নটরাজ মন্দির, চিদাম্বরম, তামিলনাড়ু।
বহুবার দেখা তাজমহল আর লালকেল্লা নিয়ে নয়, আজ তুলে ধরছি দক্ষিন ভারতের কিছু মন্দিরের ছবি আমার মতন এক নগন্য পর্যটকের দেখা চোখে। পোস্ট লিখতে গিয়ে ভাবলাম কত ইতিহাস আর ঐতিহ্য যা লিখতে গেলে এক বিশাল বই হয়ে যাবে, যা লেখা আমার মত এক অজ্ঞজনের কাজ নয় ।
তাই আমাদের তোলা ভালোলাগা অজস্র ছবি থেকে অল্প কিছু তুলে ধরলাম। সাথে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।
গোলাকুন্ডা দুর্গ
ভারতের হায়দারাবাদ থেকে ১১ কিমি দুরে ধ্বংসপ্রাপ্ত গোলাকুন্ডা দুর্গ শহরটি তেরোশ শতাব্দীতে কাকাতিয় রাজবংশের হাতে প্রথম পত্তন হয়।পরবর্তীতে ষোড়শ শতাব্দীতে কুতুবশাহী সুলতানের আমলে গোলাকুন্ডা গৌরবের চরম শিখরে আরোহন করে।
৩০০ ফিট উচুতে গ্রানাইট পাথরের উপর নির্মিত এই শহর ১৬৪৭ খৃস্টাব্দে আওরংজেবের হাতে পরাজিত হয়ে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এক সময় এই শহরটি হীরা কেনা বেচার প্রধান কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।
পৃথিবী বিখ্যাত হীরা দরিয়া ই নুর এবং হোপ এই গোলাকুন্ডা খনি থেকেই উত্তোলন করা হয়।
গোলাকুন্ডার বিখ্যাত কুতুবশাহী সমাধি সৌধ
গোলাকুন্ডা দুর্গ থেকে এক কিমি দুরত্বে তৈরী প্রাচীন এই সৌধগুলো কুতুবশাহী সুলতানদের সমাধি সৌধ। একটু উচু জায়গায় নির্মিত এক গম্বুজ বিশিস্ট সৌধগুলোয় পারস্য, পাঠান আর হিন্দু স্হাপত্য কলার সংমিশ্রন লক্ষ্য করা যায়। গম্বুজগুলো এক সময় নীল ও সবুজ টালি দিয়ে আবৃত ছিল যার কিছু কিছু মাত্র অবশিস্ট আছে , খেয়াল না করলে বোঝার উপায় নেই। ঐতিহাসিক এই সৌধগুলো বর্তমানে রক্ষনাবেক্ষনের অভাব সুস্পস্টই লক্ষ্যনীয়।
হায়দরাবাদ শহরের বিখ্যাত চারমিনার।
পন্চম সুলতান মোঃ কুলি কুতুব শাহ গোলাকুন্ডা থেকে রাজধানী সরিয়ে হায়দরাবাদে নিয়ে আসার পর সেখানে ভয়াবহ প্লেগ দেখা দিয়েছিল। ১৫৯১ খৃঃ সম্পুর্ন ভাবে শহর থেকে প্লেগ নির্মুল হওয়ার পর সে বছরই তিনি সৃস্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা চিন্হ স্বরূপ শহরের কেন্দ্রে চারমিনার মসজিদটি তৈরী করেন।
এক দম চৌকোনা অপরূপ স্হাপত্যশৈলী চারমিনারের প্রতিটি দিকই দৈর্ঘ্যে ২০ মিটার করে। এর চার স্তর বিশিস্ট সুদৃশ্য মিনারগুলো উচ্চতায় মাটি থেকে ৪৯ মিটার। ১৪৯ টা সিড়ি ভেঙ্গে একদম উপরে উঠলে পুরো শহরটি চোখের সামনে ভেসে উঠে। এই মিনারটির চারদিকে চারটি বিশাল খিলান রয়েছে যা ১১ মিটার চওড়া এবং ২০ মিটার উচু। খিলানগুলোর উপরে দুটো তালা রয়েছে। সর্বোচ্চ তালাটি মসজিদ। গ্রানাইট, চুনাপাথর এবং মার্বলে তৈরী এই চারমিনার সত্যি দেখার মত, বিশেষ করে রাতের বেলা।
