
সকাল দশটা, গল্পটা প্রায় শেষের দিকে, মনোযোগ দিয়ে লিখে যাচ্ছি, ... তখনই ইয়াহু মেসেন্জারের জানালাটা খুলে গেল ঠাস করে .....
নাইম এসেছে জানালায়....
নাইমঃ হাই...
উন্মনাঃ হাই...
নাঃ কি খবর?
উঃ ভালো.. তোমার ?
নাঃ এইতো চলছে একরকম।
উঃ কই তুমি ?
নাঃ অফিসে ঢুকলাম মাত্র...
উঃ ও আচ্ছা তাই নাকি ...জানো নাইম আমি না একটা গল্প লিখছি.....
কি যে এক নেশায় ধরেছে আমাকে ! আমি নিজেই অবাক হয়ে যাই!
তাহলো গল্প লেখা..আর কোনো কিছুই লিখতে ইচ্ছে করেনা আমার।
সবাই কত কিছু লিখে, কবিতা, প্রবন্ধ, কৌতুক, কিছুই আমার মনকে টানেনা। গল্পের ভেতর সবার চরিত্রগুলো একে একে পরতে পরতে খুলে খুলে আসে, ভারী ভালোলাগে আমার।
সকাল বেলা সব কাজ সেরে পিসির সামনে বসাটা যেন ফরজ হয়ে দাড়িয়েছে। স্বামী অফিসে, ছেলে মেয়ে দুটো স্কুলে, বুয়া কাজ করে যাচ্ছে নির্দেশ মত।আর আমার অখন্ড অবসর।
ওহ্ আমার নামটাই তো বলিনি, আমার নাম উন্মনা।
জন্মের আগেই মা ঠিক করে রেখেছিল মেয়ে হলে নাম রাখবে উন্মনা ।
কি অদ্ভুত নাম তাইনা ! এমনটি আর শুনিনি কোথাও।
আমি যে গল্পটা লিখছি সে গল্পের নায়কের নাম রাফি ...সে থাকে সুদুর আমেরিকায় ।
বাবা মার তিন সন্তানের মধ্যে অনেক প্রিয়...পড়তে গিয়েছিল আর দশটা বড়লোকের ছেলে মেয়েদের মত...পাশ করে এখন চাকুরী করছে সেখানকার এক নামকরা ফার্মে । তার বিয়ের জন্য তার বাবা মা উতলা... .
সকাল ১১টা
নাইমঃ আছো ...
উন্মনাঃ আছি...
নাঃ কি করছো ?
উঃ তোমাকে তখন বল্লাম না আমি একটা গল্প লিখছি ...
নাঃ ওহ তাইতো !! ভালো..।
উঃ শুনছো নাইম .. একটা কথা শোনোনা ....
নাঃ দাড়াও এক মিনিট....
অনেকক্ষন নাইমের কোনো সাড়াশব্দ নেই ...যাক গল্পটা লিখে শেষ করি...
বাবা মা অনেকদিন থেকেই চাচ্ছে রাফির বিয়ে দিয়ে তাকে সেটল্ করাতে। বিদেশ বিভুঁই একা একা থাকে। কিন্ত ছেলের একটাই ডিমান্ড শুধু মেয়ে নয়, মেয়ের বাবা মা কেও শিক্ষিত হতে হবে...কি আশ্চর্যের কথা...
রাফির কথা হলো...
সকাল ১১.৩০
নাইমঃ আছোতো !!...
উন্মনাঃ আছি...
নাঃ আর বোলোনা একটু বিজি হয়ে গিয়েছিলাম...
উঃ তাই নাকি ! থাক্ তাহলে তুমি কাজ করো....আমি যাই।
নাঃ না না যেওনা উন্মনা, থাকোনা একটুখানি ...কাজের ফাকে ফাকেই তোমার সাথে টুকটাক কথা বলি...
উঃ আচ্ছা ঠিক আছে ....কি কাজ করছো বলোতো!
নাঃ এইতো ষ্টাফদের একটা সিডিউল তৈরী করছি...
উঃ ওহ্
একবার ইয়াহুর জানালায় নাইম ইজ রাইটিং লেখাটা ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল। কই গেল সে কে জানে...আজ গল্পটা শেষ করতেই হবে আমাকে....
রাফির কথা হলো আমার মা যদি ১৯৬২ সালে ঢা বি থেকে অনার্স সহ মাষ্টার্স করতে পারে তবে এখন পাবোনা কেন!
বেশী সুন্দরী রূপসী ও তার চাহিদা নয়। বাবা মা পাগলের মত সবাইকে অনুরোধ করছে । তাদের ও বয়স হয়েছে কত রকম অসুখ বিসুখে ধরেছে...
দুপুর ১২টা:
নাইমঃ উন্মনা আছো ....
উন্মনাঃ হ্যা আছি...
নাঃ রান্না শেষ ?
উঃ হু ...
নাঃ আজ মেনু কি তোমার ???
