হাজার বছর ধরে বয়ে যাওয়া নীল
পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার লীলাভুমি মিশর, যাকে বলা হয় সভ্যতার সুতিকাগার। সমসাময়িক প্রাচীন মেসোপোটেমিয়া, ভারত এবং চীনা সভ্যতার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম এই সভ্যতা সূচীত হয়েছিল আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর পুর্ব কোনে অবস্হিত মিশরে, আজ থেকে সাত হাজার বছর আগে সে দেশের প্রান নীল নদের তীর ঘেষে। বিশাল তাদের ইতিহাস।বিশাল তার ব্যাপ্তি।
তবে আমি খুবই সংক্ষিপ্ত ভাবে এবং কাঁচা হতে আপনাদের সামনে সেই ইতিহাস তুলে ধরার চেস্টা করছি। আমার সাম্প্রতিক মিশর ভ্রমনই এ লেখার অনুপ্রেরনা।
প্রাচীনকালে তুষার যুগের অবসানের পর আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গায় মরুকরণ শুরু হয়।সে সময় ৭০০০ খৃঃপুঃ যাযাবর আফ্রিকানরা নিরন্তর বয়ে যাওয়া স্হায়ী পানির উৎস নীল নদের দু পাশে এসে বসতি স্হাপন শুরু করে।আস্তে আস্তে তারা কৃষি ও পশুপালনে অভ্যস্হ হয়ে উঠে।পরবর্তীতে তারা দক্ষতা অর্জন করে কাপড় বোনা আর মাটির পাত্র তৈরীতে। এর পর হাতিয়ার তৈরীতে পাথরের বদলে শুরু করেছিল বিভিন্ন খনিজ দ্রব্যের ব্যবহার যেমন ব্রোন্জ, পরবর্তীতে তামা ও আরো মুল্যবান খনিজ দ্রব্য। এটা তাদের সভ্যতার উন্নয়নে রেখেছিল এক বিশেষ উল্লেখযোগ্য অবদান।
কায়রোর জাতীয় যাদুঘরের সামনে একটি ভাস্কর্য থেকে তোলা প্রাচীন মিশরীয় হস্তলিপি অর্থাৎ হায়েরোগ্লিফিক
মিশরীয় সভ্যতার আরেকটি মাইলফলক ছিল তাদের বর্নমালা। আজ থেকে তিন হাজার দুইশ বছর আগে প্রাচীন মিশরীয়রা উদ্ভাবন করেছিল ছবির মাধ্যমে লেখা বর্নমালা বা হস্তলিপি যা হায়েরোগ্লিফিক নামে পরিচিত।কমপক্ষে সাতশ চিন্হ দিয়ে লেখা প্রাচীনতম এই বর্নমালা যা আজও বিশ্বের এক বিস্ময়। নীলনদের তীরে জন্মানো এক রকম নলখাগড়া দিয়ে তৈরী কাগজ প্যাপিরাস ছাড়াও মাটির পাত্র ও বিভিন্ন পাথরে খোদাই করে লেখা হতো এই হস্তলিপি।
রাজা মেনেস ( আনুমানিক রাজত্বকাল ৩১০০-২৮৫০ খৃঃপুঃ)
প্রাচীন মিশরে প্রথম যে উল্লেখযোগ্য রাজার নাম শোনা যায় তিনি হলেন মেনেস।তিনি ছিলেন প্রথম রাজবংশের প্রথম রাজা। সে সময় উত্তর ও দক্ষিন দু ভাগে বিভক্ত মিশরকে একত্রিত করে তিনি কায়রো থেকে ১২ কিমি দক্ষিনে মেমফীসে তার রাজধানী প্রতিস্ঠা করেন।
প্রাচীন রাজধানী মেফফীসের একটি অংশ
সে সময় মিশরের সমাজ ব্যাবস্হা ছিল অত্যন্ত উন্নত ও সুসংগঠিত। প্রশাসনিক ভাবে পুরো দেশটি ছিল ৪২ টি ভাগে বিভক্ত।এগুলোকে বলা হতো নোমোস। বিভাগীয় শাসনকর্তাদের বলা হতো নোমার্ক।
মিশরীয় কৃষকরা তাদের উৎপন্ন ফসলের একটি অংশ সরকারকে খাজনা হিসেবে দিত।
