somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অতিপ্রাকৃত গল্পঃ জঙ্গল মঙ্গলপুর

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাত ৯:৩৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ছবিঃ Shutter stock

-ধুর শালা। মুখ দিয়ে আরেকটা অশ্রাব্য গালি বের হল মারুফের।
আরেকবার চেষ্টা করল। কয়েক সেকেন্ড 'গো, গো' করে আবার থেমে গেল ইঞ্জিনটা।
- াল আমার।
ফোনটা বের করল পকেট থেকে। No Service.
হায়, হায়। কি হবে এখন?
বাইরে তাকাল মারুফ। নির্জন রাত। হাইওয়েতে উঠেছে অনেকক্ষণ হচ্ছে। কোথায় আছে, বোঝা যাচ্ছে না। ফোনে সিগন্যাল থাকলে অন্তত লোকেশান দেখা যেত ম্যাপে।
আবার ফোনের স্ক্রীনের দিকে তাকাল ও। এই ‘Yes Sir’ এর দেশে সার্ভিসের 'No' টা 'Yes' হওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
-আছি কোথায়? নিজেকেই প্রশ্ন করল মারুফ।
কোন জবাব এল না। আসার কথাও না।
গাড়ি থেকে নামল মারুফ।
নির্জন রাত। হাতঘড়ির দিকে তাকাল একবার। ঘড়ির ডায়ালটা পর্যন্ত ঘোলা হয়ে গেছে!
-অ্যাঁ!
আবার চারিদিকে তাকাল মারুফ। এক ঘন্টার বেশি হয়ে গেছে, অথচ সামনে-পেছনে-বিপরীত দিকে থেকে আসা কোন গাড়ি চোখে পড়েনি। চারপাশে সুনসান নীরবতা। এ কেমন হাইওয়ে? অদ্ভুত!
আশেপাশে কোন বাড়িঘর বা দোকান-পাট নেই।
রাস্তার দুধারে শুধু খালি জমি। এককালে কৃষি হলেও হয়ে থাকতে পারে, এখন শুধুই পতিত জমি। অন্তত অন্ধকার রাতে হেডলাইটের আলোয় তা-ই মনে হচ্ছে।
-মানে কি? এ কোথায় এসে ইঞ্জিন বন্ধ হল? আবারও হাওয়ায় প্রশ্ন ছুড়ে দিল মারুফ।
এবারও কোন মানুষের জবাব এল না, তবে একটা তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এল।
চিৎকার? এটাকে কোনভাবেই চিৎকার বলার সুযোগ নেই। যা শুনল মারুফ, তাকে শুধু একটা শব্দ দিয়েই বর্ণনা করা যায়। গর্জন!
-ইয়া মাবুদ, মাফ কর। পাল্টা চিৎকার দিয়ে গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল মারুফ।
দরজাটা লক করল, দোয়া দরূদ পড়তে শুরু করল।
অদ্ভুত। দীর্ঘদিনে চর্চাহীনতায় কোন দোয়াই আজ আর মুখে আসছে না ঠিক মত।
আরেকবার লক চেক করল ও। হ্যা, দরজা বন্ধই আছে।
'ঘড়, ঘড়'। মনে হচ্ছে একটা চাপা গর্জন যেন এদিকেই এগিয়ে আসছে ধীর পায়ে।
শার্টের হাতা দিয়ে গাড়ির ঘোলা কাঁচ পরিস্কার করতে শুরু করল মারুফ। সেপ্টেম্বর মাস শুরু হয়েছে কি হয়নি, অথচ এখানে কি অবস্থা? কুয়াশায় চারপাশ ধোয়াটে হয়ে গেছে।
কোথায় আছে ও?
রেডিও চালু করল মারুফ। কোন চ্যানেলই টিউন করা গেল না। এখানেও No Service!
-তাম্মায়রে …। তৃতীয়বারের মত গালি দিতে গিয়ে নিজেকে থামাল মারুফ। সেটা কোন অজানা জন্তুর ভয়ে নাকি অন্যকোন কারণে-সে নিজেও নিশ্চিতভাবে জানে না।
