বিখ্যাত গ্রেট ওয়াল
( খৃ:পূ ২০৮--১৬৪০ খৃস্টাব্দ)
ইতিহাসের পাতা থেকে জানা যায় যে দেয়াল নির্মান সাংস্কৃতির সাথে চীন দেশীয়রা খ্রীস্টের জন্মেরও আটশ বছর আগে থেকে পরিচিত ছিল।সে সময় চীনের ছোটো ছোটো সামন্ত রাজারা দেয়াল দিয়ে নিজেদের রাজ্য গুলোকে দুর্গের মত ঘিরে রাখতো শত্রুর আক্রমনের ভয়ে।খৃস্টের জন্মের আগে এই ধরনের দেয়াল ঘেরা নগর রাস্ট্রের কথা আমরা বিস্তারিত ভাবে জানতে পারি গ্রীক ও রোমান ইতিহাস থেকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল এথেন্স(হেল্লাস),স্পার্টা, ট্রয় প্রভৃতি দুর্গ নগরী।
২২১ খ্রীস্টপুর্বে চীনের শিন (qin) সাম্রাজ্যের প্রতিস্ঠাতা শিন সি হুয়াং এ সমস্ত ছোটো ছোটো রাজ্যগুলোকে পদানত করে সমগ্র চীনকে একটি বিশাল সাম্রাজ্যে পরিনত করেন।তার নির্দেশে সমস্ত দুর্গের মত প্রাচীর গুলো কে ভেঙে ফেলা হয়েছিল। কিন্ত কিছুদিন পরেই উত্তর দিক থেকে আসা দুধর্ষ মোংগল আর মান্চুরিয়ান জাতির ক্রমাগত আক্রমন থেকে নিজের সাম্রাজ্য বাঁচানোর জন্য তিনি পুনরায় দেয়াল তৈরীর আদেশ দেন।
২০৮ খৃস্ট পুর্বে প্রথম দেয়াল তৈরীর কাজ শুরু হয় এবং তখন সেখানে যে সমস্ত উপকরণ গুলো সহজে পাওয়া যেত যেমন: মাটি, কাঠ, পাথর সে গুলোই ব্যাবহার করা হয়েছিল। সে দেয়ালের চিন্হ বর্তমানে নেই বল্লেই চলে।
এখন আমরা যে গ্রেট ওয়াল দেখি তা পরবর্তীতে মিং সম্রাটদের আমলে তৈরী করা।এর কাজ শুরু হয় ১৩৬৮ সনে আর শেষ হয় ১৬৪০ সনে মিং সম্রাট ইয়ং লির আমলে। আনুমানিক দশ লক্ষ শ্রমিকের জীবনের বিনিময়ে ইট এবং পাথর দিয়ে যুগ যুগ ধরে মোট পাঁচ দফায় এই দেয়াল নির্মিত হয়েছিল।
সমস্ত শাখা প্রশাখাসহ গ্রেট ওয়াল দৈর্ঘ্যে ৮.৮৫১.৮ কিলোমিটার লম্বা।
কিন্ত কালের অনেক ঝড় ঝন্জা সহ্য করে বর্তমানে টিকে আছে কেবল মাত্র আনুমানিক চব্বিশ শ কিলোমিটার।
সাপের মত পেঁচিয়ে পাহাড়ের পর পাহাড় অতিক্রম করেছে চীনের প্রাচীর
বেজিং থেকে চীনের প্রাচীর যেখান থেকে সবচেয়ে ভালোভাবে দেখা যায় তার নাম বাদালিং পয়েন্ট (ট্যুরিস্ট অফিসের তথ্য)। সেখানে এ দেয়ালের গড় উচ্চতা ২৬ ফিট এবং চওড়ায় ১৭ ফিট। চারকোনা করে কাটা পাথর দিয়ে অত্যন্ত মজবুত ভাবে তৈরী পৃথিবীর দীর্ঘতম এই দৃস্টিনন্দন দেয়ালটি নাকি চাঁদ থেকেও দেখা যায় বলে অনেকের দাবী।তবে এ কথার কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।
চীনের প্রাচীর ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি অনুপম নিদর্শন।
