আবুল ফতেহ গিয়াসউদ্দিন হাকিম ওমর খৈয়াম মধ্যযুগের এক কালজয়ী ফার্সী কবি, যার সৃস্ট গভীর মর্মস্পর্শী অন্তর্নিহিত বানী সমৃদ্ধ রুবাইয়াৎ ইংরাজী ভাষায় অনুদিত হয়ে উনিশ শতকে সমস্ত বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল, তার জন্ম কিন্ত হয়েছিল ইরানের খোরাসান প্রদেশের নৈশাপুরে ১০৪৮ খৃস্টাব্দের ১৮ই মে এক সামান্য তাবু প্রস্ততকারীর ঘরে। তার পিতার নাম ছিল ইব্রাহীম, তিনি ছিলেন একজন খৈয়াম অর্থাৎ তাবু প্রস্ততকারী।বাবার পেশার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্যই ওমর খৈয়াম নামটি গ্রহন করেন।
এরই উল্লেখ আছে তার নীচের কবিতায়:
বুনলে বটে খায়াম বুড়ো
জ্ঞান তাবুতে অনেক দড়ি
আজ সে তবু মরছে পুড়ে
তপ্ত -অনল কুন্ডে পরি!
জীবন-ডুড়ি ছিন্ন করে
দিয়েছে তার মৃত্যু আসি
ভাগ্য গেছে ছড়িয়ে শিরে
লান্ছনা আর ঘৃনার মসি।
জ্ঞান আহরনের প্রতি ছিল ওমরের অসীম আগ্রহ। তার জন্য তিনি যুবক বয়সেই প্রথমে সমরখন্দ এবং সেখান থেকে বুখারা যান।বুখারায় মধ্যযুগের একজন প্রধান এবং প্রবাদতুল্য গনিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ হিসেবে নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন।তিনি ক্যালেন্ডারের ও সংস্কারক ছিলেন। সংক্ষিপ্ত ভাবে বলতে গেলে খৈয়াম ছিলেন একজন গনিতজ্ঞ, শিক্ষক, জ্যোতির্বিদ, চিকিৎসক, দার্শনিক, সুফী, ক্যালেন্ডার এর সংস্কারক এবং সর্বোপরি চার লাইন বিশিস্ট কবিতা রুবাইয়ৎ এ ওমর খৈয়ামের স্রস্টা। তার দার্শনিক আর শিক্ষক সত্বাকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল তার কবি পরিচয়। অনেকেই তাকে দার্শনিক হিসেবে বিভিন্ন উপাধীতে ভুষিত করতে চেয়েছিলেন কিন্ত তিনি নিজেকে দার্শনিক হিসেবে পরিচয় দিতে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না।
তার জন্যই তিনি বলতে পেরেছিলেন
'কে আমি'!
বয়সকালে সে একদা আহাম্মকের মত
এই দুনিয়ার রহস্যটা বুঝতে গিয়ে- কত
ঘুরেছিলাম দেশ বিদেশের মনীষিদের পাছে
নিত্য তাদের কাছে, শুনতে যেতেম কি আগ্রহে
গভীর জ্ঞানে বানী।
কোনো কাজের নয় যে সে সব
তখন কি তা জানি !