ঠিক তখনই দরজার কাচে টোকা পড়ল।
-কি সমস্যা? ইঞ্জিন বন্ধ? নাকি তেল শেষ?
অবশেষে মানুষের কন্ঠ শুনে যেন জানে পানি ফিরে এল মারুফের।
বাইরে তাকাল সে। গায়ে চাদর জড়ানো একটা মানুষ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এই লোকটাই টোকা দিয়েছে।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল মারুফ।
-টুরিস্ট? মাঙ্কি ক্যাপের নীচ থেকে জানতে চাইল লোকটা।
-এটা কি টুরিস্ট স্পট? পালটা প্রশ্ন করল মারুফ।
-না। ঠোঁট দেখা না গেলেও এবার চোখ দেখেই লোকটার হাসি বুঝতে পারল মারুফ। সেজন্যই জানতে চাইলাম। এতরাতে একা মানুষকে দেখে অবাক হয়েছি।
কাজের মানুষ বলেই মনে হচ্ছে লোকটাকে। কথার ফাঁকে ফাঁকে এরই মধ্যে গাড়ির বনেট খুলে ফেলেছে লোকটা।
লোকটা কি ম্যাকানিক?
তা কি করে হয়? এই জনমানবহীন এলাকায় কি করে খাবে তাহলে?
-আপনি ম্যাকানিক?
-না।
-তাহলে?
লোকটা জবাব দিল না। একমনে ইঞ্জিন আর কিসন প্লাগ-চেক করতে শুরু করল।
-আপনি ম্যাকানিক? কিছু বলছেন না যে?
-আসলে মেশিন আর জীবজন্তুর প্রতি আমার আলাদা ভালবাসা আছে। দেখলেই কেমন যেন একটা টান অনুভব করি। আমার কি মনে হয় জানেন? আমি হয়ত ওদের ভাষা বুঝতে পারি।
-তাই নাকি?
লোকটা কি মারুফের ব্যাঙ্গাত্মক টোনটা ধরতে পেরেছে? মনে হয় না।
-হ্যা। সেজন্যই এই জঙ্গলে পড়ে আছি। ঠিক করেছি, এই গাছ আর অবলা জন্তুগুলোর মাঝেই নিজের বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব।
-কি বলছেন এসব? এখানে জঙ্গল কোথায়? আর জন্তুই-বা কোথায়? চারদিকেতো শুধু ধূ ধূ বিরানভূমি।
-কেন? মানুষকে জন্তু মনে হয় না? লোকটা একবার মারুফের দিকে তাকিয়েই আবার মনযোগ দিল ইঞ্জিনের দিকে।
-মানে কি?
-মানে অন্য সব পশুর মত মানুষও একটা পশু, শুধু বুদ্ধিমত্তা আর শয়তানিটা মাত্রা ছাড়ানো আর কি। বলতে বলতে নীরবে হাসতে শুরু করল লোকটা, হাসির ধাক্কায় তার পুরো শরীরটা ধীরে ধীরে কাঁপতে শুরু করল।
-মজা নিচ্ছেন?
-এমন জায়গায় থাকি, মজা নেওয়ার জন্য মানুষও পাই না।
-তা এখানে থাকেন কেন? কথাবার্তা শুনে বেশ শিক্ষিত বলেই মনে হচ্ছে আপনাকে।
-শিক্ষিত? হ্যা, আপনাদের ওসব কেতাবী শিক্ষায় একসময় দীক্ষিত হয়েছিলাম বটে, তবে ওসবের এখন আর কোন মূল্য নেই আমার কাছে। প্রকৃতির কাছেই আছে আসল শিক্ষা। সেজন্যই এখানে চলে এসেছি।
লোকটার কি মাথায় সমস্য?
-কথাবার্তা শুনেতো তা-ই মনে হচ্ছে।
বিপদজনক?
-তা অবশ্য মনে হচ্ছে না।
সরে যাবে এখান থেকে?
-সুযোগ নেই। গাড়িটা ঠিক না হলে অন্যকোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই। তাছাড়া লোকটা যদি সত্যি সত্যি গাড়িটা ঠিক করে দিতে পারে, মন্দ কি? একটা পাঁচশ টাকার নোট ধরিয়ে দিলেই হবে।

