-ড্রাইভার চাচা।
-বলেন বাবাজি।
-ভাল আছেন?
-আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমুন আছেন বাবাজি?
-আমিও ভাল।
-আপনার জার্নি কেমুন হইল?
-ভালই।আচ্ছা, এবার গাড়িতে কোন গার্ড উঠল না কেন?
-ওরা পিছের গাড়িতেই আছে।
আমি পেছনে তাকালাম। পতাকা লাগানো একটা গাড়ি পেছনে আসছে। ওটাই আমার গার্ডদের গাড়ি হওয়ার কথা। প্রতিবার আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে এসকর্ট করার সময় স্পেশাল ফোর্সের লোকজন দুইভাগ হয়ে একভাগ পেছনের গাড়িতে থাকে, দুজন আমার সাথে ওঠে।কিন্তু প্রতিবারের মত আমার সাথে এই গাড়িতে কেউ উঠল না কেন?
-ড্রাইভার চাচা, আপনার ফোনটা একটু দিনতো। প্রতিবার দেশে আসার পর গার্ডরাই আমাকে একটা লোকাল সিম দেয়, এইদেশে আমার বিদেশি সিমটা কাজ করে নাতো। এবারতো কিছুই দিল না।
-এই নেন, বাবা। একহাতে স্টিয়ারিং ধরে অন্যহাতে ফোনটা এগিয়ে দেন ড্রাইভার চাচা।
আব্বুর নম্বর আমার মুখস্থ আছে। ডায়াল করি।
কয়েকবার রিং পড়ে, ওপাশ থেকে কোন জবাব আসে না।
আব্বু কি ঘুম?
উহু, আব্বু আর্লি রাইজার। ভোর সাড়ে ছয়টায় তার ঘুমানোর কথা না। তাছাড়া বছরদুয়েক পর তার একমাত্র ছেলে দেশে ফিরছে, তাও পড়াশোনা শেষ করে। এবার আমার অফিশিয়ালি দলে যোগদান করে সেন্ট্রাল কমিটিতে পোস্ট নেয়ার কথা। এখনতো আব্বুর এসবের প্রস্তুতি নেয়ার কথা।
ব্যাপারটা কি?
আবার আব্বুর নম্বর ডায়াল করলাম।
-আপনার ডায়ালকৃত নম্বরটি এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব নয়।
মানে কি? হঠাৎ করেই অসম্ভব টেনশান লাগতে শুরু করল।
-ব্যাপার কি? ড্রাইভার চাচা পেছন ফিরে জানতে চাইলেন।
-কিছু না। আমি সংক্ষেপে জবাব দিলাম। এই মুহূর্তে বেশি কথা বলা ঠিক হবে না।
সামথিং ইজ অফ।
আমি বাইরে তাকালাম। এটা মূল শহরের বাইপাস রোড। এয়ারপোর্ট থেকে মূল শহরে না ঢুকে সরাসরি ভিআইপি রোডে উঠেছে, সেখান থেকে পাঁচ মিনিটে আব্বুর সরকারী বাসভবন।
এটা নতুন রাস্তা। এই রাস্তা আজ আমি ব্যবহার করব, এটা কি বাইরের কেউ জানার কথা?
শাহেদ আংকেল জানার কথা।উনি আব্বুর বিশ্বস্ত লোক, গত পঁচিশ বছর ধরে আব্বুর পিএস।
আংকেলের নম্বর মুখস্থ আছে, ডায়াল করলাম।
রিং হচ্ছে।
মোবাইলটা কানের সাথে লাগিয়ে রইলাম। কোন জবাব আসছে না ওপাশ থেকে।
ব্যাপারটা কি?এরকমতো হওয়ার কথা না।
আবার ডায়াল করব?
মনের মধ্যে নানারকম বাজে চিন্তা আসছে, কি করব বুঝতে পারছি না।
ফোকাস।
ঠিক আছে, আবার ডায়াল করি।আংকেলের রেগুলার নম্বর না, সিক্রেট নম্বরটা।
রিং হচ্ছে।
-হ্যালো, মানিক মিয়া। তুমি কোথায়? ওপাশ থেকে ফিসফিসানো একটা কন্ঠ ভেসে আসে।তবে কন্ঠটা শাহেদ আংকেলের, তাতে কোন সন্দেহ নেই।
-আংকেল, আমি মিনহাজ বলছি।
-মিনহাজ, তুমি মানিকের নম্বরে কেন? তোমার সিম কোথায়?
