হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে পুলিশ তিন বছর আগে অর্ধশতাধিক মামলা করলেও সরকারের সঙ্গে ধর্মভিত্তিক এই সংগঠনটির সম্পর্ক এখন ঘনিষ্ঠ। ২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতের নজিরবিহীন সমাবেশ ও তাণ্ডবের পর পুলিশ একে একে মামলাগুলো দায়ের করে।
দুই পক্ষের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, সরকারের সঙ্গে একধরনের অলিখিত সমঝোতার ফলে হেফাজতের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। বিনিময়ে ১৩ দফা দাবি নিয়ে আগের উগ্র অবস্থান থেকে সরে এসেছে হেফাজত।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সমঝোতার কথা নাকচ করে দেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ রয়েছে। আমাদের যখন প্রয়োজন হয় তাঁদের নিবৃত্ত করার, বললেই তাঁরা কথা শোনেন।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক এই সংগঠনের নেতা-কর্মীদের দিয়ে একটি চক্র দেশের পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চেয়েছিল। এখন আর ওই চক্রের সঙ্গে তারা নেই।
সমঝোতার কথা অস্বীকার করেছে হেফাজতে ইসলামও। অনেকের সন্দেহ, সরকারের সঙ্গে আপনাদের সমঝোতা হয়েছে, এমন প্রশ্নের জবাবে সংগঠনটির মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, ‘অসম্ভব’। অন্যদের অনেক পুরোনো মামলাও সচল এবং দ্রুত বিচার চলছে, আপনাদেরগুলো নিষ্ক্রিয় কেন? জবাবে বাবুনগরী বলেন, ‘আমাদেরটা ঝুলে আছে কেন, এটা তো সরকারই জানে। কেন তারা ঝুলিয়ে রাখছে, সেটা আমরা জানি না।’
৫ মের অভিযানে আড়াই থেকে তিন হাজার লোক ‘শহীদ’ হয়েছে বলে সে সময় হেফাজতের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও এখন নেতারা এ বিষয়ে নিশ্চুপ। গত তিন বছরেও কথিত ‘শহীদদের’ নামের তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। এই দাবির পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণও দিতে পারেনি তারা।
সরকারি সূত্রগুলো বলছে, হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফীসহ সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, সাংসদ, মেয়র এবং সরকারের বিভিন্ন সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তাদের যোগাযোগ রয়েছে। সংগঠনের নেতারা সরকারের কথা শোনেন এবং অনুরোধ রাখেন।
হেফাজতের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংগঠনের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী ও সমর্থকও বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক রয়েছে। আওয়ামী লীগ, সরকার ও ছাত্রলীগকে ‘হেফাজতের বন্ধু’ বলে গত বছরের ১১ এপ্রিল আহমদ শফীর বক্তৃতার পর এ বিশ্বাস আরও জোরালো হয়।
সর্বশেষ গত ১৪ জানুয়ারি ব্যক্তিগত জীবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ধর্ম পালনের বিষয়টি উল্লেখ করে আহমদ শফী বলেন, ‘তিনি আস্তিক, আমরাও আস্তিক। আমরা ও তাঁদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আমাদের আন্দোলন নাস্তিকদের বিরুদ্ধে।’
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টির পর কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ জেগে ওঠে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ কর্মসূচি শেষে শাপলা চত্বরে অবস্থান নিয়ে সরকারের উচ্চমহলে চরম উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছিল তারা। ৫ মে মতিঝিলে অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়। ওই সময়ের সংঘর্ষ ও সহিংসতায় রাজধানীসহ সারা দেশে মোট ২৭ জন নিহত ও দেড় হাজারের মতো মানুষ আহত হন।পরে ওই দিন মধ্যরাতে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির যৌথ অভিযানের মুখে এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হন হেফাজতের কর্মীরা।