উঃ চিংড়ী মাছ দিয়ে করল্লা ভাজি, কই মাছ , বাচ্চাদের জন্য মুরগী আর ঘন ডাল।
নাঃ তাই নাকি খুব মজাতো ... তা কই মাছ কি দোঁপেয়াজা করেছো উন্মনা ?
উঃ না ফুলকপি আর মটরশুটি দিয়ে ঝোল।
নাঃ দারুন ,তবে কই মাছের দোঁপেয়াজাটা কিন্ত আমার খুব ভালো লাগে, একটু ধনেপাতা দিয়ে....
উঃ আমারও নাইম, তবে আমার স্বামী ঐ ঝোলটাই বেশী পছন্দ করে যে..
আবারও চুপচাপ জানালা, মনে হয় কোনো কাজে ব্যাস্ত নাইম .... বহুদিন ধরে লিখছি গল্পটা শেষ আর হচ্ছেনা..
শেষ পর্য্ন্ত একটা মেয়ে পছন্দ হলো রাফির বাবার ।
তারা যা চেয়েছিল সবই আছে মেয়েটির মাঝে। মেয়েটির নাম নিনা।
নাম করা ফার্ম থেকে সি এ পাশ করেছে। বাবা ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, মা নামকরা কলেজের অধ্যাপিকা। ছোটো ফ্যামিলি এক ভাই এক বোন ,ভাইটা....
দুপুর দুটো
নাইমঃ কি করছো! আছো ...
উন্মনাঃ আছি...
নাঃ লান্চ করেছো?
উঃ হু, তুমি ?
নাঃ এই মাত্র করলাম...
উঃ এত দেরী করে খেলে যে আজ !
নাঃ আর বোলোনা ...বড় সাহেব ডেকেছিল... যত ভেজাল...।
উঃ তাই নাকি! তা মেনু কি সেই ডিমের তরকারি ?
নাঃ না ইলিশ মাছ যা তুমি একদিন এসে দেখে গিয়েছিলে...
উঃ কি বলো ! সেই সাদা সাদা পটল দিয়ে ঝোল ..রুগীর পথ্য!
নাঃ অফিসের রান্না বোঝোই তো!
উঃ তা তুমি অফিসের পাশের ঐ হোটেলটায় খেলেই তো পারো নাইম!
নাঃ কি যে বলো তাহলে বেতনের সব টাকা ওখানেই খরচ হবে।
উঃ তোমার জন্য খারাপ লাগছে....
নাঃ এটা কোনো ব্যাপার না আমার অভ্যাস হয়ে গেছে.....তা তোমার গল্পের কি অবস্থা উন্মনা ?
উঃ জানো আমার গল্পের মেয়েটা কেমন ?.....
শেষ মেসেজ তিনটা দশে রিসিভ করা হয়েছে. ...
নিনা একটা ভালো ফার্মে চাকরী করছে । আমেরিকায় থাকা বড়লোকের ছেলে শুনে নেচে উঠার কোনো কারন নেই । তাছাড়া সে ভালোবাসে শাহেদকে...
নিনার বাবা মা জানে শাহেদের ব্যাপারটা তার পরও আমেরিকা আর বড়লোক এ দুটো তাদের ভেতর ভীষন আগ্রহের সৃস্টি করছে। তাছাড়া শাহেদ মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ছেলে, অনেক ভাইবোনের সংসার,বাবার ও অবসরের বয়স হয়ে এসেছে ....
বিকাল ৪.৩০
নাইমঃ আছোতো ! নাকি ঘুম! উন্মনা আছো তুমি !
উন্মনাঃ ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম তোমার কোনো সাড়া শব্দ নেই।
নাঃ আর বোলোনা নেটের লাইনটা ডিসকানেক্ট হয়ে গিয়েছিল...
উঃ তাই নাকি....
নাঃ হুমম
উঃ নাইম শোনো .. শুনছো... কই তুমি ? যাও তোমার সাথে আর কথা বলবোনা, একটু পর পর কই চলে যাও তুমি !
নেই সে ....না শুনুক আমার কথা...গল্পটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে...
রাফি সেই সুদুর আমেরিকা থেকে আসলো বাবা মার অনুরোধে,
নতুন চাকরী ছুটি দিতে চায়না। আর এই মন্দার যুগে তার এত ভালো
চাকুরীটাও হারাতে চায়না ....তারপরেও এসেছে সে ।
আজ মেয়ে দেখতে যাবার কথা...
বিকাল ৫টা
নাইমঃ কি করছো! আছো তো! ...।
উন্মনাঃ কোথা থেকে একটু পর পর এসে শুধু বলো 'আছো তো'! ....
নাঃ রাগ করেছো উন্মনা ? আর বোলোনা এই মাত্র হেড অফিস থেকে একটা রিপোর্ট চেয়ে পাঠালো। তুমি তো জানোই অফিসে আমার কত দায়িত্ব আমাকে কত ব্যস্ত থাকতে হয়।
উঃ হু তা জানি... আমাকে বলে গেলেই তো পারতে ! আছি আমি...