সে সময় মিশরীয় রাজাদের বেশীরভাগ চিন্তা ভাবনাই ছিল পরলৌকিক জগৎ কে কেন্দ্র করে।মৃত্যুর পরও তাদের দেহ যেন অবিকৃত এবং অক্ষত অবস্থায় মৃত্যুর দেবতার সামনে উপস্হিত থাকতে পারে সেই ভাবনার ফলশ্রুতিতেই তারা তাদের শবদেহ কে সংরক্ষন যা মমি নামে পরিচিত ও সমাধি সৌধ হিসেবে পিরামিডের নির্মান শুরু করেন। মিশরে নির্মিত প্রথম পিরামিড যেটা ধাপ বিশিস্ট ছিল, সেটা তৈরী করেছিলেন রাজা জেসর।এটি নির্মিত হয়েছিল ২৬৬৫ খৃস্টপুর্বে গিজার অল্পদুরে সাক্কারায়।
সাক্কারায় জেসরের তৈরী প্রথম ধাপ বিশিষ্ট পিরামিড
রাজা স্নেফ্রু ( ২৬১৪-২৫০২ খৃঃপুঃ)
এরপর ক্ষমতায় আসেন চতুর্থ রাজবংশের প্রতিস্ঠাতা স্নেফ্রু। তিনি চব্বিশ বছর ক্ষমতায় ছিলেন।তার রাজত্বকালে অনেক অনেক বড় বড় অভিযান পরিচালিত হয়। তার সময়ই সিনাই উপদ্বীপ স্হায়ীভাবে মিশরের অন্তর্ভুক্ত হয়।সে সময় অনেক মন্দির দুর্গ প্রাসাদ তৈরী হয় ,তবে তিনি বিখ্যাত ছিলেন দাশরে দুটো পিরামিড নির্মান করে।
দাশরে স্নেফ্রুর তৈরী দুটো পিরামিডের একটি
রাজা খুফু বা চিয়পস (২৫৯০-২৫৬৮খৃঃপুঃ)
স্নেফ্রুর মৃত্যুর পর মিশরের সিংহাসনে বসেন তার ছেলে খুফু। পুরোনো রাজত্বকালের রাজাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ছিল রাজা খুফু। ধারনা করা হয় স্নেফ্রুর কোনো পরিত্যক্ত রানীর পুত্র ছিলেন তিনি।চারিত্রিক দিক দিয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠুর এবং নির্দয় খুফু ছিলেন তার পিতা স্নেফ্রুর সম্পুর্ন বিপরীত।
খুফু তার পিতার কাছ থেকে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী একটি রাজত্ব লাভ করেছিলেন।কিন্ত তার ২৬ বছর রাজত্ব কালের বেশীরভাগ সময় আর উত্তরাধিকারী সুত্রে পাওয়া বিশাল সম্পদ তিনি ব্যয় করেছিলেন পিরামিড নির্মানে।অত্যন্ত সুকৌশলে নির্মিত গিজার এই পিরামিডগুলো আজও মানুষের মনে কৌতুহল সৃস্টি করে চলেছে।
গিজায় রাজা খুফুর তৈরী পিরামিড ও স্ফিংকস
দু:খের বিষয় একশ পয়তাল্লিশ মিটার উচ্চতার এই বিশাল ও বিস্ময়কর পিরামিডের স্রস্টার এ পর্যন্ত একটি মাত্র ৯ সে:মি: উচ্চতার মুর্তি পাওয়া গিয়েছে এ্যবিডসে দেবতা ওসিরিজের মন্দিরে। এটা বর্তমানে কায়রোর জাতীয় যাদুঘরে সুরক্ষিত আছে । ।
রাজা খুফুর একমাত্র মুর্তি
অন্তর্বর্তী যুগ (২১৮০-২০৫২ খৃঃপুঃ)
মিশরীয় ইতিহাসের প্রথম পর্ব যা পুরোনো রাজত্ব নামে পরিচিত ছিল তার অবসান ঘটে ২১৮১ খৃস্ট পুর্বে। এ সময় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়েছিল যার ফলে মিশর কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়, এবং একে অন্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
মিশরের ইতিহাসে অরাজকতার এই যুগটিকে প্রথম অন্তর্বর্তী যুগ বলা হয়ে থাকে যা বিস্তৃত ছিল ২০৫৫ খৃস্টপুর্ব পর্যন্ত।
চলবে
ছবিগুলো আমার নিজের হাতে তোলা।
লেখকঃ মাহজাবীন জুন।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ৯:৪৮