জানা অজানা সমস্ত ইতিহাসই আমরা শুনলাম আমাদের অত্যন্ত হাসি খুশী তরুন গাইড লিওর মুখে বাসে যেতে যেতে। চীনে প্রতিটি জিনিসের দুটো করে নাম যা আমি আগেও উল্লেখ করেছি, লিওর একটা চাইনীজ নামও আছে বলে সে নামটা জানালো কিন্ত আমার মনে নেই কঠিন ছিল বলে।
খুব ভোরে উঠে তৈরী হয়ে যখন নির্ধারিত বাসের জন্য অপেক্ষা করছি মনের মধ্যে চলছে ভীষন তোলপাড়। কি দেখবো! কি রকম লাগবে? সব কিছু মিলিয়ে চরম এক উত্তেজনা। রাতেও স্বপ্নে গ্রেট ওয়াল হানা দিয়ে গেছে বার বার।যদিও টিভিতে, ছবিতে অনেক বার দেখা। আত্নীয় স্বজন যারা দেখেছে তাদের মুখে বহুবার শোনা, তারপরও পরের মুখে ঝাল খাওয়া আর নিজে খাওয়ার মধ্যে একটা পার্থ্ক্যতো অবশ্যই আছে।
বিশাল এসি বাসে বিভিন্ন দেশের আমরা অনেক জন পর্যটক ছিলাম তার মধ্যে হং কং এর এক ভদ্রমহিলাও ছিলেন। উল্লেখ্য যে বর্তমানে চীনে পর্যটকদের মধ্যে এক বিশাল সংখ্যা চীনারাই দখল করে আছে। অর্থনীতির সাথে সাথে তাদের মূল্যবোধ ও পাল্টে যাচ্ছে, উন্নত জীবন যাত্রার সাথে সাথে ভোগ-বিলাসের দিকেও এখন তাদের দৃস্টি। পার্ল এস বাকের সেই দারিদ্র ক্লিষ্ট চীন আর এখন নেই।
চীন দেশটি যেমন বিশাল তার সব কিছুই বিশাল, ছোটোখাটো কিছু বোধ হয় তারা চিন্তাও করতে পারেনা।আগে মানুষ গুলো ছোটো খাটো ছিল তারা ও এখন গড় উচ্চতায় আগের প্রজন্মকে ছাড়িয়ে এসেছে শুধুমাত্র খাদ্যাভাস পরিবর্তনের মাধ্যমে। আমি একটি বিখ্যাত বিদেশী ইংরাজী ম্যাগাজিনে পড়েছি যারা চালের তৈরী খাবারের চেয়ে গমের তৈরী খাবার বেশী খায় তারা বেশী লম্বা হয়,যেটা চীনাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় বলে উল্লেখ করাআছে।
কই যেন ছিলাম! ও বাসে.....
যাক একটার পর একটা রিং রোড পার হয়ে আসছি।বেজিং কে ঘিরে তৈরী সাতটি বলয় এই রিং রোড পার হয়ে আসার পর দেখা মিললো দুর
দিগন্তে পাহাড়ের সারি। ওখানেই আছে সেই স্বপ্নে দেখা দেয়াল।
মিং সম্রাটের সমাধি সৌধের একটি সুদৃশ্য স্হাপনা
দেয়াল নয় প্রথমেই আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো মিং সম্রাটের সমাধি সৌধে। বিশাল এলাকা জুড়ে ঐতিহ্যবাহী চৈনিক নির্মান শৈলীতে তৈরী অনেক গুলো ভবন এবং সূদৃশ্য এক তোরণ। সৌধটি ছাড়া বিভিন্ন ঘরগুলো এখন মিউজিয়াম। অপরূপ দৃস্টিনন্দন সেই তোরন পার হয়ে যে ঘরটিতে আমরা ঢুকলাম তাতে মহাপরাক্রমশালী মিং সম্রাট ইয়ং লি র এক বিশাল ব্রোন্জের মুর্তি। আরও আছে তার ব্যবহার করা কিছু সামান্য জিনিস পত্র।
