সময়ঃ সন্ধ্যাবেলা।
মাগরিবের আযান হচ্ছে। বন্ধুদের সাথে হাটতে বেরিয়েছিলাম।বন্ধুরা হাটাহাটি শেষে যার যার হলে ফিরে গেছে (অবশ্য ফাকে বিকালের নাস্তাটাও সেরে নিয়েছি)।এখন একা একা হাটছি পলাশী যাব বলে।এখন বেজায় শীত পড়ছে। এমন শীতে পলাশীর মোড়ে দাঁড়িয়ে ধোয়া তোলা চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার মজাই আলাদা।
বুয়েটে আসার পর সম্ভবত দুই-এক সপ্তাহ পার হয়েছে। একদিন সিনিয়র রুমমেটের সাথে চা খেলাম পলাশীতে মানিক মামার দোকানে। সেই থেকে প্রতিদিন বিকালে কিংবা সন্ধ্যায় আমাকে মানিক মামার দোকানের সামনে পাওয়া যায়। সিনিয়র রুমমেটরা পাশ করে বিদায় নিয়েছে, মাত্র আর কিছুদিন। তারপর নিজেও পাশ করে বেরিয়ে যাব।চারপাশে অনেক কিছুই বদলেছে। বদলায়নি শুধু সেই বিকেল আর মানিক মামার চা।
ফিরে আসি আগের কথায়। হাটছিলাম মানিক মামার দোকানে যাব বলে। সোহরাওয়ার্দীর সামনে ছোট গেটটার সামনে দেখা হয়ে গেল জামীর সাথে।জামী আমাদেরই ব্যাচমেট। এক কালে ছাত্ররাজনীতিতে খুবই সক্রিয় ছিল, পরে প্রতিপক্ষের হাতে মারধোর খেয়ে (ভদ্র ভাষায় যাকে বলে নোংরা রাজনীতির স্বীকার হয়ে) এখন বসে গেছে।
দেখলাম জামী বেশ সাজগোজ করেছে। মুখটাও হাসি হাসি। জামীকে আমরা টিউশানী গুরু ডাকি। একই সাথে ৬ টা পর্যন্ত টিউশানী করার রেকর্ড তার আছে।কিন্তু জামীতো কখনো সেজেগুজে টিউশানীতে যায় না। তাহলে আজ ঘটনা কি?
“দোস্ত কি খবর?” জামী জানতে চাইল।
“ভাল।তোর কি অবস্থা?” জানতে চাইলাম আমি।
“চলতেছে দোস্ত”
“এত সাজুগুজু?টিউশানীতে যাস?” আমি একটা শয়তানী হাসি দিলাম।“নতুন স্টুডেন্ট পাইছস নাকি?”
এখানে বলে রাখি আমরা টিউশানীতে ছাত্রকে ছাত্র বলি আর ছাত্রীকে বলি স্টুডেন্ট।
“আরে টিউশানী না দোস্ত।অন্য কাজ” জামী হেসে জবাব দেয়।
“টিউশানী না মানে?” আমি অবাক হই “তুই টিউশানী ছাড়া আর কিছু জানস? তুই হাগা-মোতা ভুলে গেলেও টিউশানী ছাড়ার লোক না”
“আরে বলদ” জামী বিরক্ত হয় “টিউশানী সকালে করে আসছি।এখন যাচ্ছি ডেটিং-এ”
“উরিই বাবা, ডেটিং???” আমি ভ্রু নাচাই “কিন্তু সকালে ক্লাস মিস দিয়ে টিউশানীতে গেলি?”
“আজীব।তুই গাজা খাস না অন্য কিছু খাস” জামী ভ্রু কুচকে যায়।“স্যারদের স্ট্রাইক চলতেছে না। ক্লাস হইসে নাকি আজকে।ভাবলাম এই ফাকে টিউশানীটা করাই আসি।ঝামেলা সকালেই শেষ হয়ে গেছে।”
“ওহ হো” আমার মনে পড়ে।“ভুলেই গেছিলাম।আজকেতো আমিও ক্লাসে গিয়ে ফেরত আসছি।স্যারদের স্ট্রাইক।একটা কথা হইল?”
“দোস্ত” ফিসফিস করে বলে জামী।
“কি?” আমি জানতে চাই।
“স্যারদের স্ট্রাইকের কারন জানস?”
“হ্যা”
“কি কারন? বল দেখি” জামী জানতে চায়।
“ওই যে অবসরের বয়স বাড়ানোর জন্যইতো স্যাররা আন্দোলন করতেছে। তারা তাদের অবসরের বয়স বাড়িয়ে ৬০ থেকে ৬৫ করতে চায়।”
“তাই?” জামীর মুখে হতাশার হাসি।
“তাইতো শুনলাম” আমি বলি।
“কে বলছে তোরে?” জামী জানতে চায়।
“এক জুনিয়র”
“সে পলিটিক্স করে?”
