প্রিয় নবনী,
জানতে চেয়েছিস আমি কোথায়? আমি এখন বসে আছি গৌরীপুর জংশন নামক ছোট্ট ইষ্টিশন-এ।আমার আশেপাশে কোথাও কেউ নেই, আশ্চর্য এক ভুতুড়ে পরিবেশ।তার ওপর হু হু করে বইছে মাতাল হাওয়া। মনে হচ্ছে এই হাওয়ার তোড়ে স্টেশনের দেয়াল আর ছাদ-দুটোই ভেঙ্গে পড়বে।
জায়গাটা আমার জন্য অচিনপুর হতে পারে, কিন্তু তোরতো খুব ভাল করেই চেনা।তুই এখানে আগেও এসেছিস, এখানেই তোর বান্ধবী মীরার গ্রামের বাড়ি।মীরার সাথে দেখা হয়নি, তবে তোদের স্মৃতিবিজড়িত জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল-এ গিয়েছিলাম। ভালই লেগেছে।
এখন যদিও সন্ধ্যা, কিন্তু আকাশে মেঘ করে একেবারে কৃষ্ণপক্ষ এর মত চারপাশ আঁধার করে তুলেছে।কিছুক্ষণ আগে এখানে কারেন্টও চলে গেছে।আমার কাছে না আছে বলপয়েন্ট, না আছে ফাউন্টেন পেন।তুই লিখতে বলেছিলি, তাই একটা কাঠপেন্সিল যোগাড় করে কোন রকমে তোকে লিখছি।
আমি হুট করে এখানে কেন এসেছি জানিস? চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস-এ আজ চিত্রার বিয়ে।চিত্রাকে চিনেছিস? তোকে মাঝে মাঝে এক মায়াবতীর গল্প বলতাম না? চিত্রাই আমার একজন মায়াবতী।
চিত্রার বাবা নলিনী বাবু বিএসসি একটা অমানুষ। লোকটা মনে হয় নিজেকে বাদশাহ নামদার ভাবে।চিত্রা ওর বাবাকে প্রচন্ড ভয় পায়। সেই ভয় ভেঙ্গে এতবার বলল সে তার ভালবাসার ছেলেটা ছাড়া আর কাউকেই বিয়ে করবে না, লোকটা মানলই না। চিত্রার মা, লীলাবতী দেবীও মেয়ের পক্ষ নিলেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না।
উপায় না দেখে আমিই ট্রেনে চড়ে বসলাম।পুরো জার্নিতে পোকার কামড় খেয়ে যখন পৌছালাম, তখন মধ্যাহ্ন পেরিয়ে গেছে। মনে মনে লোকটার সাথে দ্বৈরথ করার প্রস্তুতি নিয়ে গেছি আর সে আমার সাথে দেখাই করল না।সাফ জানিয়ে দিল,আজ রবিবার, আজ আমি কোথাও যাব না।আরে বাবা, উঠোন পেরিয়ে দুই পা এলেই হয়। তোমার মেয়ে যাকে ভালবাসে তার চেহারা একবারও দেখবে না? আমিতো আর ম্যাজিক মুন্সী নই, আমাকে দেখলেইতো আর চোখের পলকে সব বদলে যাবে না।
লোকটা দেখা করবে না শুনেই মাথাটা এলেবেলে হয়ে গিয়েছিল। চিৎকার করে বললাম, দেখা করবে না কেন? লোকটা কি বৃহন্নলা নাকি? নিজেকে ছাড়া মেয়ের জীবনে দ্বিতীয় মানব সহ্য হয় না? জানি, দরজার ওপাশে-ই দাঁড়িয়ে আছেন, সামনে আসতে সমস্যা কি?
আমার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে চিত্রা বেরিয়ে এল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এতক্ষন সাজঘর-এ ছিল।ওকে দেখেই বললাম, পাখি আমার একলা পাখি, চল উড়ালপংক্ষী হয়ে উড়ে যাই।
চিত্রা বলল, এ কি কান্ড করছ?
