একটি বিজ্ঞাপনের কথা । ভারতের বিখ্যাত চারমিনার সিগারেটের প্যকেটেও কিন্ত এই সৌধের ছবি ব্যবহ্বৃত হয়ে থাকে।
মাঝখানে গম্বুজ আর তার চারিদিক ঘিরে এমন খিলানাকৃতির পথ
কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে ১৫৮৯ সনে কুতুবশাহী বংশের রাজধানী গোলাকুন্ডা থেকে হায়দ্রাবাদে সরিয়ে নিয়ে আসার পর সেখানে ভয়াবহ প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সুলতানের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৫৯১ খৃঃ এ হায়দ্রাবাদ শহর থেকে সম্পুর্ন ভাবে প্লেগ নির্মুল হয়। সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতার চিন্হ স্বরূপ সে বছরই তিনি শহরের ঠিক কেন্দ্রস্থলে নির্মান করেন চারমিনার ।
গম্বুজের ঠিক মাঝখানে পদ্মফুলের আকৃতির ডিজাইন
আবার কেউ কেউ বলে থাকেন সুলতান কুতুব কুলী শাহ ঠিক এখানেই তার প্রিয়তমা স্ত্রী বাগমতীর সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন।
চারমিনারের বাইরের দৃশ্য
যিনি পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে প্রধান মহীষির আসন অলংকৃত করেছিলেন। সেই প্রেমের স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্যই এই সৌধ।তবে এটা নির্ভরযোগ্য তথ্য নয়। প্রথম তথ্যটিই সর্বজনগ্রাহ্য।
গম্বুজের ভেতরের দিকে অলংকরন
বর্গাকৃতির পারস্য স্হাপত্যশৈলীতে নির্মিত জগৎ বিখ্যাত চারমিনার নির্মিত হয়েছে মার্বেল, চুনাপাথর আর গ্রানাইট এ। চৌকোনা এই ভবনটির প্রতিটি দিকই দৈর্ঘ্যে ২০ মিটার লম্বা।
একটি খিলানের মাঝে আমি
সৌধের চারিদিকে চার স্তর বিশিষ্ট চারটি সুদৃশ্য মিনার উচ্চতায় মাটি থেকে ৪৯ মিটার, যার মাথায় রয়েছে মুকুটের মত অপুর্ব কারুকাজ।
চারমিনারের গম্বুজের ভেতরে শেয়ালের মুখ এর প্রতিকৃতি
ইসলামিক শিল্প কলায় যেখানে ফুল লতা পাতা আর ক্যালিগ্রাফি ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না সেখানে প্রানীর ছবি বিশেষ করে শিয়ালের মাথার চিত্র এক অভুতপুর্ব ঘটনা।
মিনারের ভেতর দিকে পেচিয়ে ওঠা ১৪৯ টা সিড়ি ভেঙ্গে একদম উপরে উঠলে পুরো শহরটি চোখের সামনে ভেসে উঠে।
চারমিনারের বাইরের দিকে অপরূপ কারুকাজ
এই মিনারটির চারদিকে ১১ মিটার চওড়া এবং ২০ মিটার উচু চারটি বিশাল খিলান রয়েছে । আর এই খিলান বরাবর শহরের বুক চিরে চারদিকে চলে গেছে চারটি প্রশস্ত রাজপথ।
ভেতর থেকে গোলাকার নকশাকরা গম্বুজ
খিলানগুলোর উপরে দুটি তালার প্রথমটিতে মাদ্রাসা আর তার উপরে মসজিদ অবস্থিত।
খিলানের ভেতরের দিক
বিশালাকায় এই ভবনকে কেন্দ্র করেই প্রায় তিন বর্গমাইল এলাকা জুড়ে ঐতিহাসিক শহর হায়দ্রাবাদ বিরিয়ানী, মুক্তা, রেশমী বেলোয়ারী চুড়ির রিনিঝিনি আর আতরের গন্ধে ভরপুর।
দোতলা থেকে রাস্তা
পুরোনো এই শহরের সৌন্দর্য, সুগন্ধ, ঐতিহ্য এবং স্বাদের অপরূপ সম্পদ সম্ভার এখানের পাথরে পাথরে মিশে আছে আর সেই সাথে আছে ইতিহাস।
চারমিনারের পাশে এক বেলোয়ারী চুড়ির দোকানে
রাতের চারমিনার আরো আকর্ষনীয় পর্যটকদের কাছে। বিশেষ করে রমজান এবং ঈদের সময় একে কেন্দ্র করে ঢল নামে মানুষের।
রাতের চারমিনার
এর পশ্চিম দিকে রয়েছে বিখ্যাত মক্কা মসজিদ। পবিত্র মক্কাশরীফ থেকে মাটি এনে ইট তৈরী করে নির্মিত হয়েছিল বিখ্যাত এই মসজিদের প্রধান খিলান যার ফলে এই মসজিদের নাম মক্কা মসজিদ।
বিখ্যাত মক্কা মসজিদ
দশ হাজার মুসল্লীর ধারনক্ষমতা সম্বলিত বিশাল মক্কা মসজিদ পৃথিবীর অন্যতম এক বিশাল মসজিদ। পর্যটকদের জন্য অবশ্য দর্শনীয় এই মসজিদ মুহাম্মদ কুলি কুতুব শাহ এর সময়ে ১৬১৪ সালে এটা নির্মনের পরিকল্পনা করা হলেও এটা সম্পূর্ণ হয় ১৬৮৭ সালে যখন সম্রাট আওরঙ্গজেব গোলকু্ন্ডাকে মুঘল সাম্রাজ্যভূক্ত করেন।
এরই সাথে কুতুব শাহী বংশের যবনিকাপাত ঘটেছিল, কিন্ত মক্কা মসজিদ সহ চারমিনার তার স্বমহিমায় আজও টিকে আছে, আর ধরে রেখেছে তার শত বছরের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ।
কুলী কুতুব শাহ এবং রাতের চারমিনারের ছবি দুটো নেট থেকে নেয়া। বাকিগুলো আমাদের ক্যমেরায় তোলা।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মার্চ, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৮