“হ্যা।এর জন্যইতো ওকে জিজ্ঞেস করলাম। ওতো আমাকে তাই বলল।”
“আর তুই ওকে বিশ্বাস করলি?”
“হ্যা। করব না কেন?”
“কারন তুই বুয়েটে পড়স।আর কয়েক মাস পড়েই গ্র্যাজুয়েট হয়ে বের হবি।তোর কোন ধারনা নাই বুয়েটে গুজব জিনিসটা কত শক্তিশালী?”
“অবশ্যই আছে। থাকবে না কেন?”
“তাহলে...” এতটুকু বলে জামী থেমে যায়।
কি হল? পিছনে এক হলের জুনিয়র এসে দাঁড়িয়েছে।
“কি খবর ভাইয়া?” ছেলেট হেসে জানতে চায়।
“এইতো ভাল” আমিও হাসি “কোথায় যাও?”
“যাই ভাই, একটু রক্ত দিয়ে আসি”
এবার আমি খেয়াল করি। ছেলেটার পাশে এক বাধন কর্মী (স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংঘটন) দাড়িয়ে।হাতে একটা লিফলেটের মত কাগজ।
“কি এটা?”আমি জিজ্ঞেস করি।
“এটা?” হাতের কাগজটা দেখিয়ে জুনিয়র বলে।
“হ্যা”
“কিছু না ভাই। প্রেস রিলিজ”
“কিসের?” জামী জানতে চায়।
“বুয়েট কতৃপক্ষের। স্যাররা যে স্ট্রাইক করল সে ব্যাপারে প্রেস রিলিজ।”
“দেখি” জামী ব্যস্ত হয়ে ওটা নেয়।
“ভাই আমরা যাই”
“আচ্ছা”
ওরা দুজন চলে যায়। আমরা দুজন প্রেস রিলিজ পড়ি।
প্রেস রিলিজের মূল বক্তব্য সংক্ষেপে এরকমঃ ১৯৯৮ সালে ঢাবি তাদের শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ তে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয় ও তাতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়কে যুক্ত করার চেষ্টা করে।তখন এতে বুয়েট যুক্ত হয়নি। তখন বুয়েট যুক্ত হলে ১৯৯৮ সালেই স্যারদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ হয়ে যেত, যা হয়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাদের বয়সসীমা ৬৫ করার ঘোষণা দিয়েছেন ও শিক্ষা মন্ত্রনালয় এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।অথচ এই অবস্থায় স্যাররা তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ করার জন্য ক্লাস বর্জন শুরু করেছেন।
আমি বললাম, “দেখ, দেখ, ভাল করে দেখ। বলছিলাম না স্যাররা বয়সসীমা বাড়ানোর জন্য আন্দোলন করতেছে। দেখলিতো এবার। একেবারে রিটেন ডকুমেন্ট।বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষের বক্তব্য”
জামী দেখলাম আমার ওপর মারাত্মক বিরক্ত।“রাম ছাগল কোথাকার। পুরাটা ভাল করে পড়ছস? স্পষ্ট লেখা আছে স্যারদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫ করার প্রক্রিয়া চলমান আর জুন ২০১২ এর আগে কোন স্যার অবসরে যাবে না।তাহলে স্যাররা পুরা প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য সময় দিচ্ছে না কেন?”
আমার মাথায় কোন জবাব এল না।
“দেখ, অবসরের বয়স বাড়লে স্যারদের লাভ আর সেই প্রক্রিয়াই চলমান। বুয়েটের স্যাররা এতটা অমানুষ না যে অকারনে ছাত্রদের জিম্মি করে ক্লাস বর্জন করবে।”
“হুম্ম। তাহলে?”
“দেখ, কোরবানের পর আমরা তাড়াতাড়ি ক্লাস শুরু না করে অটো নিলাম। স্যাররা কিন্তু আমাদের তাড়াতাড়িই ক্লাস শুরু করতে চাইছিল। তারাও কিন্তু চায় সেশন জ্যাম কমুক, আমরা সময়মত পাশ করে বের হই। নাহলে অটো নিলে, পরীক্ষা পিছাইলে স্যারদের কি ক্ষতি? তারাতো সময়মত ঠিকই বেতন পাবে।ক্ষতিটা আমাদের।তাই না?”