-কান্ড টান্ড বুঝি না। এসব বিয়ে ফিয়ে বাদ দিয়ে তুমি আমার সাথে চল।
আর চিত্রা কিনা আমার গালে চড় বসিয়ে দিল! আংগুল উচিয়ে বলল, খবরদার, আমার বাবা সম্পর্কে কোন আজে বাজে কথা বলবে না।
চিত্রার আচরনে সত্যিই অবাক হয়েছি। ফিহা সমীকরণ তবু সমাধান করা সম্ভব, কিন্তু মেয়েদের মন বোঝা সম্ভব নয়।
চিত্রার এই আচরনের পর ওদের দারোয়ান আঙুল কাটা জগলু আমাকে ধাক্কা মেরে বের করে দিল। আমার আর ঘরে ফেরার ইচ্ছা নেই, তোমাদের এই নগরে হয়ত আর কখনোই ফিরব না। কোথায় যাব তাও জানি না, কেবল এই স্টেশনে একা বসে অপেক্ষা করছি ট্রেনের জন্য।
হঠাৎ কার কন্ঠ শুনতে পেলাম। এই জনমানব শূন্য স্টেশনে আবার কে কথা কয়? পেছন ফিরে দেখি মৃন্ময়ী, চিত্রার ছোটবোন।মেয়েটা আমার পাশে এসে বসল। এই অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখতে পেলাম ওর চোখ পানিতে টলটল করছে। তবে কি মৃন্ময়ীর মন ভাল নেই?
মৃন্ময়ী জানতে চাইল, কোথায় যাচ্ছেন?
বললাম, নির্বাসন-এ।
-মানে?
-মানে একা একা চলে যাব দূরে কোথায়।
-আর ফিরবেন না?
আমি 'না' বলতে চাইছিলাম, অতি আবেগে কন্ঠ দিয়ে বেরোল নী!
-কেন?
আমি নিশ্চুপ।
-আমাকে সাথে নেবেন?
-না।
-আমার আছে জল। ওটা কি নেবেন?
আমি বিরক্ত হয়ে মৃন্ময়ীর দিকে তাকালাম।এই অল্পবয়সী মেয়েটার সমস্যা কি?
আমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললাম, চিত্রার বরের নাম কি?
-হিমু।
-কি করে?
-বর্ডারের কাছে লোকজনকে ময়ূরাক্ষী নদী পারাপারকরায়।
-মানে মানবপাচার?
মৃন্ময়ী জবাব দিল না।আমিও চুপ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম।যেকোন মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে। অন্যসময় হলে বৃষ্টি ও মেঘমালা শিরোনাম দিয়ে ব্লগে একটা ফাটাফাটি পোস্ট দিতাম, কিন্তু এখন কিছুই ইচ্ছা করছে না।এমন বৃষ্টির দিনে আমি আর চিত্রা কত বৃষ্টিবিলাস করেছি-ভাবতেই মন খারাপ হয়ে গেল।
দেখতে দেখতে ঝুম বৃষ্টি নামল।মৃন্ময়ী বৃষ্টি ছুয়ে বলল, কি বৃষ্টি দেখেছেন? মনে হচ্ছে যেন শ্রাবন মেঘের দিন।মনে আছে,শ্রাবনের এক দুপুরে আপনার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল আপু।আপনি আমাকে শুনিয়েছিলেন অদ্ভুত সব গল্প আর আপুর জন্য এনেছিলেন বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল।
-মনে আছে।সেদিন ঐ রেস্টুরেন্টে বসে আমি তোমাকে হরতন ইশকাপনচিনিয়েছিলাম।
-সেদিন চক্ষে আমার তৃষ্ণা ছিল, আজও আছে। দেখতে পান?
