মেয়েটা কলেজে পড়ে ফুরফুরা মুডে থাকার বয়সই সেটা। কারণে-অকারণে ক্রমাগত হাসতেই থাকে বলে তার মায়ের যে কত বকুনি শুনতে হত। বাইরে কোথাও যাবার আগে মেয়েটার মা শাসিয়ে বলত তোমার এমনি এমনি হাসি বন্ধ করবা আর হাসলেও সবার সামনে লাউবিচির মতন বড় বড় দাঁত বের করে হাসবানা .....এমন কথা শুনে মেয়েটার দমে যাবার কথা,সেটা না করে সে আরো হেলে দুলে আকাশ-পাতাল এক করে হাসত। ভাবত জীবনটা বুঝি এভাবেই কেটে যাবে আর সে বোধহয় কখনোই বড় হবেনা। একটা সময় তো মেয়েটা রীতিমতন হা-হুতাশ করত কেন তার বয়স বাড়ছেনা। আসলে তো ঠিকই বয়স বাড়ছে কিন্তু বাস্তবতার গ্যাঁড়াকলে পড়েনিতো তাই এমন অপরিণত ভাবনা ছিলো।মেয়েটার বড় ইচ্ছা ছিলো পড়াশুনা একটানে শেষ করে কিন্তু তার বাবা-মা'র মনে ভাবনা আসলো বয়স হলেই বিয়ে দেওয়া উচিত পরে কি হয় কে জানে আর পড়াশুনাতো বিয়ের পরও করে অনেকে। একদিন বিয়েও হয়ে গেল .....কেউ বুঝলোনা বিয়ের সময় মেয়েটার কেন জানি অনেক মন খারাপ ছিলো। বিয়ের স্টেজে বসে একবার তো মনেও হয়েছে দৌড়ে গিয়ে কোথাও ডুব দিয়ে থাকতে....।
মেয়েদের জীবনে দুইটা অধ্যায় থাকে ....প্রথমটা হলো বিয়ের আগে নিজের বাবা-মা,ভাই-বোন আত্মীয় স্বজনদের সাথে। দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয় বিয়ের পর স্বামী আর শ্বশুরবাড়ীর সাথে। ছোট্ট পরিসরে বড় হওয়া মেয়েটার বিয়ে হলো যৌথ পরিবারে। প্রথমে মানিয়ে নিতে কষ্ট হত....অনেক মানুষ,একেকজনের আলাদা আলাদা মানসিকতা....সবাই বুঝে খুশী করে চলতে গিয়ে মাঝে মাঝে হাপিয়ে যেত।তারপর ও স্বভাবসুলভ চপলতা ছাড়তে পারেনি। অকারণে হাসাহাসি করার জন্য শ্বশুরবাড়ীতে ও একটা সময় কথা শুনতে হত। সকালে ঘুম থেকে উঠেই কাজ সেরে ক্লাশে যাওয়া,বিকেলে ফিরে একটু পরেই আবার প্রাইভেটে যাওয়া,বাসায় ফিরে ঘরের কাজ করা....মা মাঝে মাঝে অভিযোগ করলে এরই মাঝে এক ফাকে বাবার বাসায় যাওয়া.....সারাটা সময় দৌড়ের উপর থাকতে থাকতে রাতে মেয়েটার ঘুমাতে গিয়ে মনে হত পৃথিবীটা তার কাছে বড্ড ছোট হয়ে আসছে।
বিয়ের পর প্রথম পহেলা বৈশাখে মেয়েটা সারাটাদিন রিক্সায় করে ঘুরে বেড়াল। সাথের মানুষটা যত বিরক্ত হচ্ছে ঘুরতে সে ততই আনন্দ নিয়ে ঘুরছে।সারাদিনের ক্লান্তির পরে ঘুমাতে গিয়ে কিছুক্ষণ পরেই তীব্র ব্যথায় কুঁকড়ে ঘুমটা ভেংগে গেল। সারাটাদিনই এমনটা হালকা ব্যাথা অনুভব করেছে... ভেবেছে মাসের কয়েকটা দিন মেয়েদের একান্তই নিজস্ব কিছু ব্যাপার থাকে,তেমনকিছুই হবে। চরম কষ্ট নিয়ে পর পর দু'টা সপ্তাহ কাটানোর পরও যখন কষ্ট বাড়তেই থাকলো.....গাইনি ডাক্তারের কাছে যাবার পর মেয়েটা তার জীবনের চরম ভালো আর খারাপ দুটা সংবাদই একসাথে শুনলো.....