শরতের এক নির্মল সন্ধ্যা। যানজটের শহরেও সেদিন কেন জানি পরিবেশটা অতিরিক্ত সুন্দর। শুক্রবার দিনটাও ছুটির, একই দিনে ঢাকাবাসী দুটি বৃহৎ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। পুরো শহরে উৎসবের সীমা নেই। একদিকে আর্মি স্টেডিয়ামে সানি লিওনির একক ড্যান্স, আরেকদিকে শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ। দুটি অনুষ্ঠানই শুরু হবে বাদ জুম্মা। ঢাকাবাসী যার যার মতো প্রস্তুতি নিয়ে যথাসম্ভব আগেই পৌঁছে গেল।
আজান-নামাজ সমাপ্ত হল, হেফাজতের নেতারা মঞ্চে উঠলো। সামনে হাজারো মাদ্রাসার ছাত্র ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। পবিত্র কোরান হতে পড়া হবে সুরা আর-রাহমান। ......ফাবি আইয়্যি আলা ই রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান।
ওদিকে আর্মি স্টেডিয়ামের মঞ্চে ঝর তুলছেন সানি। সেদিন যেন তিনি একটু বেশিই কাপড় তুলেছেন গায়ে। সর্বাঙ্গ খুলে রেখে, ঢেকে রেখেছেন স্তনবৃন্ত, যোনিপথ আর নিতম্ব। রঙ্গে ঢঙ্গে চিত্তস্পন্দী, রুপময়ী, ভ্রুভঙ্গে লাস্য, আর দৃষ্টিতে সুধাবর্ষণ করে সানি শুরুটা করলেন লায়লা মে লায়লা দিয়ে। ওর বক্ষদেশের উর্ধ্বাংশ প্রায় বেরিয়ে আসলো, থলথলে নিতম্ব কাঁপিয়ে মাতাল করে দিল তরুণদের। সমানতালে শাপলা চত্বরে তখন তেলাওয়াত হচ্ছে বাইনাহুমা-র্বাযাখুল লা-ইয়াবিগয়ান………।
দুটি অনুষ্ঠানই শেষ হল দুটি ঘোষণা দিয়ে। বাবুনগরী দেশের কাকে কাকে কতল করতে হবে, কে কে মুরতাদ, ভাষ্কর্য্যগুলো কবে কখন কিভাবে ভাঙতে হবে, নারীরা কি পোশাক পরবে তিনি ঠিক করে দিলেন, দেশব্যাপী সবাইকে জিহাদে অংশ নিতে বললেন। ওদিকে সানি লিওনির সমাপনী বক্তব্যে পৃথিবীতে ভালোবাসার ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়ার উদাত্ত আহ্বান জানালেন। ও হ্যাঁ, জুনায়েদ বাবুনগরী সানি লিওনিকেও যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই হত্যা করার নির্দেশ প্রদান করলেন।
ঘটনাটি কাল্পনিক, কিন্তু সানি লিওনির অনুষ্ঠান বাদে বাকি সবই কি আমাদের কাছে পরিচিত নয়? উক্ত কাল্পনিক ঘটনায় জুনায়েদ বাবুনগরী এবং সানি লিওনি দুজন যদি দুটি ধর্মের নবী হন, শুভবাদী নীতিবাদী সৎ মানবিক মানুষ হিসেবে কোন ধর্মটি আপনি গ্রহণ করবেন?
