সাঝের আঁধারে রূপসী কন্যা নেচে নেচে এগিয়ে যাচ্ছে প্রিয় সাগর সৈকতে
প্রশান্ত মহাসাগরের ফেনীল জলরাশির মধ্যে ভেসে আছে একগুচ্ছ দ্বীপমালা যাকে সবাই একবাক্যে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ নামে চেনে। নীল সায়রের মাঝে এই দ্বীপগুলো যেমন ছড়ানো এক মুক্তোর মালা । দ্বীপের নামগুলোও তেমনি আকর্ষনীয় হাওয়াই, মাওই, কাওয়াই, মলোকাই এমন।কিন্ত এত নামের দ্বীপ থাকলে কি হবে, বিশ্বে এদের পরিচিতি এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যে দ্বীপটি হাওয়াই সেই তার নামেই ।
সমুদ্রের বুকে হাওয়াই দ্বীপের সারি
অপুর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য আর পাখীর কলতানে মুখরিত দ্বীপগুলো যেন এক একটি স্বর্গপুরী।দিনরাত শুভ্র মুকুট পরা নীল সাগরের ঢেউ একের পর এক আছড়ে পরছে দ্বীপগুলোর চারিদিক ঘিরে থাকা সাদা বালুকাবেলায়।
সেই স্বর্গপুরীর এক দ্বীপ হাওয়াই এর এক উপত্যকা নাম ছিল তার ওয়াইপিও।সেই উপত্যকায় অনেক অনেক বছর আগে বাস করতো এক অপরুপা রূপসী, সুন্দরী কন্যা, নাম ছিল তার কালেহ। সেই স্বর্গীয় উপত্যকায় যখন ধীরে ধীরে রাত নেমে আসতো রূপসী কালেহর আর ঘরে মন টিকতোনা। কি এক অমোঘ আকর্ষনে প্রতি রাতে সে ছুটে যেত সমুদ্র তীরে। নেমে পড়তো সফেন সমুদ্রে ডুব দিত পানকৌড়ির মত সেই ঘন কালো জলে।এ যেন শুধুই স্নান নয় ছিল তার কাছে এক তীব্র মাদকের নেশার মত ।
উপত্যকার মুখে সুনীল সাগর
এক পুর্নিমা রাত, সারা চরাচর ভেসে যাচ্ছে রূপালী আলোর বন্যায়, চাঁদের আলোয় চিক চিক করছে সমুদ্রতীরের বালুকারাশি। আছড়ে পরছে ফেনীল জলরাশি উপত্যকার পায়ের কাছে। এমন রাতে কালেহর মন কি আর ঘরে থাকতে চায়।বুনো ঘাসের মেখলা পরা, গলায়, মাথায় চাপা ফুলের মালা কালেহ ধীর পায়ে হেটে হেটে সমুদ্রের বেলাভুমিতে এসে দাঁড়ায়।দেখে নেয় নির্জন শুনশান চারিদিক কেউ কোথাও নেই, ভেসে আসছে শুধু ঢেউ এর গর্জন। আস্তে আস্তে গায়ের আংরাখাটি খুলে ঈষদুষ্নু জলে নেমে পরলো প্রতিদিনের মত।কোনদিকে মন নেই তার।
সেই জোৎস্নার আলো গায়ে মেখে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে একমনে সাতার কাটছিল সুন্দরী কালেহ।কিন্ত সেদিন সেই জোৎস্না রাতে সে এলাকার হাঙ্গর মাছের রাজা কা-মোহো-আলিও সাতার কাটতে কাটতে পানির অল্প নীচে চলে এসেছিল উদ্দেশ্যহীনভাবে।
হঠাৎ তার চোখে পড়লো অপরূপা এক তরুনী নানান বিভঙ্গে নেচে নেচে সাতার কেটে চলেছে তরঙ্গভঙ্গের সাথে সাথে। প্রথম দেখাতেই সুন্দরী কালেহর রূপে মুগ্ধ হলো হাঙ্গররাজ। তার মনে হলো এমন রূপসী সে কখনো দেখেনি আগে। অস্থির হয়ে উঠলো কা-মোহো তার সাথে একটিবার দেখা করার জন্য।
হাঙ্গর রাজা কা মোহো
অনেক ভেবে ভেবে মোহগ্রস্ত হাঙ্গররাজ পরদিন মানবকন্যা সুন্দরী কালেহ কে খুজতে ডাঙ্গায় এসে হাজির।এক উপজাতীয় নেতার রূপ ধারন করে ওয়াইপোপো উপত্যকায় এসে কা-মোহো খুজতে লাগলো তার আরাধ্য সুন্দরীকে । অবশেষে তার মনের মানুষের সন্ধান পেল।প্রথম দেখার সাথে সাথে কালেহও রূপবান রাজা কা-মোহ এর গভীর প্রেমে পড়লো আর যার পরিনতি হলো তাদের বিয়ে।নেচে গেয়ে বেশ সুখেই কাটছিল তাদের দুজনের দিন।
হাওয়াইএর বিখ্যাত স্থানীয় নৃত্য হুলা হুলা
এরই মধ্যে কালেহ গর্ভবতী হলো।কিন্ত সন্তানের জন্মের আগেই রাজা বুঝতে পারলো ডাঙ্গায় থাকার দিন তার ফুরিয়ে এসেছে। এবার তাকে ফিরে যেতে হবে সাগর জীবনে।সে কখনোই কালেহর কাছে তার সত্য পরিচয় দেয়নি, যাবার সময়ও দিতে মন সরলোনা তার । ফিরে যাবার আগে রাজা কালেহ কে ডেকে বল্লো,