-কিছু বললেন? লোকটা জানতে চাইল।
-না তো। বলল মারুফ। কেন?
-মনে হল যেন আপনার ঠোঁট নড়ল।
-নাহ।
-আমারই ভুল হয়েছে হয়ত।
-আচ্ছা।
-বলুন।
-এটা কোন জায়গা?
-এটা 'জঙ্গল মঙ্গলপুর'।
-জঙ্গল মঙ্গলপুর? এটা আবার কোন জায়গা? ম্যাপেতো এমন কিছু দেখিনি।
-গুগল ম্যাপের কথা বলছেন?
বাহ, লোকটা গুগল ম্যাপের কথাও জানে? একেবারে গণ্ডমূর্খ বলা যাচ্ছে না তাহলে।
-হ্যা। জবাব দিল মারুফ।
-শুধু গুগল ম্যাপ কেন, কোন সরকারী ম্যাপেও এই জায়গা পাবেন না।
-তাই নাকি? কেন?
-লোকে বলে, এই জায়গার আত্মা আছে। সবাই নাকি এই জায়গার খোঁজ পায় না, কেউ কেউ পায়। যারা পায়, তাদের কেউ কেউ এখানে থেকে যায়, বাকিরা আটকা পড়ে। খুব কম লোকই এখান থেকে বেরোতে পারে।
এতক্ষণ খুব মনযোগ দিয়ে লোকটার কথা শুনছিল মারুফ, এবার হঠাৎ করেই চারপাশ কাঁপিয়ে 'হো হো' করে হাসতে শুরু করল।
লোকটা কেমন যেন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।
-কি হল? হঠাৎ এভাবে হাসতে শুরু করলেন যে?
-আপনার কি খারাপ লেগেছে? আচ্ছা, তাহলে সরি। আপনি আমার উপকার করে গাড়ি ঠিক করার চেষ্টা করছেন, সেখানে আমার এভাবে হাসাটা একদম উচিত হয়নি। আবার সরি।
জবাবে লোকটা কিছু বলল না, তাকিয়ে রইল মারুফের দিকে। হয়ত মারুফের কাছে এরকম বিকট হাসির ব্যাখ্যা চায় সে।
-দেখুন, আমি এলাকার লোক নই। গভীর রাত, হাইওয়ের মাঝখানে আমি গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। আশেপাশে কোন মানুষ বা বসতির দেখা নেই। হঠাৎ করে কোনরকম বলা-কওয়া ছাড়াই আপনার আবির্ভাব। একেবারে আইডিয়াল হরর মুভি সেটাপ। আপনিও হয়ত ভেবেছেন আমাকে ভয় দেখিয়ে একটু মজা নেবেন। আপনাকে কিন্তু আগে একবার বলেছি, আমার সাথে মজা নেওয়ার কিছু নেই। তারপরও আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছেন বলেই এভাবে হেসে উঠেছি। আমি ভয় পাওয়ার লোক নই।
-আপনি ভয় পাওয়ার লোক নন-খুব ভাল কথা। আমিও আপনাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করিনি।
-তাই নাকি? তাহলে এই 'জঙ্গল মঙ্গলপুর' কাহিনীর অর্থ কি? বাস্তবে আছে, কিন্তু কোন ম্যাপে নেই, সবাই এই এলাকার খোঁজ পায় না-এই কথার মানে কি?
-তাহলে আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেন নি?
-করা কি উচিত? এলাকার নাম 'জঙ্গল মঙ্গলপুর', তা বাপু সেই জঙ্গলটা কোথায়? চারপাশেতো পতিত জমি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।
-এই রাস্তা ধরে সোজা মেইল দুয়েক গেলেই রাস্তার দুপাশে পাহাড় দেখতে পাবেন। রাস্তার দুপাশে পাহাড় না, বলা উচিত পাহাড়ের বুক চিড়ে হাইওয়ে বানানো হয়েছে। সেখান থেকেই জঙ্গলের শুরু।
-ঠিক আছে ভাই, অনেক মজা হয়েছে। এবার থামুন। আর কিছু দূর গেলে পাহাড় শুরু হবে-সে আমিও জানি। তবে সেগুলো সব পাথুরে, ন্যাড়া পাহাড়। জঙ্গলের 'জ'-ও নেই সেখানে।
-তাহলে আমার কথা বিশ্বাস করছেন না?
-সরি ব্রাদার। অবিশ্বাস্য কোন গল্প আমি বিশ্বাস করতে রাজি নই।
লোকটা কোন জবাব দিল না, হঠাৎ আবার শোনা গেল সেই দানবীয় গর্জন।
-এটা কিসের চিৎকার? কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জানতে চাইল মারুফ।