সবার মনে থাকার কথা, করোনার প্রায় শুরুর দিকে বাংলাদেশে এক ডাক্তারের আবির্ভাব হল। ফেসবুকে প্রত্যহ ভিডিও প্রকাশ করে তিনি চ্যালেঞ্জ দিতে থাকলেন, দেশে করোনা যাবে না, দেশের আবহাওয়া করোনার অনুকূলে নয়। তাঁর কথা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ভাদ্র মাসে প্রজননের স্বার্থে কুকুর যৌনকাতর হয়ে পড়ে, পৌষে পাগল হয় হুজুরকুল। এবার ওরা পাগল হল করোনার শুরু থেকেই। কেউ অক্সফোর্ডের ডিগ্রি আনলেন, কেউ এন্টার্কোটিক মহাদেশ আবিষ্কার করে করোনার গাণিতিক ফর্মুলা দিলেন, কোরান হাদিস দেখিয়ে বলা হল মুসলমানের করোনা হলে কোরান মিথ্যে হয়ে যাবে, আরো কত কি।
পরিশেষে দেখা গেল ওই ডাক্তারের মত মোল্লাদের কথাও সর্বাংশে মিথ্যা। করোনার ভ্যাক্সিন আকাশ থেকেও আসলো না, মন্দির-মসজিদ থেকেও না। ইহুদি নাছারার দেশের ল্যাবরেটরি থেকে বের হল ভ্যাক্সিন। মিথ্যে অনুমান করে সেই ডাক্তার লাপাত্তা সেই বহুদিন থেকেই, লজ্জা পেয়েছেন তিনি, কিন্তু মোল্লাদের কাল্পনিক গলাবাজি কি থেমেছে একটুও? এখানেই রুচির প্রশ্ন। করোনার শুরুর দিকেও বাংলাদেশের মত একটি আইন মানতে অনীহ দেশে প্রায় সবাইকেই দিয়ে করোনার নিয়ম কিছু হলেও মানানো গেছে, কিন্তু এই মোল্লাদের কি দেশের আনাচে কানাচে হাজারো মানুষ নিয়ে সমাবেশ আয়োজন থেকে বিরত রাখা গেছে? কারণ এখানে ইসলামের প্রচার, মানুষের উপকার এসব সীমাহীন গৌণ বিষয়, মূল বিষয় ইসলাম বিক্রি করে অর্থ উপার্জন।
মোদি আসবে, আমরা অবশ্যই কেউ খুশি না। বহু মানুষ এর জোর প্রতিবাদ করেছে। ওর হাত মানুষের রক্তে রাঙ্গা। তবু যদি জোর করে কেউ এসেই যায়, তখন ভদ্রলোকের করণীয় আর কী থাকে? বড়জোর রাস্তায় ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে আমরা প্রতিবাদ করতে পারি। কিন্তু শুধু দাঁড়িয়ে জিহাদ হয় না। তার জন্য দরকার দেড় হাজার বছর আগের ঢাল তলোয়ার আর ঘোড়া। সবকিছু নামিয়ে সারাদেশ কুরুক্ষেত্র হল, ঝরে গেল ১৭ টি অমূল্য প্রাণ।
হত্যার এই নিষ্ঠুরতা অমানুষিক আর অপ্রয়োজনীয়। বন্ধু লিস্টে যাঁদের তালেবানপন্থী হিসেবে জানি, আইএস, পাকিস্তানের প্রতি যাঁদের সহানুভূতি আছে, শুধুমাত্র তাদেরকেই দেখলাম এতগুলো লাশের প্রতিবাদ করতে। তসবিহ তেলাওয়াতের মত হররোজ যারা মানবাধিকার বলে জপ করেন, তাঁদের কোন প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ল না। এর বিপরীতে সরকারপালিত এক পাল বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দিলেন, যাতে তারা হেফাজতকে শক্ত হাতে মুকাবিলা করতে বললেন। একটিবারও নিহতদের কথা সেখানে উল্লেখ নেই। ’৯১ সালের ঘূর্ণিঝরে আক্রান্ত এলাকা পরিদর্শন করতে গিয়ে নির্ভীক বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা বলেছিলেন, একটি মানুষও যদি অপঘাতে মারা যায়, তাহলে সকল মানুষের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়া উচিত। জীবনের গুরুত্ব বোঝাতে তিনি এটি বলেছিলেন।