সাধু সংগ বেড়িয়ে এতো তত্বকথার কুড়িয়ে সার
সুফল বড় হয়নি কিছু
জ্ঞানের বোঝা বাড়িয়ে আর।
ঘুচলোনা মোর মনের ধোঁকা চিরদিনের দন্দ্ব যত
অবিশ্বাসের আবছায়াতে ঘনিয়ে উঠে ক্রমাগত।
ফার্সীভাষার বাইরে ইংরাজী ভাষার জগৎ তথা পৃথিবীর সমস্ত কাব্য রস পিপাসুর কাছে তাকে সর্বপ্রথম পরিচয় করিয়ে দেন ১৮৫৯ খৃস্টাব্দে একজন বৃটিশ কবি ,নাম তার এডওয়ার্ড ফিটজারেল্ড।তিনি খৈয়ামের রচিত ১১০ টি রুবাইয়াৎ অনুবাদ করে সমগ্র বিশ্বের সাহিত্য জগৎ এ এক আলোড়নের সৃস্টি করেন।যদিও অনেকের ধারনা তার অনুবাদের অনেক গুলোই খৈয়াম লিখিত নয়।
উল্লেখ্য যে ফিটজেরাল্ডের অনুবাদের পরেই পারস্যবাসী খৈয়ামকে নতুন করে চিনতে পারে এবং তার জন্য এখনও গৌরব বোধ করে।
খৈয়ামের ব্যাক্তিগত ধর্মবিশ্বাস কি ছিল তা পরিস্কার ভাবে জানা যায়নি, তাই তার কবিতার মাধ্যমেই অনেকেই তা বিশ্লেষন করতে চেয়েছেন।আমার ধারনা তিনি কোনো ধর্মীয় গোড়ামীর মধ্য নিজেকে আবদ্ধ রাখেন নি। তিনি নাস্তিক ও ছিলেন না আবার অন্ধবিশ্বাসীও ছিলেন না। খৈয়াম কিন্ত অত্যন্ত ভাগ্যে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই তিনি লিখতে পেরেছিলেনঃ
দাও পিয়ালা প্রিয়া আমার অধরপুটে পুর্ন করে
যাক অতীতের অনুতাপ আর ভবিষ্যতের ভাবনা মরে
কাল কি হবে ভাববো কেন আজ বসে লো তাই
তার আগে সই এখান থেকে চলেই যদি যাই
বিচিত্র নয় তত
ফুরিয়ে যাওয়া অসংখ্য দিন নিরুদিস্ট যত-
তার ভিতরেই কোন অতীতের লুপ্ত স্মৃতির প্রায়
মিশিয়ে যাবো হায়...।
ওমরের বিখ্যাত রুবাইয়াৎ এর উপাদান মুলত দুটি: এক হলো তার সুফী বা দার্শনিক মতবাদ, আরেকটি হলো তার কবিতার সৌন্দর্য। প্রচন্ড অদৃস্টবাদী এই কবির মতে মানুষের জন্ম, মৃত্যু, ভাগ্য, রুজী- রোজগার সবই পুর্ব নির্ধারিত।কান্না কাটি করে কোনো লাভ নেই।এখানে মহাকাশকে দায়ী করেও কোনো ফায়দা নেই, সে আমাদের মতই অক্ষম ও অসহায়। সুতরাং হা হুতাশ না করে জীবনকে উপভোগ করো, কারন কেউ ই একবারের বেশী দু বার জন্মাবেনা। মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে ছিল তার প্রচন্ড কৌতুহল, তার এই আক্ষেপ তার মানসিক দ্বন্দ তার বিভিন্ন কবিতার ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে। তাই তো উনি বলেছেন:
উপুড় করা পাত্রটা ওই
আকাশ মোরা বলছি যাকে
যার নীচেতেই কুঁকড়ে বেচে
আকড়ে আছি মরণটাকে
হাত পেতে কেউ ওর কাছেতে
হয়োনা আর মিথ্যে হীন
তোমার আমার মতই ওটা
অক্ষমতায় পংগু দীন।
ওমর খৈয়ামের মতে পৃথিবীটা এক সরাইখানা যেখানে মানুষের অবস্হান স্বল্পসময়ের জন্য, সে রাজাই হোক আর সাধারন মানুষই হোক। নিয়তির কাছে সবাই অসহায় এবং সেই নিয়তি তার নিস্ঠুর চাকার নীচে সবই পিস্ট করে শেষ পর্যন্ত রেখে যায় কিছু করুন স্মৃতি।
