শান্ত শিষ্ট তবে ভীষন হাসি খুশী ছোট্ট একটি মেয়ে । সে সময় ঐ মেয়েটির জীবন ছিল এখনকার মেয়েদের চেয়ে অনেক অন্যরকম। গ্রীলের খাচায় আবদ্ধ ফ্ল্যাটে বা স্কুল, কোচিং, বাসার টিচার আর কম্পিউটারে বন্দী জীবন তার নয়। মুক্ত বাতাসে খোলা মাঠে পনি টেল করে দৌড়াদৌড়ি আর বান্ধবীদের সাথে হাড়ি পাতিল, পুতুল খেলে দিন কেটেছে তার।
আর একটু বড় যখন হলো সে, বার তেরো বছর বয়স তখনও কোনো জটিলতা নেই জীবনে। মর্নিং শিফটের স্কুল ১২টায় শেষ। বিকেলে বাসার আশে পাশে খোলা মাঠে ভাইবোনদের সাথে রুমাল চুরি, গোল্লাছুট ,কানামাছি আর শীতের দিনে ব্যাডমিন্টন, সেই সাথে কিছু ছেলেদের খেলা যেমন: মার্বেল, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি। এই ছিলো আমার কৈশোর জীবন।
আর এরই সাথে কিছু দিন চলেছিল আমার সাহিত্যচর্চা !
এবার সেই আসল প্রসঙ্গেই আসি।
আমার মা এর আপন এবং কাজিন ভাই বোনদের সবার ঢাকায় একই এলাকায় পাশাপাশি প্লটে বাড়ি। সুতরাং আমরা কাজিনরা ই ছিলাম কাছাকাছি বয়সের বিশাল এক বাহীনি। এর ফলে ছোটো বেলায় আমাদের বাইরের কারো সাথে বন্ধুত্ব খুব কমই হয়েছিল।
কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন এর সাথে ব্লগের এক বছর পূর্তির কি সম্পর্ক!!
বলছিঃ
আমার এক মামাতো ভাই ছিল আমাদের লীডার, সেন্ট জোসেফ স্কুলে ক্লাশ টেনের ছাত্র। সে একটি এ্যসোসিয়েশনই করেছিল আমাদের নিয়ে, নাম ছিল 'কাজিন এ্যসোসিয়েশন'।
ভাইটি ছিল প্রচন্ড সংস্কৃত মনা, যার ফলশ্রুতি ছিল হাতে লিখে একটি পত্রিকা বের করা যা সে তার বাবা অর্থাৎ আমার মামার অফিস থেকে কয়েকটা কপি প্রিন্ট করে আনতো। আর তার লেখক ছিলাম আমরা কাজিনরা । বাইরের কোনো লেখকেরই সেখানে প্রবেশাধিকার ছিলনা। সে যত উচ্চমানের লেখকই হোক না কেন !
পত্রিকার একটা গালভারী নাম ছিল, দ্যা ক্রনিক্যাল। সেখানে কাজিনরা ইংরাজী বাংলা যে যা ভাষা পারতো তাতেই লিখতো। আর আমাদের মামা খালাদের কাছে ওটা বিক্রী (অর্থাৎ ঈষৎ জোরপুর্বক ) করা হতো পরবর্তী সংখ্যার খরচ যোগানোর জন্য !
সে ক্রনিক্যালেই আমার জীবনের প্রথম লেখালেখির (সাহিত্য চর্চার) হাতে খড়ি।
আমাদের লেখা দেখে আমাদের আত্মীয়স্বজনরা কি যে উচ্চ প্রশংসা করতো বলার নয়! এখন মনে হলেও হাসি পায়।
আমরা লেখকরা সবাই ছিলাম বয়সে সাত থেকে ষোলোর মধ্যে। এখনকার দিনের অধিকাংশ বাচ্চাদের মত এত জ্ঞানী ছিলাম না। আমাদের সেই অজস্র বানান ভুল আর (অ) খাদ্য লেখাকেই আমরা ভাবতাম রবীন্দ্রনাথ নজরুলের সমপর্যায়ের এবং সকল প্রকার ত্রুটির উর্দ্ধে।
সম্পাদক মামাতো ভাই যদি কাউকে ডেকে নিয়ে কারো লেখায় ইষৎ ভুল ধরতো, সাথে সাথে লেখক অত্যন্ত অভিমান ভরে অশ্রসজল চোখে পান্ডুলিপিটি তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এক ছুটে বাসায় প্রস্হান।
আর সম্পাদকও অনতিবিলম্বে পিছু পিছু দৌড়ে তার বাসায় গিয়ে অভিমানী লেখকের বাবা মা কে ধরে, চোখ ফুলে যাওয়া লেখক কে অনেক অনুরোধ উপরোধ করে সেই অতি উচ্চমানের লেখাটি ছাপানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতো। ভবিষ্যত প্রতিভা বসু আর সমরেশ মজুমদারের মুখে হাসি ফুটে উঠতো!
কিন্ত পরিতাপের বিষয় তিন সংখ্যার বেশী আমাদের সেই পত্রিকাটি চলেনি। কারন আমাদের ধৈর্য্যহীন সম্পাদকের দ্রুতই ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলো!
ছেলেপুলে নিয়ে কারবার, এত তাড়াতাড়ি ধৈর্য্যহীন হলে কি চলে !