‘প্রিয়া আমার, তোমাকে আজ একটা কথা বলবো’।
“কি কথা বলবে শুনি বলো”?কালেহর উৎসুক প্রশ্ন।
‘কাছে আসো, মন দিয়ে শুনো আর কিছুদিন পর আমাদের যে সন্তান ভুমিষ্ঠ হবে সে হবে পুত্র সন্তান। খেয়াল রেখো তার জন্মের সময় কেউ যেন তোমার আশে পাশে না থাকে’।
কা-মোহ বলতে থাকে।
‘আর একটা জরুরী কথা সবসময় মনে রাখবে’।
“কি জরুরী কথা”! কালেহ উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করে স্বামীকে।
কা-মোহো কালেহর হাত দুটো ধরে বল্লো, 'কালেহ আমাদের সন্তান যেন জীবনেও কখনো কোন প্রানীর মাংস না খায়, এ ব্যাপারে তুমি সবসময় নজর রেখো’।
একথা বলে প্রিয়তমা পত্নীকে না জানিয়ে হাঙ্গর রাজা দুখঃভারাক্রান্ত মন নিয়ে রাতের আধারে চুপিচুপি চিরজনমের মত তার নিজস্ব আবাস সাগরে ফিরে গেল। তাদের আর জীবনে কখনোই দেখা হয়নি। যাক সে কথা।
কিছুদিন পর এলো এক নিকষ কালো অন্ধকার রাত, যে রাতে সারা উপত্যকা ছিল ঝড়ের তান্ডবে অস্থির। সে সময় কালেহর এক পুত্র সন্তান জন্ম নিল।সেই ছেলেকে দেখে কালেহ ভীত আর মর্মাহত হয়ে পড়লো কারণ অপরূপ মুখশ্রী আর সুগঠিত দেহের অধিকারী এই দেবশিশুটির পিঠে ছিল বিরাট গভীর এক গর্ত যা কিনা অনেকটা হা করা মাছের মুখের মত।
বেশ অনেকক্ষন কেঁদেকেটে ধীরে ধীরে উঠে দাড়ালো কালেহ, তারপর তার নির্মম ভাগ্যকে বরণ করে নিল গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।ছেলেটিকে পাতলা একটি কম্বলে পেঁচিয়ে নিল যাতে তার বিকালাঙ্গতা কারো নজরে না পড়ে। নাম রাখলো তার নানাউ।
নানাউ ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে লাগলো। স্বামীর নির্দেশের কথা মনে রেখে কালেহ সবসময় খেয়াল রাখে ছেলে যেন তার মাংস না খায়। কিন্ত সেই প্রাচীন কালে নিয়ম ছিল ছেলে মেয়েরা একটু বড় হলে আলাদা আলাদা খেতে বসার। ফলে নানাউ যখন একটু বড় হলো তখন তার মার পক্ষে তার খাবারের দিকে নজর রাখার আর উপায় থাকলো না।সেসময় একদিন তার দাদা তাকে নিয়ে গেল পুরুষদের সাথে খাবার জন্য। মায়ের নজরের বাইরে খেতে বসে নানাউ সেদিন প্রথম মাংসের স্বাদ পায়।বাধা দেয়ার কেউ নেই,ফলে দারুন স্বাদের সেই মাংস গোগ্রাসে খেতে থাকে নানাউ।আর এই মাংস খাবার সাথে সাথে তার মধ্যে সৃষ্টি করলো ভয়ঙ্গকর এক অতৃপ্ত ক্ষুধার। সেই সাথে তার পিঠের গর্তের দুপাশে সৃষ্টি হলো সারি সারি তীক্ষ দাত যা কিনা হাঙ্গরের মত।
হাঙ্গর রূপী নানাউ
এর কিছুদিন পর কালেহ তাকে নিয়ে গেল স্নান করার জন্য সমুদ্রে।বিস্মিত এবং আতংকিত চোখে সে দেখলো তার পুত্র এক বাচ্চা হাঙ্গরের রূপ ধারন করে সাতার কাটছে আর সাগরের ছোট ছোটা প্রানীগুলোকে ধরে ধরে খাচ্ছে।
নানাউ যখন কিশোর থেকে যুবক হয়ে উঠলো তখন সে পানিতে নামলে এক পরিপুর্ন হাঙ্গরের রূপ ধারন করতো।যখনই সে সমুদ্রে নাইতে যেত তখনই স্নানরত তার সাথীদের কেউ না কেউ সমুদ্রে চিরতরে হারিয়ে যেত।বেচে যাওয়া লোকজন দেখতো সমুদ্র থেকে দানবের মত এক বিশাল হাঙ্গর এসে স্নানরত লোকদের কাউকে না কাউকে ধরে কামড়ে ছিড়ে খুড়ে খেয়ে ফেলছে।
এঘটনায় ওয়াইপোপো বাসীরা আতংকিত হয়ে উঠলো।আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে সন্দেহ দেখা দিল … কি ব্যপার নানাউওতো সবার সাথে সমুদ্র স্নানে যায় কিন্ত সে কেন কখনো আহত হয়না!