-আমি বললেই কি আপনার বিশ্বাস হবে? তারচেয়ে বরং কিছু না বলাই ভাল।
এবার আর লোকটার টিটকারী গায়ে মাখল না মারুফ।-আপনার কাছে মোবাইল আছে? আমারটায় সিগনাল পাচ্ছি না।
লোকটা কোন জবাব দিল না, শুধু হাসল।
-হাসলেন যে?
-আশেপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে কোন ফোনের টাওয়ার নেই। মানে নেটওয়ার্ক কভারেজ নেই আরকি।
-হোয়াট? তাহলে, আপনি বাকিদের সাথে যোগাযোগ করেন কিভাবে?
-এই দুটো দিয়ে। লোকটা নিজের দুই পায়ের দিকে ইঙ্গিত করল। যখন যেখানে দরকার হয়, এগুলো দিয়েই চলে যাই। আর কাউকে কিছু বলা লাগলে এগুলো দিয়ে বলি। এবারের ইঙ্গিত নিজের ঠোঁটের দিকে।
বোঝাই যাচ্ছে, অনেকদিন একা একা থাকতে থাকতে লোকটার আচার-আচরণের মধ্যে বেশ অস্বাভাবিকতা চলে এসেছে। কিন্তু সে নিজে সেটা অনুভব করতে পারছে না।
-কিছু কি বললেন? আবার জানতে চাইল লোকটা।
-না।
-কি জানি? কেন যেন মনে হচ্ছে, ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলছেন আমাকে।
-না কিছু বলিনি। বলতে বলতে বনেটের পেছনে ঢাকা পড়া লোকটার চেহারা দেখার চেষ্টা করল মারুফ। সমস্যাটা ধরতে পেরেছেন?
-মনে হচ্ছে?
-ঠিক করতে পারবেন?
-আশা করি।
অবশেষে একটা ভাল খবর আজকের রাতে।
-একটা প্রশ্ন করব? আবার কথা শুরু করল লোকটা।
-এতরাতে আপনি এখানে কেন? কোথায় যাচ্ছেন?
লোকটাকে সত্য কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল মারুফ। এই প্রকৃতির ছাত্রের কাছ থেকে খবর লিক হওয়ার কোন সুযোগই নেই। তাছাড়া দীর্ঘকাল একা থাকতে থাকতে লোকটার আচার আচরণে যে অস্বাভাবিকতা চলে এসেছে, তাতে গালি ফাটিয়ে চিৎকার করলেও কেউ সহজে তার কথা বিশ্বাস করবে না।
-আসলে, আমরা একটা নতুন প্রজেক্ট পেয়েছি। ওটার কাজের জন্যই যাচ্ছি।
-প্রজেক্ট? কিসের প্রজেক্ট?
-পেশায় আমি নিজে একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, তবে এখন বেসিকালি ঠিকদারি করি। আপনিওতো শুধু মজাই নিলেন, তাই শিওর করে বলতে পারছি না কোথায় আছি, তবে আশা করি কাছাকাছি পৌছে গেছি আমাদের প্রজেক্ট এরিয়ার।
-কিসের প্রজেক্ট, সেটাইতো বললেন না এখনও।
-সরকার এখানে একটা বাঁধ নির্মানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। বাঁধ নির্মাণের কাজটা আমরা পেয়েছি।
-বাঁধ? সেকি? কোথায়?
মোবাইল থেকে বাধের লোকেশানটা দেখাল মারুফ।
-যেখানে ‘X’ মার্ক করা, ওখানে।
-সেকি? ওখানেতো আদিবাসীদের গ্রাম আছে। নদীর এখানে বাঁধ দিলে ওদের অন্তত ছোট-বড় শখানেক গ্রাম তলিয়ে যাবে।
-আমি যদ্দূর জানি, উপজাতিদের রিলোকেট করার জন্য সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে।
-উপজাতি নয়, আদিবাসী।
-যার যা মনে হয় আরকি।
লোকটা এক মুহূর্তের জন্য বনেটের আড়াল থেকে মুখ বের করে তাকাল মারুফের দিকে, তারপর আবার ডুবে গেল বনেটের নীচে।
মারুফের কেন যেন মনে হল, লোকটার চোখ জ্বলে উঠেছিল।
আসলেই কি তাই? নাকি ঘুম ঘুম চোখে মারুফ ভুল দেখছে?
হাই তুলল মারুফ। ঘুম পাচ্ছে।
এখনও পৌছানো গেল না, অথচ ঘুম আসছে।
রাত বাড়ছে। আড়াল থেকে মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে চাঁদটা আবার ঢাকা পড়ছে মেঘের চাদরে। সময় বোঝা যাচ্ছে না।