তারই উল্লেখ করেছেন খৈয়াম নীচের কবিতায়ঃ
ঘুটি তো কেউ কয়না কথা
নির্বিচারে নিরুপায়ে
খেলুড়েরই ইচ্ছে মত
ঘুরতে থাকে ডাইনে বায়ে
তোমায় নিয়ে খেলার ছলে
চাল ছেলেছেন আজকে যিনি
তোমার কথা সব জানা তার
সবার কথাই জানেন তিনি।
খৈয়াম মনে করতেন মৃত্যুর পরে জীবন বলে কিছুই নেই। মাটিতেই সবার দেহই বিলীন হয়ে যাবে,সেই মাটি দিয়েই হয়ত ভবিষ্যতে কোনো কুম্ভকার তৈরী করবে মদের কুজো বা পেয়ালা আর সেই পেয়ালা তখন শোনাবে কোনো পানকারীকে তার বিগত জীবনের ইতিহাস। তাই তিনি লিখেছেন:
সেইতো সখী মাটির কোলে
হবেই শেষে পড়তে ঢলে
তাই বলি আয় হিম অতলে
তলিয়ে যাবার আগে
ভোগ করে যাই প্রানটা হেসে
বুক ভরে নেই ভালোবেসে
এই জীবনের যে কটা দিন সামনে আজও জাগে
মাটির দেহ মাটির গেহে হবেই যেনো লীন
ধুলোর বোঝা মিশবে ধুলোয় এসে
সুর কি সুরা -গায়ক-আলোক সকল শোভাহীন
অন্তহারা অসাড় শীতল দেশে।
ওমরের কাব্যের আরেকটি বড় বৈশিস্ট হলো সাবলীল গতিশীলতা, লীলায়িত ছন্দময় ভংগী যা তার পরবর্তী কবি হাফিজ, সাদী প্রবল ভাবে অনুসরণ করলেও কেউ আয়ত্ত করতে পারেনি। তিনি এক অনন্য অসাধারন অনতিক্রম্য কাব্য প্রতিভার অধিকারী যে নিজ বৈশিস্টে ভাস্বর।
এছাড়া ছিল তার নৈসর্গ প্রেম যা তার পেশা নিরস গনিত চর্চাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল। পৃথিবীর রূপরস যেমন ক্ষুদ্র স্রোতস্বিনী,বুলবুলির গান,টিউলিপ ফুল, গোলাপের সুবাস,বসন্তের সমীরন,উষার আলো,জোৎস্না প্লাবিত রজনী যা তার কবিতায় বার বার ঘুরে এসেছে ।
অপরূপা সাকী খৈয়ামের পান পাত্র পুর্ন করে দিচ্ছে আর তুলছে বীনার মধুর ঝংকার যা তার সর্বক্ষনের কল্পনার ফসল।
এইখানে এই তরুতলে তোমায় আমায় কুতুহলে
এ জীবনের যে কটা দিন কাটিয়ে যাবো প্রিয়ে
সংগে রবে সুরার পাত্র অলপ কিছু আহার মাত্র
আরেক খানি ছন্দ মধুর কাব্য হাতে নিয়ে।
থাকবে তুমি আমার পাশে গাইবে সখী প্রেমোচ্ছাসে
মরুর মাঝে স্বপ্ন স্বরগ করবো বিরচন
গহন কানন হবেলো সই নন্দনেরই বন।
অনেকে মনে করেন খৈয়ামের রুবাইয়াৎ বলতেই ইংরেজ ভাষীদের চোখে যে সুরা সাকী আর রুটির চিত্র ভেসে উঠে এটা ঠিক নয়।কারন তিনি শুধু একজন বিশিস্ট কবি ই ছিলেন না তিনি একজন বিখ্যাত গনিতবিদ ছাড়াও ছিলেন একজন চিকৎসক।ফিটজেরাল্ডের ভুল অনুবাদের ফলেই পাঠকদের মধ্যে এই ভুল ধারনা। ফিটজেরাল্ড ছাড়াও বহু লোক বহু ভাষায় রুবাইয়াৎ অনুবাদ করেছেন। বাংলা অনুবাদকের মধ্যে কাজী নজরুল,নরেন্দ্র দেব ও কান্তি চন্দ্র ঘোষ উল্লেখযোগ্য।আমার কাছে নরেন্দ্র দেবের রুবাইয়াৎ গুলো বেশী ভালোলেগেছে তাই তার অনুবাদগুলোই উল্লেখ করলাম।