পুলিশ সূত্র জানায়, স্মরণকালের সেই ভয়াবহ তাণ্ডব ও সহিংসতার ঘটনায় সারা দেশে মোট ৬৮টি মামলা হয়েছিল। এরমধ্যে ৫৩টি মামলা হয় রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল, রমনা, শাহবাগ, যাত্রাবাড়ী, কামরাঙ্গীরচর, শেরেবাংলা নগর ও কলাবাগান থানায়। ১৫টির তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। বর্তমানে সব মামলারই তদন্ত থেমে আছে। এসব মামলার তদন্ত নিয়ে পুলিশেরও আগ্রহ নেই। কোনো আসামিকেও ধরছে না পুলিশ।
জানা গেছে, রাজধানীর ৫৩টি মামলার মধ্যে কেবল কলাবাগান ও রমনা থানার তিনটি এবং শেরেবাংলা নগর থানার একটি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর বাইরের ১৫টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হলেও কেন্দ্রীয় নেতাদের জড়ানো হয়নি। ওই সময় হেফাজতের মহাসচিবসহ অন্তত ৭৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে প্রায় সবাই জামিনে ছাড়া পান।
ডিএমপি কমিশনারের মুখপাত্র ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মামলাগুলোয় আসামির সংখ্যা অনেক। হেফাজতে ইসলামের সেই ধ্বংসযজ্ঞে লাখ লাখ লোক অংশ নিয়েছিল। তাদের প্রত্যেককে খুঁজে বের করে নাম-ঠিকানা যাচাই করতে সময় লাগছে।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, এখন সরকারের ‘কৌশল’ হচ্ছে কিছু মামলার অভিযোগপত্র দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের চাপে রাখা, যাতে সরকারের বিরুদ্ধে নতুন করে কোনো কর্মসূচি দিতে না পারে সংগঠনটি।
এদিকে সংগঠনের দায়িত্বশীল নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা, সরকারের একাধিক সংস্থার চাপ ও সার্বক্ষণিক নজরদারি এবং হেফাজতের একাংশের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগ থাকায় সংগঠনের অভ্যন্তরীণ অবস্থা নাজুক হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে হেফাজতও ৫ মে নিয়ে মাতামাতি না করে নীরব হয়ে গেছে। এবারও সারা দেশে কোনো কর্মসূচি রাখেনি। যদিও সংগঠনের নেতাদের দাবি, তাঁদের ১৩ দফা দাবি এখনো বহাল আছে।
৫ মের বিষয়ে জানতে সংগঠনটির আমির শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি। তবে মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘৫ তারিখে যাঁরা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হয়েছেন, তাঁদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। তাঁদের রক্তের বিনিময়ে এ দেশে শান্তি, হক ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা হবে ইনশা আল্লাহ।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এখন শহীদদের তালিকা প্রকাশ করব না। সময় এলে করব।’ সে সময়টা কবে—পাল্টা প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘সময়টা আসুক, দেখবেন।’
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, পানিসম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ সালাম মাঝেমধ্যে হেফাজতের আমিরের পরিচালনাধীন হাটহাজারী মাদ্রাসায় যান। এ ছাড়া বিভিন্ন সংস্থার পদস্থ কর্মকর্তারা নিয়মিত মাদ্রাসায় যাতায়াত করেন।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেতা চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রশাসক এম এ সালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাটহাজারী আসন থেকে নির্বাচন করেছি। এলাকার মাদ্রাসা হিসেবে বিভিন্ন কাজে যেতেই পারি। শাপলা চত্বরের ঘটনা ছিল ভুল-বোঝাবুঝি। এটার অবসান হয়ে গেছে। আর আপসের প্রসঙ্গ আসছে না।’
সরকারি দলের নেতা, মন্ত্রী ও বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের মাদ্রাসায় যাওয়া-আসার কথা স্বীকার করেন হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী। তিনি বলেন, ‘আসলে অসুবিধা কী? কোনো দলের নেতা বা সরকারের সঙ্গে হেফাজতের কোনো শত্রুতা নেই।’
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০১৬ সকাল ৮:৩৪