আচ্ছা, বাজে কয়টা?
আবার ভুল করে হাতঘড়ির দিকে তাকাল মারুফ। ঘোলা ডায়াল, সময় দেখা যাচ্ছে না।
ইশ, যদি চা পাওয়া যেত এখন।
-সিগারেট খাবেন? লোকটা হঠাৎ জানতে চাইল।
-খুব চা খেতে মন চাচ্ছিল। সাথে একটা সিগারেট হলে খুব জমত। বুঝলেন কিভাবে?
-নিন। বনেটের আড়াল থেকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিল লোকটা। মাত্র দুটো সিগারেট আছে প্যাকেটে। একটা নিল মারুফ।
-তা আজ এই মাঝরাতে একা একা যাচ্ছেন কেন প্রোজেক্ট এরিয়ায়? আগামীকাল দিনেও যেতে পারতেন।
-কারণ আছে। কনফিডেনশিয়াল। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল মারুফ।
-বলা যায়? অবশ্য যদি কোন সমস্যা না থাকে আরকি।
-না, না, সমস্যা কিসের? আমাদের প্রোজেক্টটা ফাইনাল হয়ে গিয়েছিল, তবে স্থানীয় এক লিডার বাগড়া দিতে চেষ্টা করছে। লোকটা প্রথমেই বাঁধা দিতে চেষ্টা করেছিল, আমি অবশ্য জায়গামত মালপাতি খাইয়ে তখন সব ম্যানেজ করেছি। এখন সে আবার স্থানীয় লোকজনকে ইন্ধন দিচ্ছে আমাদের বিরুদ্ধে।
-কেন?
-আরে, বোঝেন না, সব টাকা খাওয়ার ধান্ধা। প্রজেক্ট পাস হয়েছে আগের এমপি’র আমলে, তার পকেট ভরে দিয়েছিলাম তখনই। সেই হারামজাদা ফট করে মরে গেল, এই নতুন হারামজাদাটা স্বতন্ত্র দাঁড়িয়ে গেছে। আমাদের প্রজেক্ট হলে সব তলিয়ে যাবে, এই হবে, ওই হবে-এসব বলে পাবলিক ক্ষেপাচ্ছে। সব ভোটের ধান্ধা আরকি। এখন এরও পকেট গরম করা লাগবে।
-পারবেন?
-পারতেই হবে। পকেট গরম করতে না পারলে গলা নরম করতে হবে। এমন জায়গায় টাইট দেব, আমাকে চেনে না।
-আর আশেপাশের জঙ্গল? তার জীবজন্তু?
-হোয়াট?
-নাথিং। আপনার কাজ হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। একবার ড্রাইভিং সীটে গিয়ে বসুন, স্টার্ট দিন।
মারুফের মনে হল যেন কেউ তার কানে মধু ঢেলে দিয়েছে। সাথে সাথেই গাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল সে।
-স্টার্ট দেব?
-হুম।
প্রথমবারেই স্টার্ট হয়ে গেল গাড়িটা।
-ইয়েস। আনন্দে হঠাৎ বাচ্চাদের মত চিৎকার করে উঠল মারুফ।
আরে, লোকটা এখনও বনেট নামায় নি।
-অনেক ধন্যবাদ। গাড়ি থেকে নেমে এল মারুফ। এতবড় উপকার করলেন আমার, অথচ আপনার নামটাই জানা হল না।
আরে, লোকটা কোথায়?
বনেটের আড়ালে এখন আর কেউ নেই।
চলে গেছে?
তা কি করে হয়? এভাবে মুহূর্তের মধ্যে ভোজভাজির মত একটা লোক গায়েব হয়ে যাবে?
মানে কি?
ব্যাপারটা যথেষ্ট অস্বাভাবিক, কিন্তু তা নিয়ে এই মূহূর্তে মাথা ঘামানোর মত সময় নেই।
আবার ড্রাইভিং সীটে বসল মারুফ, স্টিয়ারিং ঘোরাতে শুরু করল।
অবাক কান্ড। গাড়ি মাইল দুয়েক চলেছে কি চলেনি, কুয়াশা কাটতে শুরু করেছে। চাঁদটাও মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে। চারিদিক ফকফকা। সব এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
-ইয়েস। আনন্দে আরেকবার চিৎকার করল মারুফ।
আরও দুটো ঘটনা ঘটল তখন। মোবাইলের 'No Signal' টা মুছে গিয়ে নেওয়ার্কের প্রথম দাগটা দেখা দিল।