উল্লেখ্য যে চেয়ারম্যান মাও-সে-তুং যখন ১৯৪৯ সনের জানুয়ারী মাসে বিনা রক্তপাতে বেজিং দখল করে নেয় তখন আমেরিকার মদদপুস্ট চীনের তৎকালীন দূর্নীতি পরায়ন প্রেসিডেন্ট চিয়াং কাইশেক ও তার সঙ্গীসাথীরা তাইওয়ানে পালিয়ে যাবার সময় অন্যান্য সম্পদের সাথে সাথে দেশের বেশীরভাগ প্রত্নতাত্মিক সম্পদও সাথে করে নিয়ে যায় যা বর্তমানে তাইওয়ানের মিউজিয়াম আলো করে আছে। তবে প্রথম দফা লুট করেছিল বৃটিশরা।
মিউজিয়ামের ভেতরে গাছের গুড়ি দিয়ে নির্মিত পিলার
বিশাল মোটা মোটা গাছের পিলার আর কাঠের তৈরী সেই দোচালা টিনের মত ঘরগুলো চীনের ঐতিহ্যবাহী লাল আর নীল রঙে রাঙানো।একটি একটি গাছ থেকে এক একটি পিলার এবং সেগুলো এতোই মোটা ছিল যা আমি দু হাত দিয়েও নাগাল পাইনি। অবশ্য মানুষের নাগালের বাইরে রাখার জন্য ওগুলো কাঁচের বেস্টনী দেয়া।
পুরো সমাধি ক্ষেত্রটা ঘুরে ঘুরে দেখলাম।সেই প্রাংগনেই একটা ছোটো গেট আছে, ফিরে আসার সময় গাইড জানালো এখানে আমাদের সবাইকে একসাথে জোরে জোরে একটা চাইনীজ কথা বলতে হবে, বাংলায় যার অর্থ আমরা মৃতুর জগৎ থেকে ইহ জগৎ এ ফিরে আসলাম। অন্যান্য ট্যুরিস্ট রাও সব হাসতে হাসতে তাদের গাইডের সাথে একথা বলে গেট পার হচ্ছে।
লিও জানালো সম্রাটের মৃতদেহ এই সৌধগুলোর কোনোটাতেই নেই।
তা আছে পেছনেই অল্প দুরে পাহাড়ের মধ্যে কবর দেয়া।
যাক, তার আত্না সেখানে শান্তিতে থাকুক।
এখানে বহূ মানুষের কোলাহলে মুখরিত চারিদিক।
জেড এম্পোরিয়াম
এখান থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো জেড এম্পোরিয়ামে ।যদি কিছু কেনা কাটা করি তাহলেই তো তাদের কমিশন।লিও জানালো চাইনীজরা জেড কে হীরার চেয়ে ও বেশী মূল্য দিয়ে থাকে কারন জেড কাটতে হীরা লাগে এত শক্ত পাথর! এই পাথরকে তারা সৌভাগ্যের প্রতীক বলে মনে করে।তাদের বাগদানে অবশ্যই জেডের আংটি দিতে হবে যা বিবাহিত চাইনীজ মেয়েরা আজীবন অনামিকায় পরে থাকে সুখী বিবাহিত জীবনের আশায়।
তবে অত্যাধুনিক মেয়েদের কথা লিও উল্লেখ করেনি আমিও কিছু বলতে পারবোনা। আরো জানলাম জেডের অনেক রঙ হয় প্রচলিত সবুজ ছাড়াও । এর ভেতরে সাদাটা সবচেয়ে দামী এবং সে কারনেই অলিম্পিক মেডেলেও চীনা কর্তৃপক্ষ এক টুকরো গোলাকার সাদা জেড লাগিয়ে দিয়েছিল মেডেল ধারীদের সৌভাগ্য কামনায়।
কারখানা জুড়ে তৈরী হচ্ছে জেডের নানান জিনিস, বিক্রীর জন্য সাজিয়ে রাখা আছে বিশাল চার পাঁচটা ঘর জুড়ে, তবে অসম্ভব দাম। এই দামও আমার স্বামীকে দমাতে পারলোনা ছোটো জেডের হাতি কেনা থেকে ।আমাকে কিনে দিলো সবুজ জেডের হার্ট শেপের ছোট্ট দুল চারিদিকে ছোটো ছোটো আমেরিকান ডায়মন্ড বসানো।
কিন্ত আমার মন পড়ে রইলো সুক্ষ কারুকাজ করা সেই শো পীসগুলোর উপর যার দাম সর্ব নিম্ন তিরিশ হাজার আর এম বি !