-এবার কোন সিম দেয়নি আমাকে এয়ারপোর্টে।
-সেকি? এমনতো হওয়ার কথা না।
-আংকেল আপনি এভাবে ফিসফাস করে কথা বলছেন কেন?
-সর্বনাশ হয়ে গেছেরে বাবা, একটু আগে এখানে সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। সেনারা পুরো প্রেসিডেন্টস পার্কের দখল নিয়ে নিয়েছে। পুরো রাজধানীর রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ট্যাংক।
-মানে? আব্বু কোথায়?
-জানি না। যোগাযোগ করতে পারিনি।
-তা কি করে সম্ভব? আব্বুর সাথে কালরাতেও কথা হয়েছে আমার।
-বাবারে, আমি তোমাকে যেটা বলছি, সেটা লাস্ট এক ঘন্টার ঘটনা। তোমাকে রিসিভ করার জন্য স্পেশাল ফোর্স যখন বের হচ্ছে, তখনও আমরা কিছু জানতে পারিনি এই ক্যু সম্পর্কে।
-তাহলে আমি এখন কি করব? প্রেসিন্ডেন্টস পার্কে যাব না?
-না,না। ভুলেও এই ভুল কর না। ওখানে সব আর্মির লোক। তোমার বাবা এখন কোথায়-কেউ জানে না।
-আপনি কোথায় এখন? আপনার ওখানে আসব?
-বাবারে, আমি নিজেও এখন আত্মগোপনে।আমার রেগুলার নম্বরে ফোন করলে আমাকে খুঁজেও পেতে না।
-তাহলে…
আমি কথা শেষ করতে পারি না, তার আগেই লাইন কেটে যায়। তাকিয়ে মোবাইলে কোন সিগনাল শো করছে না, জিরো নেটওয়ার্ক। মোবাইল সার্ভিস কি ওরা বন্ধ করে দিল?
কি করব ভাবছি, তখনই ঘটল ঘটনাটা।
শুন্য থেকে একটা বুলেট এসে আঘাত করল গাড়িতে। কাচে অল্প একটু ফাটল দেখা দিল, কিন্তু ভেদ করে বুলেটটা ভেতরে ঢুকতে পারল না। ভাগ্যিস বুলেটপ্রুফ গ্লাস।
-বাবাজি, এসব কি হইতেছে? ড্রাইভার চাচা আমার দিকে ফিরলেন। মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
-চাচা, দেখে ড্রাইভ করেন।
আমার কথা শুনে ড্রাইভার চাচা সামনে ফিরলেন বটে, তবে এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে দিলেন। নির্জন রাস্তা দিয়ে গাড়িটা যেন উড়তে শুরু করল।
আমি পেছনে ফিরে তাকালাম।এইসব ঝামেলার ভেতর স্পেশাল ফোর্সের গাড়িটা কখন গায়েব হয়ে গেছে, বুঝতেই পারিনি।স্রেফ গায়েব।এই স্পেশাল ফোর্সতো সেনাবাহিনীরই অংশ। ওরাও কি তবে ক্যু’র সাথে জড়িত?
ভাবতে পারছি না।
কি করা যায় এখন?
মোবাইল আছে, তাতে কোন লোকাল সিম নেই। ইন্টারনেট নেই, বিশ্বস্ত কারও সাথে যোগাযোগের সুযোগও দেখছি না।
এ ধরণের ক্যু টাইপ মুভি দেখা হয়েছে বেশকিছু, কিন্তু নিজে কখনও এরকম অবস্থায় পড়ব, ভাবতেও পারিনি।
আইডিয়া।
আব্বু বলেছিল উনাদের কিছু সেফ হাউস আছে, প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য।
-ড্রাইভার চাচা।
-জ্বি। ভয়ে ভয়ে জবাব দিলেন ড্রাইভার চাচা।
-আপনি কোন সেফ হাউস চেনেন?
আমার দিকে প্রশ্নবোধক চেহারা নিয়ে তাকালেন ড্রাইভার চাচা।
-মানে ধরেন বিপদে আপদে যেখানে লুকিয়ে থাকা যায়। আব্বুদের এরকম কোন ঘর নাই?
