কাঠের জেটি, গোরকঘাটা, মহেশখালী
জেটিতে উঠতেই ঘাট ডাক নেয়া কর্মকর্তারা জানিয়ে দিল স্পীড বোটে ফিরলে অবশ্যই বিকাল ৬টার আগেই ফিরে যেতে হবে কক্সবাজার।কারণ কিছুদিন আগেই নাকি রাতের আধারে দুটো স্পীড বোটের সংঘর্ষে এক শিশুর করুন মৃত্যু ঘটে, তাই এই নিষেধাজ্ঞা ।
৬টার আগে কক্সবাজার ফিরে যাবার নির্দেশিকা
কাঠের জেটি পার হয়ে কংক্রিটের বাধানো জেটির ওপর দাড়াতে না দাড়াতেই ছেকে ধরলো রিকশা আর ব্যাটারীর অটো চালকরা। গড় গড় করে বলে চল্লো সেখানে কি কি দেখার আছে।আদিনাথ মন্দির, রাখাইন পল্লী, মন্দিরসহ আরো অনেক কিছু।
রাখাইনদের মন্দির তবে ভেতরে যাওয়া হয়নি
আমরা সবিনয়ে জানালাম পর্যটন আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা অন্য একটি কাজ নিয়ে এসেছি।এর মাঝে একজন ব্যাটারী চালক সাবির নাম তার সাথে চুক্তি হলো সে আমাদের নির্ধারিত জায়গাগুলোতে নিয়ে যাবে এবং বিকাল ৫টার আগেই জেটিতে পৌছে দেবে।এই সাবিরকে নিয়েই আমরা মোট পাঁচদিন কক্সবাজার থেকে মহেশখালী এসে এসে কাজ করে গেছি।
শুরু হলো পথ চলা সাবিরের সাথে
তার সাথে শুরু হলো আমাদের যাত্রা ।জেটিটা যে জায়গায় সেটা মহেশখালী পৌরসভার গোরকঘাটা এলাকায় ।এখানে উপজেলা অফিস ছাড়াও বড় বড় এনজিওগুলোর প্রধান অফিস, বাজার রয়েছে। জেটির রাস্তাটা বেশ সরু, চারিপাশে কেওড়ার বন। জোয়ারের পানি সরে যাওয়ায় কাদামাটি বের হয়ে আছে। নৌকা আর ট্রলার গুলো মাটির উপর দাঁড়িয়ে আছে।
ভাটার সময় মহেশখালী চ্যানেল
বাঁধানো সরু পাকা রাস্তা আর রেলিং এ জাল শুকাতে দিয়েছে জেলেরা। কেউ বা বসে বসে ছেড়া ফাটাগুলো জালগুলোকে আবার জুড়ে নিচ্ছে সুতোর বাঁধনে ।
রিপু কর্ম চলছে নিবিষ্ট মনে
হাতের বাঁদিকে তাকিয়ে দেখি একটু ঢালু জায়গায় অল্প কিছু কাচা মাছ শুটকি বানানোর জন্য ঝুলিয়ে রেখেছে । কাছে গিয়ে দেখলাম এগুলো সবই বিদেশে রপ্তানীর জন্য। কারন সবগুলোই ছিল ছোট ছোট হাঙ্গর মাছ যা এদেশের মানুষ খায় না বলে জানালো ।আমাদের দেশে যে সব শুটকির প্রচলন যেমন রূপ চাঁদা, টেক চাঁদা, কোরাল, ছুরি, লইট্টা তার বেশিরভাগই পাশের দ্বীপ সোনাদিয়ায় তৈরী হয়।
বিদেশীদের রসনা তৃপ্তির জন্য ছোট ছোট হাঙ্গর মাছ শুকিয়ে শুটকী তৈরী হচ্ছে
সামনেই গোরকঘাটা বাজার ছাড়িয়ে একটু এগুলেই রাখাইন পল্লী।এক রেস্তোরায় বসে চা সিঙ্গাড়া খেয়ে রাখাইন পল্লীতে এসে হাজির হোলাম।অল্প কিছু দোকান অল্প জিনিসপত্র দিয়ে সাজানো, তবে কোন ক্রেতা নেই। ওদের ইন্টারভিয়ু নেয়ার ফাকে আমি দোকান ঘুরে শাল কিনলাম দুটো।রাখাইন মেয়েগুলোরও একই আক্ষেপ পর্যটক নেই।
রাখাইনদের একটি বাসার ভেতরেই তাঁত বসানো আর সেখানেই বিক্রী হচ্ছে তাদের তৈরী জিনিস
আবার সেখান থেকে শুরু হলো যাত্রা।নিস্তব্ধ শান্ত লোকালয় এর মাঝে আওয়াজ তুলে চলেছে আমাদের অটো। সেই কেয়ার ঝোপের পাশ দিয়ে বাধানো রাস্তা ধরে চলেছি ।চারিদিকে কি সেই অপরূপ মায়াময় সৌন্দর্য্য যা বলে বা ছবিতেও বর্ননা করা সম্ভব নয়।
এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাবার পথে
এক সময় চোখে পড়লো এক বট গাছ, আর তারই নীচে এক দিঘী। শীত কাল পানি কমে এসেছে তারপরও সেই সবুজ হয়ে আসা পানিতে ছেলে বুড়ো জমা হয়েছে মধ্যান্হকালীন স্নান পর্বে।
দুপুর হয়নি এখনো, তবুও স্নান সেরে নিচ্ছে অনেকে
শীতে শুকিয়ে যাওয়া ছোট জলাশয়ে পানি সেচে কাঁদার মাঝে মাছ খুজছে ছোট ছোট ছেলে পুলেরা।দু একজন মহিলাকেও দেখা গেল। সেই বাংলার চিরন্তন গ্রামীন জীবন।
কাঁদা হাতড়ে মাছ ধরায় ব্যস্ত ছেলে পুলের দল
জনমানবহীন এলাকায় গাছ পালা ঘেরা একটি ঘর। হয়তো বা কোন লবন চাষী বা কৃষকের আস্তানা।
একাকী একটি বসতবাড়ী, জানা হয়নি কাদের বাস সেখানে
কোথাও বা সেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের মাঝে অসুন্দরের এক প্রতিমুর্তি কি যেন তৈরী করছে ইট সিমেন্ট বালি দিয়ে।
কি যেন তৈরী করছে ইট সিমেন্ট দিয়ে কে জানে
আবার একের পর এক গ্রাম পেরিয়ে চলেছি আমাদের কাংখিত স্থানে ।
পথের পাশে ঘাসের বনে মাছ ধরা ছেলেদের হুটোপুটি
পথের আসে পাশে কোথাও জল জমে আছে সাথে অল্প কিছু ফাকা জমি তাতে গরু ভেড়া চরে বেড়াচ্ছে। সেই অপুর্ব দৃশ্য আমাদের শহুরে চোখে যেন এক মোহনীয় ছায়াছবি তৈরী করছে । মুগ্ধ আমরা।
খোলা মাঠ, দূরে হাল্কা পাতলা গাছের সারি, কিছুটা পানি জমে আছে
কোথাও বা কাছেই থাকা সমুদ্র থেকে নোনা পানি এনে শুকিয়ে লবন চাষ করছে চাষীরা।
লবন ক্ষেত
পরদিন আমরা চলেছি মহেশখালীর আরেক ইউনিয়ন ছোট মহেশখালীতে।উদ্দেশ্য জেলে সম্প্রদায়ের সাক্ষাৎলাভ। সেই গ্রামের নাম মুদীর ছড়া।রাস্তার একদিকে পাহাড় একদিকে সমতল।সমতলের কোথাও ধান চাষ হচ্ছে কোথাও বা পানের বরজ।
মহেশখালীর বিখ্যাত পানের বরজ
সাবির দেখালো ছোট্ট এক পানির ধারা পাহাড় থেকে নেমে আসছে। এই ছড়া বা ঝর্নার নামই নাকি মুদীর ছড়া।তার থেকেই সেই গ্রামের নামকরণ।
রাস্তার পাশে জলাভুমি
কিছুদুর যাবার পর এক জনপদে প্রবেশ করলাম। মাটির রাস্তা ধরে আস্তে আস্তে এগিয়ে এক বাসার সামনে অটো থামালো সাবির।পথের এক ধারে পাহাড় আর এক দিক গাছ পালার ফাকে দেখা যাচ্ছে খোলা মাঠ যা একটা নদীর তীরে গিয়ে মিলিয়ে গেছে।আমার মনটা উশখুস করে উঠলো সেখানে যাবার জন্য।
মহেশখালী চ্যনেলের পাশে সেই অপরূপ প্রকৃতি
গাছের ফাকে যে দু একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে তার সবই মাটি আর টিনের তৈরী।এরই মাঝে রাস্তার গা ঘেষেই একটা ইট সিমেন্টের অর্ধনির্মিত বাড়ী দেখিয়ে সাবির বল্লো ‘এটা আমার ফুপুর বাড়ী আমি এখানে বসি, আপনারা ঘুরে দেখেন এটা পুরোটাই জেলে পল্লী যার খোজে আপনারা এসেছেন’।
আমি তাকিয়ে আছি প্রানী আর প্রকৃতির সেই মোহনীয় রূপ এর দিকে