সাথে সাথেই রেডিও অন করল মারুফ। হ্যা, এখন চ্যানেল টিউন করা যাচ্ছে। এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট শব্দ শোনা যাচ্ছে না, ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দ আসছে। আর কিছুদূর এগোলেই হয়ত ফুল স্ট্রেন্থ সিগনাল রিসিভিং শুরু হয়ে যাবে।
অভ্যাসবশত রিস্ট ওয়াচের দিকে তাকাল মারুফ। আরে, ঘোলা ডায়ালটা কখন পরিস্কার হয়ে গেছে, খেয়ালই করা হয়নি।
রাত দুইটা ছাব্বিশ।
ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা।
'বিদায় জঙ্গল মঙ্গলপুর'।
রাস্তার পাশে লাগানো বড় একটা সাইনবোর্ডে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা।
মানে কি?
ম্যাপে যে জায়গার অস্তিত্ব-ই নেই, সেখানে মারুফ এল কি করে?
শক্ত হাতে স্টিয়ারিং ধরল মারুফ, জোরসে চাপ দিল এক্সেলেরেটরে। গাড়ির পুরনো কলকব্জাগুলো যেন সব একসাথে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে চাইল, কিন্তু মারুফের পা একটুও আলগা হল না তাতে।
হ্যা, আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তারপরেই 'বিদায় জঙ্গল মঙ্গলপুর' লেখা সিনবোর্ডটাকে পেরিয়ে যাবে মারুফ।
কিন্তু এ কি?
শক্তহাতে মারুফ স্টিয়ারিং ধরে আছে, তবুও গাড়িটা সোজা না গিয়ে হঠাৎ বামদিকে বাঁক নিতে শুরু করেছে।
আশ্চর্য। এতক্ষণতো বামে কোন রাস্তা ছিল না, তাহলে এখন হঠাৎ কোত্থেকে আস্ত একটা রাস্তার উদয় হয়ে গেল কিভাবে?
গাড়িটাকে প্রাণপণে সোজা রাখার চেষ্টা করছে মারুফ, পারছে না।
গাড়ির কাঁচ আবার ঘোলা হতে শুরু করেছে। চাঁদটা আবার চলে যাচ্ছে মেঘের আড়ালে, শুন্য থেকে আবার কুয়াশা জাকিয়ে বসেছে চারপাশে।
ফগ লাইটটা কোনভাবেই জ্বালানো যাচ্ছে না, হেড লাইটের আলোও কমে এসেছে। থেমে থেমে জ্বলে উঠেই আবার নিভে যাচ্ছে।
পুরোপুরি নিভে যাওয়ার আগে হেড লাইটটা শেষবারের মত জ্বলে উঠল। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রাস্তার ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা, মাংকি ক্যাপের আড়ালে হাসিটা কোনভাবেই ঢেকে রাখা যাচ্ছে না!
মানে কি?
-আবার কোত্থেকে উদয় হল লোকটা? নিজেকেই প্রশ্ন করল মারুফ।
মারুফ হাত দিয়ে বারবার লোকটাকে ইশারা করতে লাগল লোকটাকে সরে যাওয়ার জন্য, কিন্তু কোন ফল হচ্ছে না।
লোকটা কি ওর হাতের ইশারা দেখতে পায়নি?
নাকি বুঝতে পারেনি?
নাকি সব বুঝেও ইচ্ছে করেই মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে?
গাড়ি থামানোর সিদ্ধান্ত নিল মারুফ। লোকটা পাগল হোক আর যা-ই হোক, এভাবে কাউকে চাপা দেয়া যাবে না।
কিন্তু এ কি?
গাড়িটা থামছে না কেন? তাহলে কি 'শতভাগ পাশ' এর দেশে শুধু তার ব্রেকটাই 'ফেল' করেছে?
-সরে যান। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে চিৎকার করে বলার চেষ্টা করল মারুফ।
আজব। জানালার কাচ-ও জ্যাম হয়ে যাওয়ার জন্য এই মুহূর্তটাই পেল?
লোকটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়, কলকব্জাদের বিদ্রোহকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে গতির ঝড়কে প্রতি মুহূর্তে বাড়িয়ে চলেছে ইঞ্জিনটা।
আর সর্বোচ্চ এক সেকেন্ড।
মারুফের গাড়ির নীচে পিষ্ট হতে চলেছে প্রকৃতির এই স্বঘোষিত সন্তান!