যাই হোক এই পত্রিকার মৃত্যুর সাথে সাথে আমারও লেখক জীবনেরও ইতি ঘটলো।
তবে আমার ডায়রী লেখার নেশা ছিল আর পুরোনো খাতার পিছনের পাতায় ছাপার অযোগ্য কিছু কিছু সাহিত্য চর্চাও চলতো গোপনে।
চীন
বছর দু এক আগের কথা, চীন বেড়াতে গিয়েছি। আমরা যে হোটেলে ছিলাম ওখানে অনেক ট্যুরিস্ট ছিল, যাদের সাথে দু এক দিনের মধ্যেই আমাদের মোটামুটি একটা সু- সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ।
কারন প্রতিদিন সকালে বের হওয়ার আগে নাস্তায় আর রাতে ফিরে ডিনারে হোটেলের রেস্তোরায় বেশ কয়েকজনের সাথে নিয়মিত দেখা হতো, সাথে 'হাই, হ্যালো'।
সেখানে এক বৃটিশ দম্পতি কে দেখতাম সবসময় ল্যাপটপে কি যেন লিখতো। অনেকে দেখতো। মাঝে মাঝে হোটেলের হাশিখুশী ম্যানেজারটাও উকিঝুকি দিত তাদের মনিটরে।
একদিন জানতে চাইলাম 'কি লিখছো তুমি'
বল্লো 'ব্লগ'
সেটা কি জিনিস!
"এটা একটা ডায়েরীর মত"।
'তাই!'
আমরাও দেখলাম উনি কি ভাবে লিখছেন সাথে ছবি দিয়ে দিয়ে ইংরাজীতে।
মনের ভেতর কেমন করে উঠলো, ভাবলাম আমি যদি এমন করে লিখতে পারতাম কোথাও। কিন্ত ইংলিশ মোটামুটি পারলেও মনের ভাব ফুটিয়ে তো আর লিখতে পারবো না। ভাবতেই মনটা দমে গেল।
ঢাকা
চীন থেকে ফেরার পর এক রাত, আমার স্বামী তার স্টাডি রুমে যথারীতি আমার সতীন ল্যাপটপের সামনে।
হটাৎ আমাকে ডেকে বল্লো ' জুন এদিকে আসো তাড়াতাড়ি'।
দৌড়ে গেলাম, বল্লো, 'দ্যাখো বাংলায় লেখার একটা ব্লগ আছে সামহ্যোয়ার ইন, কি সুন্দর সবাই লিখছে, লিখবে এখানে তুমি?'।
সে জানতো আমার খুব লেখার শখ।
আমিও দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আমিও জানতাম না এত সুন্দর একটা প্ল্যাটফর্মের কথা।
'তোমাকে রেজিস্ট্রেশন করে দেই, লেখো এখানে! '
আমি ভয়ে ভয়ে বল্লাম 'আমি কি পারবো সবার মত এত সুন্দর করে লিখতে! সবার কি সুন্দর লেখা!'
ও বল্লো 'যা পারো তাই লিখবে তোমার খুশী মত। এখানে বেশীরভাগই তো সৌখিন লেখক আর তুমিও তো আর কোনো বিশাল সাহিত্যিক নও'।
২০শে ফেব্রুয়ারী সামুতে আমার যাত্রা হলো শুরু
২০শে ফেব্রুয়ারী রাত ১০.৫০ এ সামুতে ছাপা হওয়া অসংখ্য ভুলে ভরা আমার প্রথম পোষ্টের প্রথম পাঠক ছিলেন মুকুট বিহীন সম্রাট । প্রথম মন্তব্য করেছিল সেদিনই রাত ১১.১৩ মিনিটে। সেই তখন থেকে আজও এই ভাইটি আমার প্রতিটি লেখায় মন্তব্য করে উৎসাহ যুগিয়ে আসছে।
এর পর সামুর অজস্র ব্লগার যারা প্রত্যেকে আমার অত্যন্ত প্রিয়, যাদের নাম লিখলেই একটা পোষ্ট হয়ে যাবে, তাদের উৎসাহ আর অনুপ্রেরণা ছাড়া অনেক আগেই বন্ধ হয়ে যেত আমার পথ চলা। তারা তাদের অতি মুল্যবান সময় নষ্ট করে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে আমার পাঠের অযোগ্য লেখাগুলো পড়ে ধৈর্য্যের সাথে মন্তব্য করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন, ভুল ত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিয়েছেন, ছবি যুক্ত করার কৌশল শিখিয়েছেন। লেখার মান বাড়ানোর জন্য কি কি করা উচিৎ তাও বলেছেন ।
এদের সবার অনুপ্রেরণা আর ভালোবাসায় আমি একটি বছর সামুতে অতিবাহিত করলাম যা আমার জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ বছর।এদের সকলের কাছে আমি ঋনী। সামান্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাদের আমি ছোটো করতে চাইনা। তাদের প্রতি রইলো আমার অকৃত্রিম গভীর ভালোবাসা ও শুভকামনা।
আর সব শেষে প্রিয় সামহ্যোয়ার ইনকে ও আমার অসংখ্য ধন্যবাদ আমার অনেক দিনের মনের লালিত একটি সুপ্ত বাসনা পুরণের ব্যবস্হা করে দেয়ার জন্য।
ব্লগ পরিসংখ্যানঃ
পোস্ট করেছেন: ৮০টি
মন্তব্য করেছেন: ৮১৯৮টি
মন্তব্য পেয়েছেন: ৮০৪২টি
ব্লগ লিখেছেন: ১১ মাস ৪ সপ্তাহ
ব্লগটি মোট ৬১৫১৬ বার দেখা হয়েছে
ব্লগে আমার প্রথম লেখা
Click This Link
ছবি দুটো নেটের সৌজন্যে।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১১ দুপুর ২:২১