মেয়েটা কনসিভ করেছে কিন্তু ব্যাপারটা সময়মত বুঝতে পারেনি সেই সাথে ক্লাশে কন্টিনিউ রিক্সায় করে যাওয়া-আসার ফলে ক্রমাগত ব্লিডিং হতে হতে মিসক্যারেজ হয়ে গেছে । মেয়েটাকে আরো অবাক করে দিয়ে ডাক্তার জানালো সম্ভব হলে তাড়াতাড়ি ওয়াশ করতে নাহলে পরবর্তীতে কনসিভে প্রবলেম হবে। তার মা যখন তাকে ডাক্তারের রুমে বেডে শুইয়ে দিয়ে আসলো...একটু পরে হুট করে মেয়েটা বাইরে এসে মা-কে বলে আমার বাবুটার কিছু হয়নি ...বাসায় চলো বলে কারো অনুরোধই কানে তুললো না। প্রথম কয়েকটাদিন একটু কান্না পেলনা মেয়েটার। তার কেবলই মনে হত লাগলো বাবুটার নাড়াচাড়া সে বুঝতে পারছে......পাগল মেয়েটাকে কে বুঝাবে দুইমাস বয়সী ভ্রণের নাড়াচাড়া অনুভব করা যায়না। কতটা রাত মেয়েটা না ঘুমিয়ে কেঁদেছে বাবুটার কথা ভেবে। সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছে যখন মা সমান শ্বাশুড়ী সরাসরি অভিযোগ করেছে এই জামানার মেয়েদের তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিতে চায়নি বলে ইচ্ছা করেই নষ্ট করে ফেলেছে।
৭ বছর পরে
৭বছর পরে অনেককিছু বদলে গেছে ...মেয়েটার এখন একটা ছেলে আছে....তাকে পৃথিবীতে আনতেও অনেক কষ্ট হয়েছে,সেটা আরেক গল্প। তারপর মেয়েটা কি জানি এক অপূর্ণতায় ভুগে। কেউ যদি তাকে প্রশ্ন করে তোমার কি একটাই বাবু তখন সে মনে মনে বলে না আমার দুইটা বাবু । হয়ত তার পৃথিবীতে আসাই হয়নি তবুও মেয়েটা প্রায়ই মনে মনে বাবুটার চেহারা কল্পনা করতে চায় আর ভাবে সে কি মেয়ে বাবু হ্ত কিংবা এখন তো স্কুলে গেলে ক্লাশ ওয়ানে পড়ত। ৭ বছর আগে করা দুই মাস বয়সী বাবুটার আলট্রাসনোর মধ্যে কালো ছাড়া কোন ছবি আসেনা তা-ও মেয়েটা সহজেই যেন তার বাচ্চাটার একটা মুখ আঁকতে পারে ।এরপর অনেকগুলো পহেলা বৈশাখ আসলো আর গেল মেয়েটার আর ইচ্ছা হয়না বের হতে । সময়ে সবকিছুই বদলে যায়....শুধু মেয়েটার তার অনাগত বাবুকে নিয়ে স্মৃতিগুলো আর বদলায় না....।
..............................................................................................
(লেখাটাতে মেয়েটার নির্দিষ্ট কোন নাম থাকতে পারত। কিন্তু এটা কোন একজন মেয়ের গল্প না....প্রথম কনসিভের সময় অনেক মেয়েরই এভাবে মিসক্যারেজ হয়। অনেকে ঠিকমত বুঝতেই পারেনা,তার আগেই এমনটা ঘটে। সেইসময় সবচেয়ে যেটা দরকার মেয়েটার পাশে থাকা। অনেকেই পরে আরো বাবু হলে এমন ঘটনার কথা ভুলে যায় এবং সেটাই উচিত। কিন্তু গল্পের মেয়েটা ভুলতে পারেনি। মাতৃত্বের স্বাদ সে পেয়েছে ঠিকই কিন্তু কোথায় জানি একটা অপূর্ণতা থেকেই গেল....হয়ত অনাগত বাবুটারে পৃথিবীর মুখ দেখাতে পারেনি বলে অপরাধবোধের বোঝাটা সবসময় তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়)