আমার সত্যিই এবার খুব বিরক্ত লাগছিল। অল্পবয়সী মেয়েগুলো নিয়ে এই এক সমস্যা, একসাথে বসে মিষ্টি দুটো কথা বললেই ভাবে প্রেম হয়ে গেছে।আমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য আবার বললাম, চিত্রার সাথে আমার প্রথম দেখা কবে জানো?
-কিভাবে?
-সেদিন চৈত্রমাস।শীতের সকালে আমি তাড়াহুড়ো করে ক্লাসে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি কুয়াশা ভেদ এক অনিন্দ্য সুন্দরী আমার দিকে এগিয়ে আসছে।মানবী নয়, যেন পেন্সিলে আঁকা পরী।তাই দেখে হয়ত কবি বলেছিলেনঃ
প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ ।
-তারপর?
-তারপর ওকে একদিন দেখলাম ওদের হলের বারান্দায় তোয়ালে হাতে।সেটা অবশ্য ওর ছিল না, ছিল তিথির নীল তোয়ালে। এভাবেই চলে যায় বসন্তের দিন আর আমার প্রতিদিনই মনে হয় এই মেয়েটিকেই আমি বিয়ে করব।
-আর ভেবে দেখুন কোন এক নীল হাতীর পিঠে চড়ে আসা হিমুর সাথে আয়না ঘর-এ রূপার পালঙ্ক-এ বসে আপু এখন বাসরকরছে।
-কি সমস্যা তোমার? ইচ্ছা করে আমার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিচ্ছ?
-একটা কথা বলি?
-কি?
-আব্বু কিন্তু মানুষ খারাপ না। আমার বাবার মত নীল মানুষ হয় না।
-তাই? তাহলে তোমার বোনকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে কেন?
-আজ না, অন্যদিন বলব। আজ আমার কথা বোঝার মত মানসিক অবস্থা আপনার নেই।
আমি আর কিছু বলি না। হয়ত সত্যিই ওর কথা বোঝার মত মানসিক অবস্থা আমার নেই।
হঠাৎ চেয়ে দেখি বৃষ্টি থেমে গেছে।আকাশে অনন্ত নক্ষত্রবীথি, সেই সাথে গৃহত্যাগী জোছনা।বৃষ্টির শেষে ভেজা আকাশে এই জোছনাকেই কি বলে জল জোছনা?
-কি ভাবেন? মৃন্ময়ী জানতে চায়।
-জান, এমনই এক জোছনা রাতে যখন সবাই গেছে বনে, ইচ্ছা ছিল তখন তোমার বোনকে পাশে নিয়ে আমি নিশিকাব্য লিখব।
-সেই কাব্য কি লেখা হয়েছে?
-না।এখন আর কাব্য লিখব না। গান লিখব। অন্ধকারের গান।অন্ধকারে বিলীন হয়ে হয়ে যাওয়া একজন মানুষ আর কিইবা করতে পারে?
মৃন্ময়ী খুব শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরে। খবরদার, এসব বাজে কথা আর কখনো বলবেন না। একদম না।
-ভালবেসে যদি সুখ নাহি পাই তবে আর কি বলব?
মৃন্ময়ী জবাব দেয় না,অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।আমার বিরহগাথা শুনতে ও বোধহয় আগ্রহী নয়।
আমার সামনে দিয়ে কয়েকটা প্রজাপতি উড়ে যায়। আমি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে প্রজাপতিগুলো ধরার চেষ্টা করি।এই মুহূর্তে আমি এবং কয়েকটি প্রজাপতি ছাড়া আর সবার অস্তিত্বই আমার কাছে মূল্যহীন মনে হয়।
হঠাৎ চেয়ে দেখি একটা মধ্যবয়স্ক লোক স্টেশনের দিকে দৌড়ে আসছে।আমি আর মৃন্ময়ী চেয়ে থাকি, লোকটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।
-ট্রেন কখন আসবে?লোকটা জানতে চায়।
-অপেক্ষাকরুন কিছুক্ষন, চলে আসবে। আমি জবাব দেই।
লোকটা মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে বলে, তুমি মৃন্ময়ী না? চিত্রার ছোটবোন?