হায়দরাবাদের নিজামস প্যালেস
হায়দরাবাদের শাসক নিজামরা অনেকগুলো প্রাসাদ তৈরী করেন । তার মধ্যে চৌমহলা নামে এ প্রাসাদটি অন্যতম।
চার মহল বিশিস্ট এই প্রাসাদটি হায়দারাবাদের নিজামদের সরকারী বাসভবন ছিল। রাজকীয় যত জাকজমক পুর্ন অনুস্ঠান এখানেই এ প্রাসাদেই অনুস্ঠিত হতো।১৭৫০-১৮৫৭ সালের মধ্যে তৈরী এই প্রাসাদটি ইরানের শাহের প্রাসাদের আদলে তৈরী বলে আমাদের গাইড জানালো।
এখানে আমরা নিজামদের ব্যাবহার করা অনেক দামী দামী জিনিস দেখলাম তার মধ্যে গাড়ী অন্যতম। ছবি তোলা নিষেধ, তবুও চুরি করে রোলস রয়েসের সামনে একটা ছবি তুলেছে আমার বোন, দেয়ার সাহস পেলাম না। ৪৫ একর জায়গা জুড়ে তৈরী এই প্রাসাদটির চারিদিকে বর্তমানে ১৪ একর জায়গা অবশিস্ট আছে।
বিখ্যাত মাইশোর প্যালেস
দক্ষিন ভারতের মহীশুরের বিখ্যাত রাজবংশ ওয়াদিয়া রাজাদের প্রাসাদ। ১৫৭৪ সনে এর প্রথম এর নির্মান কাজ শুরু হয়। পরে ইন্দো-সারাসিনিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্হাপত্যকলার সংমিশ্রনে তৈরী এই প্রাসাদ ইংরেজ স্হপতি হেনরী আরউইন ১৯১২ সালে শেষ করেন।
বিশাল বাগান বেস্টিত ধুসর গ্রানাইট আর গোলাপী মার্বেলের গম্বুজে তৈরী অত্যন্ত আকর্ষনীয় এই প্রাসাদটি তাজমহলের পরেই পর্যটকদের কাছে প্রধান আকর্ষনের কেন্দ্র। ভেতরে চাকচিক্যময় দরবার হলগুলোতে অপরূপ ঝাড়বাতি, আর বিভিন্ন নামকরা শিল্পীর হাতে আঁকা সুদৃশ্য ছবিতে শোভিত। দীর্ঘ কলামের সারি আর অসাধারন ডিজাইনে নির্মিত সিড়িগুলো দেখার মত।
এটা বর্তমানে মিউজিয়াম এবং যথারীতি ছবি তোলা নিষেধ। তাদের ব্যাবহার করা অনেক দামী জিনিস এখানে সংরক্ষিত আছে। এটা ছিল তাদের প্রশাসনিক বাসভবন। এর পেছনের অংশে এখনও তাদের বংশধরেরা বসবাস করে। সেখানে আমাদের প্রবেশ নিষেধ।
আমরা এই অপরূপ প্রাসাদ এবং মহীশুরের সৌন্দর্য্যের কাছে পরাভূত হয়ে ২ দিন বেশী থাকলাম।
কেশভা মন্দির বা চানক্যসেবা মন্দির,হাসান,কর্নাটক
ব্যাংগালোর থেকে হাসান প্রদেশের দুরত্ব ২২২ কিমি । সেখানকার হয়সলা স্হাপত্যকলা আর ভাস্কর্যের অপুর্ব ও অনন্যসাধারণ নিদর্শন স্বচক্ষে দেখার জন্য ব্যাংগালোর থেকে রওনা হোলাম সকালে সড়ক পথে আরামদায়ক বাসে করে।
হাসান থেকে ৩৮কিমি দুরে প্রাচীন রাজধানী বেলুড়ের উল্লেখযোগ্য কেশভা টেম্পল যা চানক্যসেবা মন্দির নামেও সুপরিচিত। অপরূপ কারকার্য খচিত এই মন্দিরটি হয়সলা স্হাপত্যকলার এক চুড়ান্ত নিদর্শন।পাথরের মধ্যে অপরুপ ঝালরের কারুকাজ আর বিভিন্ন প্রানীর মুর্তিতে শোভিত মন্দিরটি সত্যি মুগ্ধ হয়ে দেখার মত।এই মন্দিরটি চোলাদের (একটি জাতি) উপর হয়সলাদের বিজয়ের প্রতীক হিসেবে নির্মিত। রাজা বিষনু বর্ধনের আদেশে ১০৩ বছর ধরে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল।