আমার স্বামী তার ফুপার পেশা সম্পর্কে জানতে চাইলে বল্লো তার ফুপা একটি মাছ ধরা ট্রলারের মালিক।মাছ ব্যাবসায়ী, ট্রলার ভাড়া খাটায়। যা আয় হয় তার এক তৃতীয়াংশের মালিক। আমাদেরতো এমন লোকও দরকার। ঠিক আছে সাবেরের ফুপাকে দিয়েই শুরু করা যাক আমাদের কাজ।
জেলেদের গ্রাম আর তাদের জীবন যাত্রা ঘিরে আছে সেখানে
সে জানালো তার বাপ চাচা অন্যান্য ভাইরা সবাই পাহাড়ের উপর তাদের আদি বাসায় বসবাস করে।সেখানে জায়গা না হওয়ায় সে এখানে তিন চার বিঘা জমি কিনে ঘর উঠিয়েছে।তাছাড়া তার ব্যবসার জন্যও সুবিধা ।কথার পালা শেষ হলোআমরা বিদায় নিয়ে গেটের দিকে এগুতেই সে বল্লো আসুন এই দিকে।
সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ আর গাছ, নীল আকাশ আর নদী
নদীর দিকে যে বাঁশের বেড়া সেদিকে নিয়ে একটা ছোট গেট খুলে দেয়ার সাথে সাথেই আমাদের চোখের সামনে সেই অবারিত মাঠ, নদী, ট্রলার, মাছ ধরা ডিঙ্গি নৌকা সব এক মুহুর্তে ভেসে উঠলো।
দিগন্ত বিস্তৃত রূপের ডালি মেলে আছে
নদীতে নোঙ্গর করা একটি ট্রলার দেখিয়ে জানালো এটা তার, ভাড়া দেয় যার তিন ভাগের এক ভাগ তার।
মাছ ধরার জাল শুকাতে দিয়েছে, কিছু বা গোটানো আছে
আমি এসব আর কি শুনবো আমি তাকিয়ে দেখছি প্রকৃতির সেই অসহনীয় রুপ সৌন্দর্য্য।
প্রকৃতি যেন দু হাতে ঢেলে দিয়েছে তার সব কিছু এই জেলে পল্লীতে
বাদিকে ঘন সবুজ বন আর সামনে সেই খোলা মাঠ আর দু একটা গাছ আর নীল রঙ নদী যার অপর দিকে সবুজ গাছের ঘন বন ছেয়ে আছে দিকচক্রবাল।
এই সৌন্দর্য্য শুধু উপভোগেরই বিষয়, বর্ননার নয়।
মোট পাঁচ দিন গিয়েছিলাম সেই মহেশখালী দ্বীপে।প্রতিটি মুহুর্তই আমরা উপভোগ করেছি।কখনো মনে হয়নি বড্ড একঘেয়ে লাগছে জায়গাটা। ক্রমাগত পাঁচদিন গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে চলেছি।
কথা বলেছি স্থানীয় জনগনের সাথে। জেনেছি যা আমাদের জানার ছিল। তারপরও সময়ের অভাবে অনেক জায়গায় যাওয়া হয়ে উঠেনি।
জেলেদের জাল অপেক্ষায় আছে আরেকবার সাগরে যাবার
অনেক বিখ্যাত জায়গা হয়তো দেখা হয়নি মহেশখালীর।যা সচরাচর সবাই দেখে থাকে।অন্য সময় হলে আমরাও হয়তো সেসবই দেখতে যেতাম।কিন্ত সম্পুর্ন অন্য কারনে প্রকৃতির যে অকৃত্রিম রূপ দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল তা ভাষায় বর্ননা করা দুঃসাধ্য।
মাঠ, নৌকা, গাছ আর নদী
দুরত্বের কারণে দেখা হয়নি প্রকৃতির নির্মম আক্রোশের সবচেয়ে সহজ শিকার ধলঘাট, মাতারবাড়ী ইউনিয়নবাসীদের।
আসার সময় জোয়ার থাকায় শেষবার চোখ বুলিয়ে আসলাম অপরূপা মহেশখালী চ্যানেলে যা এখন পানিতে পুর্ন।
জোয়ারের সময় পরিপুর্ন মহেশখালী চ্যানেল
ফিরে আসতে হয়েছিল যতটুকু দেখেছি সেই স্ম্বৃতি নিয়ে যা আপনাদের চোখের সামনে তুলে ধরলাম দুটি পর্বে।
আশাকরি আপনাদেরও ভালোলাগবে যেমনটি আমাদের লেগেছিল।
সব ছবি আমাদের ক্যামেরা এবং মোবাইলে তোলা