দুদিন আগে এক হেফাজতি হোটেলে নারীসহ ধরা খেলেন। হতে পারে তিনি তাঁর স্ত্রী, নাও হতে পারে। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে একটি শ্রেণীকে দেখা যাচ্ছে ওই মহিলা ওই নেতার স্ত্রী-ই এটি তারা জানেন। মামুনুলের আসল স্ত্রী বাদে বাকি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও তা জানে। তাই আসল স্ত্রীকে বলতে হয়, ওটি ছিল শহীদুলের স্ত্রী, ঘটনাচক্রে আমার স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতে হয়েছে, তুমি কিছু মনে করোনা।
বাংলাদেশে ক্ষুদ্র হলেও একটা গোষ্ঠী ধীরে ধীরে তাদের শক্তিবৃদ্ধি করে চলেছে যারা ভাবতে শিখেছে এইভাবে- আমার পীরবাদ পছন্দ নয় বলে তাদের মেরে ফেল, আমার গানবাজনা পছন্দ নয় তাই তারা ধর্মের শত্রু, আমি শিয়া নই তাই শিয়ারা মুরতাদ, আমার ভাষ্কর্য্য পছন্দ না, তাই অন্যের করা ভাষ্কর্য্য আমাকে ভাঙতেই হবে, আমি সমকামী নই তাই ওদের স্পাইনাল কর্ড আমার চাপাতির লক্ষ্য! এঁদের সমর্থক কারা? সদ্য প্রয়াত বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছিলেন, ঢাকা শহরের প্রতিটি লোকাল বাসের ভেতরের পরিস্থিতি যেন একটি বাংলাদেশ। তাঁর কথা ঘুরিয়ে বলা যায়, প্রতিটি নিউজের কমেন্ট সেকশন এখন বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করে। সেদিন মমতাজের এক গানের নিচে এক ব্যক্তির কমেন্ট ছিল এরকম-- আপু আপনার গান অনেক পছন্দ করি, কিন্তু জানতে পারি কি আপনার মেয়ে দুটোর বাবা কে? হেফাজতিদের প্রতি সহানুভূতিশীলদের আপনি কি এই কমেন্টোকারীর থেকে চুল পরিমাণ বুদ্ধিমান মনে করেন?
শেষ করি একটা ঘটনা দিয়ে। ২০১৩ সালে রাজাকারদের বিচারের দাবীতে শাহবাগ আন্দোলনকে দমাতে হেফাজত প্রধান শফি ৮৪ জনের লিস্ট করে বলল এরা সবাই মুরতাদ, তাঁদের জবাই করতে হবে। এরপরে সেই লিস্ট ধরে ধরে কথামত বেশ কজনকে খুন করাও হল। যারা বেঁচেছিলেন তাঁদের কেউ কেউ পরে জার্মানিতে চলে আসে। শফীর লিস্টে থাকা
এক ব্লগার একদিন ব্যক্তিগত কথায় আমাকে জানালেন, তাঁর নাম যখন হেফাজতের মুরতাদ লিস্টে উঠেছিল তখন তিনি নাস্তিক ছিলেন না, ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। আবুজার গিফারি রা: থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে বলা হয়েছেঃ ‘কোনো ব্যক্তি অপর কোনো ব্যক্তিকে মুরতাদ বলে অভিযুক্ত করল, অথচ এটি সত্য নয়, তাহলে ওই অভিযোগ তার ওপরই বর্তাবে।’ এই হাদিস এবং ওই ব্লগার আমাকে যা বলেছিল তা যদি সত্যি হয় তাহলে তেঁতুল তত্ত্বের মত ন্যাক্কারজনক তত্ত্বের জনক শফি মুরতাদ হয়ে মারা গেছেন।
অন্ধকারের এই অপশক্তি হেফাজতিতের প্রতি সহানুভূতিশীলরা কি হাদিস অস্বীকার করবেন নাকি ওই ব্লগারের কথা? নিজের মনকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য ব্লগারকে অবিশ্বাস করতেই পারেন। কিন্তু আমি আপনি কি মানুষের মন পড়তে পারি? কী কারণে আমাদের এত গরিমা এত আত্মবিশ্বাস?
সোমবার, ০৫ এপ্রিল ২০২১
বার্লিন থেকে জাহিদ কবীর হিমন
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০২১ ভোর ৫:১০