সুফী মতবাদে বিশ্বাসী খৈয়াম দীর্ঘকাল ধরে বিজ্ঞান সাধনার ফলে জগৎকে আরো স্পস্ট ভাবে দেখার দৃস্টিভংগী লাভ করেছে।মানুষ তার সীমাবদ্ধ চিন্তাভাবনা দিয়ে সৃস্টি রহস্য কোনো সমাধান করতে পারবেনা।সুতরাং এটা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। কালক্ষেপনেরও দরকার নেই।
তাই খৈয়াম লিখেছেন:
দু:খ তোমার বাড়িওনা আর
আক্ষেপে হে বন্ধু বৃথা
অন্যায়ের এই জগৎটাতে
জ্বালিয়ে রাখো ন্যায়ের চিতা-
মিথ্যা যখন এই ধরনী
তখন হেথা কিসের ভয়
দূর করে দাও ভাবনা যত
কিছুই সখা সত্য নয়।
কারো কারো ধারনা যে তিনি দ্বৈত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন তাই কোনো কোনো কবিতায় তিনি বিধাতার কাছে সম্পুর্ন আত্নসমর্পন করে জানতে চাইছেন তার কৃতকর্মের ফলাফল :
ওগো আমার চলার পথে তুমি -
রাখলে খুড়ে পাপের গহর
বইয়ে বিপুল সুরার লহর
করলে পিছল ভুমি
এখন আমি ঠিক যদি না চলতে পারি তালে
শিকল বাঁধা চরন নিয়ে প্রারদ্ধের ঐ জালে
বলবে নাতো ক্রুদ্ধ অভিশাপে---
পতন আমার ঘটলো নিজের পাপে ?
আবার কখোনো লিখেছেনঃ
কোন প্রমাদে পরাণ কাঁদে এমন করে ওমার
দুঃখ কিসের তোমার--?
ভাগ্য নেহাৎ মন্দ ভেবে মিথ্যা করো খেদ
দাও ডুবিয়ে আনন্দে হে জীবন ভরা ক্লেদ
পাপীর শুধু আছেই যেনো তার দয়াতে অধিকার
পাপ করেনি জন্মে যে জন বিধির কৃপায় কি দাবী তার!
আবার লিখছেন কখনোঃ
জীবন বিভিষীকা যারে মৃত্যু ভয়ের চাইতে মারে
মরন তাকে ভয় দেখাতে এমন কি আর অধিক পারে!
দিন কতকের মেয়াদ শুধু ধার করা এই জীবন মোর,
হাস্যমুখে ফিরিয়ে দেবো সময়টুকু হলেই ভোর।
পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে এই শোকে তিনি রচনা করেছেনঃ
ঐ আকাশের গ্রহ তারার ভীড়ের মধ্যে যেদিন যাবো
এমন স্নিগ্ধ শস্য শ্যমল জগৎ কি আর সেথায় পাবো!
হায় ধরনী- হৃদয় রানী তোমায় ফেলে যেতেই হবে
মনটা আমার কাঁদছে গো আজ সেই বিরহের অনুভবে।
শেষ পর্যন্ত ভাগ্য নিয়ে সকল দিধা দন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে ১১৩১ খৃস্টাব্দর ৪ঠা ডিসেম্বর নৈশাপুরেই এই জগৎ বিখ্যাত কবি ইরানের গৌরবের প্রতীক ওমর খৈয়ামের জীবনবসান ঘটে।
মৃত্যু পরবর্তী জীবন নিয়ে তার ছিল প্রচন্ড কৌতুহল
তাই তো তিনি এক কবিতায় বলেছেনঃ
অনন্ত অম্বরে যারা করেছে প্রবেশ
বলেনাতো কিছু তারা ফিরে এসে কেহ
পথের ইঙ্গিত মাত্র নাহি দেয় একটি বিদেহ
অজানা সে ও পারের লইতে উদ্দেশ
নিজেদেরই তাই কিগো একে একে যেতে হয় শেষ!
সত্যিই তিনিও আর ফিরে এসে বলেন নি কি আছে সেথায়!
কবিতা গুলো কবি নরেন্দ্র দেব কতৃক অনুদিত।
ছবি নেটের সৌজন্যে
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০১১ দুপুর ১:০৩