হয়সলাভেরা মন্দির, হেলেবিদ, কর্নাটক
এই মন্দিরটিও হাসান থেকে ৩১ কিমি আর বেলুড় থেকে ১৬ কিমি দুরে হেলেবিদে, পর্যটকদের প্রধান আকর্ষনের একটি কেন্দ্র। ১২শ শতাব্দীতে এই মন্দিরের কাজ শুরু হয় এবং ৯০ বছর ধরে এর নির্মান কাজ চলে। চারিদিকে বাগান ঘেরা তারকা আকৃতি বিশিস্ট সুক্ষ কারুকাজ করা এই মন্দিরের গায়ে শিল্পীরা অনেক দেব, দেবী, প্রানী এবং নর্তকীদের নৃত্য কলার মোহনীয় ভজ্ঞিমা ছাড়াও রামায়ন মহা ভারতের পৌরানিক কাহিনীগুলো অপরূপ ভাস্কর্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছে।
মীনাক্ষী মন্দিরে ঢোকার পিরামিড আকৃতির গেট যাকে বলা হয়ে থাকে গোপুরাম
তামিলনাড়ুর অত্যন্ত মর্যাদাশালী শহর মাদুরাই। এটি মন্দিরের শহর বলেও সুপরিচিত। চেন্নাই থেকে সারারাত বাস জার্নি করে আমরা যখন ভোররাতে মাদুরাই প্রবেশ করি তার বহু আগে থেকেই শহরের মাঝ বরাবর টানা লম্বা গাছপালাহীন ন্যাড়া লালচে মাটির অর্ধচন্দ্রাকৃতি এক অদ্ভুত আকৃতির পাহাড় আমাদের সংগী হয়েছিল।
শৈল শহর কোদাই কানাল, কন্যাকুমারী, রামেশ্বরম ঘুরতে হলে মাদুরাই কেই কেন্দ্র করে ঘুরতে সুবিধা হয়। আমরাও ওসব জায়গায় যাবো বলে প্রোগ্রাম করা।
মাদুরাই যেহেতু মন্দিরের শহর সুতরাং এখানকার প্রধান ট্যুরিস্ট আকর্ষনই মন্দির। এখানকার বিখ্যাত এবং সবচেয়ে বড় মন্দিরটির নাম মীনাক্ষী মন্দির যা শিব ও পার্বতী তথা মীনাক্ষীকে উৎসর্গ করে তৈরী।
৪৫ একর জায়গা জুড়ে এই মন্দিরটি নির্মান করেন প্রথম পান্ডেয় রাজা।
এখানকার স্হাপত্য কলার একটি বৈশিস্ট হলো গোপুরাম গুলোতে যে পাথরে খোদাই করা অপরূপ ভাস্কর্য তা সবই বিভিন্ন রংগে রংগীন।ভাস্কর্যগুলোতে রামায়নের কাহীনি বর্নিত আছে।
১২টি গোপুরাম অর্থাৎ গেটের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫২ মিটার উচু গেট টি দক্ষিন দিকে অবস্থিত। ১২টির মধ্যে ৫টি সুবিশাল, সুউচ্চ গেট শহরের যে কোনো প্রান্ত থেকে দেখা যায়।
এখানে একটি মিউজিয়ামও আছে যাতে মন্দির ও সেখানকার দেবদেবীদের ইতিহাস ও ভাস্কর্যে ভরা। এ মন্দিরের অভ্যন্তরে কিছু অংশ বাদ দিয়ে সবখানেই পর্যটকদের ঘুরে দেখার অনুমতি আছে। নোটিশ টা খেয়াল না করায় আমি প্রথমে ঢুকে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম মুসলিম বলে , তারপর দেখলাম ভেতরে প্রচুর সাদা চামড়ার ট্যুরিস্ট ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ছবিগুলো আমার বোন শাহনাজ মুনিরের তোলা।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মার্চ, ২০১২ সকাল ৮:৫৯