-ওহ বুঝতে পারছি। আছে।
-আপনি চেনেন? চলেন তাহলে।
আরেকবার এক্সেলেটরে চাপ দিলেন ড্রাইভার চাচা। আমি মাথা নীচু করে গাড়ির ব্যাকসীটে শুয়ে রইলাম।
বিশাল জার্নি করে দেশে ফিরেছি, তারওপর এই ক্যু’র টেনশান। শরীরটা ছেড়ে দিয়েছিল, কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম-ভাবতেই পারিনি।
জেগে উঠতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম সেফ হাউজে। সমস্যা একটাই, চেয়ারের সাথে আমার হাত পা বাঁধা। আমার ঠিক সামনেই বসে আছে, সামরিক পোশাক পড়া একজন, স্টারের সংখ্যা দেখে বেশ ওপরের র্যাংকের কেউ হবে বলেই মনে হচ্ছে।
হঠাৎ করেই গালে একটা দশমণী ওজনের থাপ্পড় বসিয়ে দিল লোকটা। মুখে থু থু ছিটিয়ে গালি দিল, শালা, শুয়োরের বাচ্চা।
তবে যে শুনেছিলাম আর্মির লোকজন ইংরেজীতে গালি দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে! ভুল জানতাম তাহলে এতদিন।
ভেবেছিলাম, আরো কিছু বলবে লোকটা। কিন্তু কিছু না বলেই আমার সামনে থেকে উঠে গেল।
জাওয়ান টাইপ একজনকে অর্ডার দিলেন, ডাক ওকে।
দরজা দিয়ে যাকে ঢুকতে দেখলাম, তার কথা এতক্ষণ মাথায়ই আসে নি। ড্রাইভার চাচা!
-স্যার, ডাকছিলেন আমাকে?
-হ্যা, প্রেসিডেন্টের ছেলেকে আমাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য তোমাকে কত যেন দেওয়ার কথা?
-স্যার, কথাতো ছিল দশ লাখের। তবে রাস্তায় প্রেসিডেন্টস গার্ডের লোকজন যেভাবে আক্রমণ করেছিল, আমিতো ভয়েছিলাম কখন আবার ওরা বাবাজিকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
-তো?
-স্যার, বুঝতেইতো পারছেন। অনেক বড় রিস্ক নিছি। এখন আপনারা ইনসাফ করে যা দেন আরকি। বলতে বলতে হাত কচলাতে থাকে ড্রাইভার।
-তোমার ফ্যামিলি কোথায়?
-আপনিতো বলছিলেন ওদের রাতেই বর্ডার ক্রস করায় দিবেন।
-ও, হ্যা,হ্যা। ভুলে গিয়েছিলাম। ওদেরকে নিরাপদে বর্ডার ক্রস করিয়ে দিয়েছি।
-স্যার, এবার তাহলে আমাকেও।
-হ্যা, হ্যা, নিশ্চয়ই। এই, দাঁড়িয়ে থাকা জাওয়ানকে আবার অর্ডার দেন তিনি, উনার পাওনাটা পাশের ঘরেই রাখা আছে। বুঝিয়ে দাও।
জওয়ানের পিছু পিছু বেরিয়ে যায় ড্রাইভার, একবার আমার সাথে চোখাচুখি করার সাহসও হয় না লোকটার।
শালা বেঈমান।
আমি থুথু ফেলতে গিয়েও ফেলতে পারি না, কাপড় দিয়ে মুখটা বেঁধে রেখেছে।
মিনিট খানেক পর পাশের ঘর থেকে বুলেটের গর্জন শোনা যায়।
-তোমার ড্রাইভারকে তার পাওনা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। বলতে বলতেই কুৎসিতভাবে হাসতে থাকে লোকটা।
-বাকি লোগতো চালে গেয়, আব তেরা কেয়া হোগা কালিয়া? বলতে বলতে আবারও কুৎসিতভাবে হাসতে থাকে লোকটা।
সমস্যা কি হারামজাদার? নিজেকে গব্বর সিং ভাবে?
-এই। জাওয়ানকে আবার ডাক দেয় লোকটা। মেজরকে ডাক।
-জ্বি স্যার।
ছেলেটা বেরিয়ে যায়। মিনিটখানেক আরেকজন ঢোকে।এই লোক নিশ্চয়ই মেজর।
-মেজর।
-ইয়েস স্যার।
-প্রেসিডেন্টকে লোকেট করা গেছে?
-জ্বি স্যার।
-কন্ট্যাক্ট হিম। টেল হিম, উই হ্যাভ হিস সান। হি মাস্ট নেগোশিয়েট।
-আমি তুমি আমরা
২৪-১০-২০২০
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০২০ রাত ১০:০২