নাঃ টাইম পাইনি বলার, রাগ কোরোনা ।
উঃ জানো নাইম, রাফিরা সবাই এখন মেয়েটাকে দেখতে যাবে, মানে দুজনই দুজনকে দেখবে।
নাঃ তাই নাকি ভালোই তো তোমার গল্প এগুচ্ছে...
জানালায় নাইম নেই, ... গল্পের শেষটা কি হবে মিলনাত্নক না বিচ্ছেদ ভাবছি....
নিনার মনের মধ্যে তোলপাড় কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা ।বাবা মা এত আদর করেন তাদের মনে কষ্ট দিতেও কষ্ট হচ্ছে ভীষন।
ঘটনা শোনার পর থেকে শাহেদ আর যোগাযোগ করেনি নিনার সাথে। মনটা খুব খারাপ সেদিন থেকেই ।
গুলশানের নামী রেস্তোরায় সাক্ষাতের স্হান ঠিক হয়েছে...নিনা ঠিক করেছে যা থাকুক ভাগ্যে আজ সে রাফিকে সব খুলে বলবে।
বিকাল ৬টা
নাইমঃ আছো তো !
উন্মনাঃ আছি নাইম...
নাঃ কি করছো...
উঃ গল্পটা শেষ করছি ...
নাঃ গুড।
উঃ বাসায় যাবেনা ?
নাঃ যাবো ড্রাইভারকে গ্যাস আনতে পাঠিয়েছি।
উঃ ওহ্ তা তুমি কি করছো ??
নাঃ একজন বন্ধু এসেছিল, তার সাথে ঝালমুড়ি দিয়ে চা খেলাম, গল্প করলাম...।
উঃ কি বলো ঝালমুড়ি!
নাঃ হ্যা এদিকে যে আর কিছু পাওয়া যায়না।
উঃ তাই....
নাঃ হু
বেশ কিছুক্ষন হলো নাইমের পাত্তা নেই ...না থাক...গল্পটা কি হবে ভাবছি..
মিল দেখালে কি ভালো হবে ...দুঃখের গল্প আমার ভালোলাগেনা....লিখতে থাকি দেখা যাক কি হয় ....
রাফি দেখলো নিনা কে । খুব সুন্দরতো। এমন একটা মেয়েকে জীবনসঙ্গীনি হিসেবে পেলে আর কি চাই! কি নিঃস্বঙ্গ জীবন তার।
কিন্ত মেয়েটা এত বিষন্ন কেন? জানতে হবে কি কারনে মন খারাপ! দুজনের বাবা মা ই সুযোগ করে দিল দুজনের কথা বলার। আজকালকার ছেলে মেয়ে ।নিজেদের মধ্যে কথা বার্তা বলে নেয়াই ভালো।
ছল ছল চোখে নিনা শুধু রাফিকে এটুকুই বলতে পারলো,
'আমি একজনকে ভালোবাসি রাফি'।
রাফি নিনার চুলে আলতো করে একটু হাত বুলিয়ে বল্লো, "চিন্তা করবেন না নিনা, আপনাকে আমার একটুও পছন্দ হয়নি"।
বিকাল ৬.৩০
নাইমঃ আছো উন্মনা!
উন্মনাঃ আছি...
নাঃ সারাদিন তোমার সাথে ভালো করে একটিবারও কথা বলতে পারিনি, রাগ করোনি তো ?
উঃ না...সত্যি রাগ করিনি। তুমি যখন বলো 'আছো তো' মনে হয়, আমি তোমার পাশে থাকি তুমি এটাই চাইছো....
নাঃ ঠিক ধরেছো, আমি শুধু এতটুকু নিশ্চিত হতে চাই যে তুমি আমার পাশে আছো।
উঃ আচ্ছা তাই হবে নাইম, আমি তোমার পাশে আছি আর থাকবোও ..।
নাঃ উন্মনা শোনো গাড়ী এসেছে... উঠি , আজ বড় মেয়েটার জন্মদিন একটা কেক কিনে নিয়ে বাসায় যেতে হবে তাড়াতাড়ি। কাল কথা হবে কেমন ... ভালো থেকো অনেক।
উঃ তুমিও অনেক ভালো থেকো।
'কাল কথা হবে' ,আর ঠিক এ কথা গুলোই হবে ,
কোনো ব্যাতিক্রম নেই, উন্মনা ভালো করেই জানে...
'এই মেয়েকেও তোমার পছন্দ হয়নি রাফি '!
মায়ের বিষন্ন মুখের দিকে না তাকিয়েই স্যুটকেস গুছাতে গুছাতে
রাফি জবাব দিলো, 'না মা হলোনা তো, কি করবো বলো' ?
গল্পের শেষটা শেষ পর্যন্ত এমন ই হলো....ভালো হলো কিনা জানিনা....
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১২ দুপুর ১:১৭