জেড এম্পোরিয়াম থেকে কেনা জেডের হাতি
চীনাদের নিজেদের খনি ছাড়াও মিয়ানমার জেডের বড় যোগানদার।আমার স্বামীর মতে এ সমস্ত বিভিন্ন কারনেই চীন চায়না মিয়ানমারে গনতন্ত্র আসুক।আর গনতন্ত্র আসলেইতো মিয়ানমার তার সব রকমের সম্পদ খোলা বাজারে প্রতিযোগীতামুলক দামে বিক্রী করতে পারবে।
দুপুরের খাবার জেড এম্পোরিয়ামের ভেতরেই রেস্টুরেন্টে সার্ভ করা হলো। লিও জেনে নিয়েছে আগেই কে কি খাবেনা। প্রচুর খাবার এবং প্রত্যেকটা পদই খুব মজার ছিল।
এবার যাবার পালা সেই প্রাচীরে যেখানে আমি এতদিন কল্পনায় হেটে বেড়িয়েছি। পাহাড় এখন আমাদের অনেক কাছে এসে পড়েছে আর তার মাঝে দেখতে পেলাম আমার আজীবন কল্পনার সেই দীর্ঘতম দেয়ালের সারি। শেষ পর্যন্ত পৌছে গেলাম গ্রেট ওয়ালে। সিড়ি বেয়ে উঠলাম এক ধাপ।
লিও আমাদের সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল নীচে।
আমার কানে কিছুই ঢুকলোনা আমি চেয়ে আছি দুর দিগন্তের দিকে চেয়ে। সাপের মত একেবেকে যাওয়া পাথরের পথ আর একটু পর পর চৌকি ঘর যেখান থেকে সৈন্যরা পাহারা দিত বিশাল মিং সাম্রাজ্য কে। মনের মধ্যে ভেসে উঠছে দেয়ালের ইতিহাস। মোঙ্গল আর মান্চুরিয়ান জাতির আক্রমন থেকে বাঁচার জন্য যে দেয়াল তা তারা অতিক্রম করেছে বহুবার। দুধর্ষ মোঙ্গল নেতা নৃশংসতায় যারা পৃথিবী খ্যাত হালাকু খান, চেঙ্গীজ খান, এক পা খোড়া তৈমুর লং তোমরাও কি এসেছিলে ঘোড়ার পিঠে চেপে ধুলোর মেঘ উড়িয়ে বিশ্বের এই দীর্ঘতম দেয়ালের কাছে !
আমার চোখের সামনে এই সেই দেয়াল শক্ত পাথরে তৈরী শতাব্দীর পর শতাব্দী টিকে আছে বহু মানুষের ভালোবাসা নিয়ে
কি যে ভালোলাগায় ভরে গেল আমার মন। আমি দেয়ালের গায়ে হাত বুলিয়ে ভাবছি এখনও কি আমি স্বপ্ন দেখছি। আমি কি সত্যি দাড়িয়ে আছি বিশ্বের কোনো এক বিস্ময়ের সিড়িতে পা দিয়ে ! চীনের গর্ব গ্রেট ওয়ালে! এটাতো নিরেট পাথরে গড়া, তবে এত জীবন্ত লাগছে কেন ! সত্যি কি লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে তৈরী এই দেয়াল! তবে এত ভালো লাগছে কেন আমার! আমিতো রক্ত পছন্দ করিনা!
মনের মধ্য কত শত প্রশ্নের উকিঝুকি যার কোনো উত্তর নেই কারো কাছে হয়তো।
আমার স্বামী পুত্র সহ সবাই দেয়াল বেয়ে উঠছে আমাকে ডাকলো কিন্ত যেতে ইচ্ছে করলোনা, অসম্ভব এক ভালোলাগার অনূভুতি আমায় আস্টে পৃস্ঠে জড়িয়ে ধরলো। আমি বসে রইলাম সেই ঝিরি ঝিরি ঠান্ডা এক মিস্টি বাতাস গায়ে মেখে চারকোনা চৌকিঘরের পাথরের সিড়িতে। দম বন্ধ করা সেই অপার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ আমি নির্নিমেষ নয়নে চেয়ে দেখছি দুরের দেয়াল বেয়ে উঠতে থাকা হাজার হাজার পর্যটকের সারির দিকে। তাদের বিভিন্ন রঙের পোষাক দেয়ালের গায়ে এক অপুর্ব সুন্দর কোলাজের সৃস্টি করে চলেছে। তার মধ্যে চীনাদের প্রিয় লাল রঙটাই বেশী দেখা যাচ্ছে যা তাদের প্রিয় পতাকার রঙ।
সেটাই তো স্বাভাবিক, কারন আমি যে লাল পতাকার দেশে।
সমাপ্ত :