ক্যা-অ্যা-অ্যা-চ-চ-চ।
রাস্তার সাথে টায়ারের প্রচণ্ড ঘর্ষণের শব্দ শোনা গেল। শেষবারের মত 'ভট-ভট' শব্দ তুলে থেমে গেল ইঞ্জিনটা। সেই সাথে চূড়ান্তভাবে নিভে গেল হেডলাইট।
তবে হেডলাইটের আলোর মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তে মারুফ স্পষ্ট দেখতে পেল লোকটার ঠিক ইঞ্চি ছয়েক সামনেই থেমে গেছে তার গাড়ি। লোকটা শেষ পর্যন্ত বেঁচে গেছে।
-ঐ মিয়া, মরার এত শখ থাকলে পাহাড় থেকে লাফ দিতেন। আমার গাড়ির সামনে কি? বলতে বলতে গাড়ি থেকে নামার উদ্যোগ নিল মারুফ।
কিন্তু এ কি?
গাড়ির দরজা খুলছে না কেন?
হেডলাইট আগেই বন্ধ হয়ে গেছে, এবার পুরোপুরি মেঘের আড়ালে চলে গেছে চাঁদটাও। চারপাশে আবার জেঁকে বসেছে কুয়াশা।
গাড়িটা স্টার্ট করার চেষ্টা করল মারুফ। ইঞ্জিনটা স্টার্ট হতে হতেই থেমে গেল।
-আরেকবার। নিজেকে বলল মারুফ।
-কোন লাভ নেই। একটা পরিচিত কন্ঠ বলে উঠল।
অন্ধকারে কিছু দেখা না গেলেও মারুফ ঠিক জানে লোকটা ওর গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
-কি চাই তোমার? গাড়ির ভেতর থেকে চিৎকার করে উঠল মারুফ।
-আমার? হেসে উঠল লোকটা। আমার কিছু চাই না। চায় এই ‘জঙ্গল মঙ্গলপুর’।
-মানে?
এবার আর কোন জবাব পাওয়া গেল না।
-এই শুয়োরের বাচ্চা, কোথায় তুই? অন্ধকারে লুকিয়ে না থেকে জবাব দে।
এবারও কোন জবাব এল না, শুধু একটা শব্দ শোনা গেল।
‘ঘড় ঘড়’।
হাত দুটো ভয়ে ঠান্ডা হয়ে এল মারুফের, গাড়ির দরজাটা ধাক্কাতে শুরু করল প্রাণপণে।
মারুফ ঠিকই জানে, টাকা আর ক্ষমতার জোড়ে বহু হোমড়া-চোমড়াকে ঠান্ডা করলেও লুকিং গ্লাসে পেছনের সীটে যে জন্তুটাকে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে, তাকে ঠান্ডা করার কোন ভাষা তার জানা নেই!