-হ্যা, আপনি কে? মৃন্ময়ী অস্বস্তি নিয়ে জবাব দেয়।
-আমি সানাউল্লাহ, তোমার বোনের বিয়ের সম্বন্ধ আমিই নিয়ে এসেছি।
-তা বিয়ে বাড়ি ছেড়ে আপনি এখানে কি করছেন? আমি জানতে চাই।
-আরে রাখ বিয়ে বাড়ি। আমার মাথার ওপর নয় নম্বর বিপদ সংকেত। পরিচিত কোথাও এখন সানাউল্লাহর মহাবিপদ।
-কেন? কি হয়েছে?
-আরে, আমি কি আর জানি হিমু মানব পাচার করে বর্ডারে? আসমানীরা তিন বোন, ওদেরকেও হিমু পাশের দেশে পাচার করে দিয়েছে।তাই নিয়ে লাগছে এক বিশাল গিরিঙ্গি।
-তা হিমু এখন কোথায়?
-কোথায় আবার? হিমু রিমান্ডে। হলুদ হিমু কালো র্যাব-এর খপ্পরে।যেকোন মুহূর্তে ক্রসফায়ারে পরে অন্যভূবন-এ চলে যেতে পারে।
-তাই নাকি? হিমু মামার তাহলে এখন বিশাল বিপদ।তা হিমুর একান্ত সাক্ষাতকার মানে রিমান্ডের কথা আপনি এসব জানলেন কিভাবে?
-হিমুর বাবা, মিসির আলী ফোন করেছিল।বললাম, কে? বলে, আমিই মিসির আলী।জানতে চাইলাম, মিসির আলী!আপনি কোথায়? লোকটা কোন জবাব দিল না।বললাম, কি খবর? তখনই সে এসব কাহিনী শোনাল।বাঘবন্দী মিসির আলীআরো বলল, র্যাবের দারোগা কুটু মিয়া নাকি আমাকেও খুঁজছে। হিমুর বাবার কথামালা শুনে আমার পুরাই আক্কেল গুড়ুম।কোথায় পালাব বুঝতে পারছি না।
-তাহলে বিয়ে বাড়িতে বর আসেনি?
-আর বর আসবে? পুরা বাড়িতে এখন শোকের মাতম লাগছে।
পরিস্থিতির এই হঠাৎ পরিবর্তনে আমার হাসি পায়। নলিনী বাবুর মুখটা খুব দেখতে ইচ্ছা করছে।
হঠাৎ খেয়াল করে দেখি চাঁদের আলোয় কয়েকজন যুবক আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে।ওরা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি বলি, তোমরা কারা?
ওদের একজন জবাব দেয়, আমি এবং আমরা আপনাকে চিত্রার কাছে নিয়ে যেতে চাই। নলিনী বাবু চিত্রার সাথে আপনার বিয়ে দিতে রাজি হয়েছেন।
আমি ওদের মানা করে দেই। মুখে রূপার চামচ নিয়ে জন্মাইনি সত্যি, তাই বলে কারো জীবনে আমি দ্বিতীয় মানব হতে চাই না।
তারা তিনজন চলে যায়। আমি দাঁড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখি।
এই নক্ষত্রের রাত, বয়ে চলেছে লিলুয়া বাতাসএসবই আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়।আমার সামনে অর্থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক মানবী-মৃন্ময়ী তার নাম।
মৃন্ময়ী তখনও আমার হাত ধরে রেখেছে, কেঁদে চলেছে ফুঁপিয়ে।
আমি মৃন্ময়ীর চোখ মুছে দেই। এক গুচ্ছ নীল অপরাজিতা ওর কোলে রেখে বলি, ছায়াসঙ্গী হয়ে জনম জনম তোমার চোখের জল মুছে দিতে চাই। আমার সাথে থাকবে?
ইতি,
শুভ্র
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৫২