৫০০ পৃষ্ঠার বইটাতে আমি তখন ৫৬ পৃষ্ঠায়।
-রাকিব, গল্পের বই রেখে এবার খেয়ে নাও।তোমার খাওয়া শেষ হলে আমি শুয়ে পড়ব, শরীরে আর কুলাচ্ছে না। দরজায় দাঁড়িয়ে আম্মা বললেন।
-ওফ বিরক্ত কর নাতো। আমি মুখ পেচিয়ে বললাম।আমার খাওয়া লাগবে না। তুমি শুয়ে পড়।
বলেই আম্মার মুখের ওপর দড়াম করে বন্ধ করে দিলাম দরজাটা।আবার ডুবে গেলাম বইটাতে।
***
৫০০ পৃষ্ঠার বইটাতে আমি তখন ৪০০ পৃষ্ঠায়।
দারুণ গল্প।একনায়কের বিরুদ্ধে গণ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিচ্ছে ছেলেটা। ইতিমধ্যেই সে ধরা পড়েছে, গোপন আদালতে তার বিচার হয়েছে।ফাসি।আগামীকাল শাস্তি কার্যকর হবে।
এদিকে বাকি বিদ্রোহীরা আগামীকাল কারাগারে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নায়ককে উদ্ধার করেই প্রেসিডেন্টস পার্কে আক্রমণ হবে। চূড়ান্ত আক্রমণ।
ওদিকে প্রেসিডেন্টস গার্ডও রেডি। রাস্তায় ট্যাংক নামার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন।
ওয়াও। বাংলা ভাষায় এমন থ্রিলার। ভাবাই যায় না।
***
৫০০ পৃষ্ঠার বইটায় আমি তখন ৪৪৪ পৃষ্ঠায়।
কারাগারে আক্রমণ হয়েছে। এখানে নাকি প্রেসিডেন্টের স্পাই আছে। সে নাকি আবার নায়কেরও আস্থা অর্জন করে নিয়েছে।
কে সে?
ঠিক বুঝতে পারছি না।
-রাকিব, আমি কিন্তু শুয়ে পড়ব। তুমি খাবা কিনা? শেষবারের মত বল।
ধ্যাত্তেরি, এই মহিলা এত পেইন কেন?
-বললাম না খাব না। গলার স্বরটা কোনভাবেই আমি আর নীচে নামাতে পারি না।
***
৫০০ পৃষ্ঠার বইটায় আমি তখন ৪৭০ পৃষ্ঠায়।
খেলা জমে উঠেছে। বিদ্রোহীরা কারাগারের দখল প্রায় নিয়েই নিয়েছে, নায়কের ফাসি কোনভাবেই হতে দেয়া যাবে না।
কিন্তু এ কি?
যম টুপি খোলার পর যাকে দেখা গেল সে তো নায়ক নয়!
তবে?
পুরোটাই কি তাহলে ধোঁকা?
এদিকে এক গোপন কুঠুরিতে নায়কের ফাঁসির সব আয়োজন সম্পন্ন!
***
৫০০ পৃষ্ঠার বইয়ে আমি তখন ৪৮০ পৃষ্ঠায়।
আম্মা কি আবার ডাকল নাকি?
দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম আমি। রাত প্রায় দুইটা বাজে। আম্মার শরীর ভাল না। তাও ওপর অফিস আছে কালকে। এত রাত জাগা আম্মার পক্ষে সম্ভব না।
ভন ভন ভন।
ওফ, আমার মশা ডিস্টার্ব করা শুরু করল।কোনভাবেই কি আজরাতে বইটা শেষ করতে পারব না?
যাই, পাশের রুম থেকে ইনসেক্ট কিলার নিয়ে আসি।
***
আব্বা যে সস্তা খুঁজতে গিয়ে কিসব ইনসেক্ট কিলার আনে।
এমন বাজে গন্ধ! তার ওপর স্প্রে করার পর থেকেই চোখ জ্বালাপোড়া করছে।
যাই, চোখে পানি দিয়ে আসি।
***
এখন একটু আরাম লাগছে চোখে। আসলে এত মোটা বই, এর সময় নিয়ে একটানা পড়ছি। তার ওপর বাল্বটাও দুই নম্বর। এত কম আলো।
বইটা আবার খুললাম।
কোথায় যেন ছিলাম?
ওহ, মনে পড়েছে। কারাগারে লড়াই চলছে। নায়ককে উদ্ধার করা গেলেই প্রেসিডেন্টস পার্কে আক্রমণ হবে। প্রেসিডেন্ট হারবে, নায়ক জিতবে।
হঠাৎ কেন যেন মনে হল, আম্মাও কেমন যেন এই স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্টের মত। কোন কথা শুনবে না, নিজের মর্জিমত সব চাপিয়ে দেবে আমার ওপর।
আমিও ভালমত দেখিয়ে দিলাম আজকে।
এখন থেকে এরকমই করব। কিচ্ছু শুনব না, কথায় কথায় বিদ্রোহ।
***
আবার খুললাম বইটা।
এবার খেলা হবে।
কিন্তু এ কি?
বইয়ের লেখাগুলো হঠাৎ মুছে যেতে শুরু করল কেন?
আমি যতই পড়ছি, লাইনগুলো ততই মুছে যাচ্ছে।
পড়ার গতি যত বাড়াচ্ছি, ততই বাড়ছে লেখা মুছে যাওয়ার গতিও।
আমি প্রাণপণে পড়ে যাচ্ছি। আমাকে জানতেই হবে কারাগার থেকে নায়ক মুক্ত হল কি না, আমাকে জানতেই হবে প্রেসিডেন্টস পার্কে আক্রমণ হবে কি না।
এখন পর্যন্ত আমি এগিয়ে আছি। যে লাইনগুলো মুছে যাচ্ছে, সেগুলো ইতিমধ্যেই পড়ে ফেলেছি।
-রাকিব, একটু পানি খাওয়াবি বাবা?
আম্মার কন্ঠ?
-রাকিব?
হ্যা, আম্মাই ডাকছে।
উঠে গিয়ে দেখব?
কিন্তু এর মধ্যে যদি আরও লাইন মুছে যায়? যদি একেবারে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত মুছে যায়?
এই পৃথিবীতে এটাই এই বইয়ের শেষ কপি, আমি যদি আর কখনো গল্পের শেষটা জানতে না পারি?
-বাবা রাকিব... আম্মার কন্ঠটা ডেস্পারেট শোনায়।
উঠে গিয়ে দেখব? নাকি পড়ব?
অণুগল্পঃ অনিশ্চিত বিদ্রোহী
২৭.১২.২০২২
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ১:১৭