নিশ্চয় তার মধ্যে কোন বিশেষ ক্ষমতা আছে।কিন্ত তারা তখনো বুঝতে পারেনি নানাউওই যে সেই মৃত্যু দুতবেশী হাঙ্গর যে কিনা তার বন্ধুদের ছিড়েখুড়ে খাচ্ছে।
একদিন গ্রামবাসী আবিস্কার করলো নানাউর পিঠের লুকিয়ে রাখা সেই হা করা ভয়ংকর গর্ত যার দুপাশে হাঙ্গরের তীক্ষ দাতের সার।তারা বুঝতে পারলো তাদের এই শান্তসিষ্ট সমুদ্রে সকল প্রিয়জনদের মৃত্যুর কারন হলো নানাউ। ক্ষুদ্ধ গ্রামবাসী তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করলো কিন্ত তার আগেই সেটা জেনে নানাউ হাঙ্গরের রূপ ধরে সমুদ্রে পালিয়ে গেল। হাজির হলো আরেক দ্বীপ মাউই তে।
হাওয়াই দীপপুঞ্জের আরেকটি দ্বীপ মাউই
মাউই এসে নানাউ মানুষের রূপ ধারন করে বসবাস করতে লাগলো আর বিয়ে করলো সেখানকারই এক উপজাতি নেতার কন্যাকে। ভালোই দিন কাটছিল নানাউর।মনের গভীরে মানুষের মাংস খাওয়ার প্রচন্ড যে ইচ্ছেটা তা সে দমন করে চলছিল কঠিনভাবে। কিন্ত একদিন আর সে সহ্য করতে পারলোনা। রাত হওয়ার সাথে সাথে সে এক যুবতী মেয়েকে ধরে নিয়ে গেল সমুদ্র তীরে। ধীরে ধীরে সে তার রূপ পরিবর্তন করে হাঙ্গর হয়ে উঠলো আর মেয়েটাকে পাগলের মত ছিড়েখুড়ে খেতে লাগলো।
তাকে যে লোকজন দেখছিল সেটাও তার নজরে আসেনি। গ্রামবাসীরা তার এই রূপ দেখে হতভম্ব হয়ে গেল।ক্রোধান্বিত গ্রামবাসী নৌকায় চেপে বর্শা দিয়ে হত্যা করার জন্য এগিয়ে গেল। কিন্ত নানাউ খুব দ্রুত সাতরে তাদের হাতের নাগাল থেকে পালিয়ে গেল আর উঠলো হাওয়াই আরেকটি দ্বীপ মলোকাই এ।
নানাউকে হত্যার জন্য নৌকা চেপে সমুদ্রে ঝাপিয়ে পরছে গ্রামবাসী
মলোকাই গিয়েও নানাউ তার সত্যিকারের রূপটি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করতে লাগলো প্রানপনে।এদিকে তার যতই বয়স বাড়তে লাগলো ততই তার ক্ষুধাও বেড়ে উঠতে লাগলো ভয়ংকর ভাবে।
এরই মধ্যে হাওয়াই এর সমস্ত দ্বীপগুলোতে এই ভয়ংকর হাঙ্গর মানবের কথা ছড়িয়ে পড়লো।মলোকাই দ্বীপের বাসিন্দারাও এই হাঙ্গর মানবকে ধরার জন্য তীক্ষ দৃষ্টি রাখছিল। অবশেষে একদিন তারা বিস্মিত হয়ে দেখলো তাদের দ্বীপের নতুন বাসিন্দা আকর্ষনীয় যুবক নানাউ আস্তে আস্তে হাঙ্গরের রূপ ধরে সমুদ্রে নামছে।নানাউ ভেবেছিল কেউ তাকে লক্ষ্য করেনি। কিন্ত হায় গ্রামবাসীরা তাকে ঠিকই দেখেছিল আর সেই হাঙ্গররূপী নানাউকে লাঠি দিয়ে পিটাতে পিটাতে সমুদ্রের পানিকে রক্তাত করে তুলেছিল যতক্ষন না সে দুর্বল হয়ে পড়ে।
এরপর দ্বীপবাসীরা তার আহত ক্ষত বিক্ষত দেহটাকে তীরে টেনে নিয়ে এসে টুকরো টুকরো করে কেটে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেল্ল যাতে সে আর কোনো রূপ ধারণ করেই ফিরে না আসতে পারে।
এভাবেই করুন পরিসমাপ্তি ঘটলো হাঙ্গর রাজা কা-মোহো-আলি আর সুন্দরী কালেহর ছেলে নানাউর জীবন।
ছবি এবং গল্প নেট থেকে সংগৃহীত,অনুবাদ মাহজাবীন জুন
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১২:২৭