২৩/০২/২০২৩, ২৫/০২/২০২৩

আমার লেখা অন্যান্য ভৌতিক গল্পগুলোঃ

১.পিশাচ কাহিনীঃ রক্তখেকো ডাইনী পর্ব-১ পর্ব-২ পর্ব-৩
২.পিশাচ কাহিনীঃ জানোয়ারের রক্ত (১৮+)
৩.পিশাচ কাহিনীঃ অন্ধকারে বিলীন
৪.পিশাচ কাহিনীঃ হোটেল একশ তলা
৫.পিশাচ কাহিনীঃ একশ তলায় আবার
৬.পিশাচ কাহিনীঃ রাতের আঁধারে
৭.পিশাচ কাহিনীঃ কন্ঠ
৮.পিশাচ কাহিনীঃ অতিথি
৯.পিশাচ কাহিনীঃ কান্নার শব্দ
১০.পিশাচ কাহিনীঃ শয়তানের পাল্লায়
১১.পিশাচ কাহিনীঃ নির্ঘুম রাত
১২.পিশাচ কাহিনীঃ জঙ্গল মঙ্গলপুর
১৩.পিশাচ কাহিনীঃ একটি ফটোগ্রাফ
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০২৩ রাত ১০:০৯
৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান।

লিখেছেন আহা রুবন, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ৯:৫০





ফখরুল সাহেব দেশটাকে বাঁচান। আমরা দিন দিন কোথায় যাচ্ছি কিছু বুঝে উঠতে পারছি না। আপনার দলের লোকজন চাঁদাবাজি-দখলবাজি নিয়ে তো মহাব্যস্ত! সে পুরাতন কথা। কিন্তু নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হচ্ছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। প্রধান উপদেষ্টাকে সাবেক মন্ত্রীর স্ত্রীর খোলা চিঠি!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:০৩




সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে মুক্তি দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন মোশাররফ হোসেনের স্ত্রী আয়েশা সুলতানা। মঙ্গলবার (২৯... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেমন হবে জাতীয় পার্টির মহাসমাবেশ ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০১ লা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১০:৫৬


জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে বিক্ষুব্দ ছাত্র জনতা আগুন দিয়েছে তাতে বুড়ো গরু গুলোর মন খারাপ।বুড়ো গরু হচ্ছে তারা যারা এখনো গণমাধ্যমে ইনিয়ে বিনিয়ে স্বৈরাচারের পক্ষে কথা বলে ,ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়াতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী

লিখেছেন সামিউল ইসলাম বাবু, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১২:১৩

ফিতনার এই জামানায়,
দ্বীনদার জীবন সঙ্গিনী খুব প্রয়োজন ..! (পর্ব- ৭৭)

সময়টা যাচ্ছে বেশ কঠিন, নানান রকম ফেতনার জালে ছেয়ে আছে পুরো পৃথিবী। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে গুনাহ মুক্ত রাখা অনেকটাই হাত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাতির জনক কে? একক পরিচয় বনাম বহুত্বের বাস্তবতা

লিখেছেন মুনতাসির, ০২ রা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৮:২৪

বাঙালি জাতির জনক কে, এই প্রশ্নটি শুনতে সোজা হলেও এর উত্তর ভীষণ জটিল। বাংলাদেশে জাতির জনক ধারণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তিত্বকে জাতির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×