“হ্যা”
“তাহলে ভেবে দেখ।৬০ বছরে অবসর নিলেও স্যারদের কোন ক্ষতি নাই। কেননা তারা বুয়েটের টীচার। কন্সাল্টেন্সি করে, প্রাইভেটে ক্লাস নিয়ে তারা এখনকার চেয়ে কম টাকা কামাবে না।”
“ঠিকই বলছস দোস্ত” এবার আমার বাত্তি জ্বলে। “তাহলে কাহিনী কি?”
“আজকে bdnews24.com এ ঢুকছস?”
“না। কেন?”
“ওইখানে একটা খবর পড়লাম যাতে ম্যাকানিকাল ফ্যাকাল্টির ডীন বলছেঃ সরকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবসর গ্রহণের বয়স সীমা ৫৫ বছর নির্ধারণ করেছে। কিন্তু, তা যথাযথ ভাবে পালন হচ্ছে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো হচ্ছে। সরকার নির্ধারিত ৫৫ বছর বয়সে অবসর গ্রহণের দাবিতে শিক্ষকরা কর্ম বিরতে পালন করছেন।”
“কি?”আমি চূড়ান্ত রকমের অবাক হই।“প্রেস রিলিজে বলল বয়স বাড়ানোর কথা আর এখানে স্যার বললেন বয়স কমানোর কথা। কোনটা বিশ্বাস করব?”
“সেটাইতো বলতেছি চান্দু।একটা আন্দোলন চলতেছে, কিন্তু সেটার আসল কারণ সম্পর্কে যাতে কেউ জানতে না পারে সেজন্য বিভিন্ন গুজব ছড়ানো হচ্ছে।আমার ধারনা তাদের আসল লক্ষ্য ছাত্ররা যাতে এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত না হইতে পারে।”
“তাহলে আসল ঘটনা কি?”
“আমিও ঠিক্টহাক জানি না দোস্ত। আজকে মানব বন্ধন হইছে জানস?”
“নাতো। কখন? কোথায়? কে করল?”
“সিভিল বিল্ডিং এর সামনে। কারা করছে আইডিয়া কর দেখি”
“নিশচয়ই যারা পরীক্ষা পেছানোর মিছিল করে তারাই”
“এইতো তোর ব্রেইন খুলছে। বুঝতে পারতেছস। চ্যানেল আই আসল আর কিছু পোলা- যাদের ক্লাসে তো দূর থাক , ল্যাব বা ক্লাস টেস্টেও দেখা যায় না তারাই ক্যামেরার সামনে বলে বসল স্যারদের ক্লাস নিতে হবে। এভাবে ক্লাস বর্জন করে তারা আমাদের পিছিয়ে দিতে পারেন না। আরে শুয়োরের দল, পরীক্ষা পিছানোর মিছিল করার সময় তোদের এই বিবেকবোধ কাজ করে না?”
আমি চুপ করে থাকি।
“বিকালে কই খাইলি?” জামি জানতে চায়।
“নজরুলের ক্যান্টিনে। কেন?”
“বিকালে কি তুই ক্যাফেতে খাস?”
“না।কি হইছে বল?”
“বিকালে শুনলাম ক্যাফে দখল হইছে। ক্যাফের বয়গুলাকে বের করে দিয়ে তালা ঝুলায় দিছে”
“হোয়াট দ্যা এফ...” আমি চিৎকার করে উঠি “কারা করল এই কাজ?”
“শুনলাম যারা এই কাজ করছে তার নাকি রাজনৈতিক মদদপুষ্ট এবং...”
“এবং কি?”
“থাক বাদ দে।তোকে এসব কেন বললাম জানিস?”
“কেন?”
“কারন স্যাররা এইসব অনিয়ম, রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ আর কিছু দালাল শিক্ষকের স্বেচ্ছেচারিতার বিরুদ্ধে আন্দোলন করতেছে। ছাত্ররা বা পুরা দেশ যাতে এর সম্পর্কে জানতে না পারে সেজন্যই এই বয়সসীমার গুজব ছড়ানো হচ্ছে।সাব্ধান থাকিস দোস্ত। এখনই কিছু করা না গেলে বুয়েটও শেষ পর্যন্ত কিছু শুয়োরের বাচ্চার আখড়ায় পরিনত হবে”
আমি কিছু বলতে যাই, কিন্তু পারি না। কে যেন কাধে হাত রেখেছে। আমি পিছনে ফিরে তাকাই।আমারই ব্যাচম্যাট, নোংরা রাজনীতি আর ছ্যাচড়ামি করে সে ইতিমধ্যেই পুরা ক্যাম্পাসে কুখ্যাত হয়ে উঠেছে।
“তোর মনে হয় পলিটিক্স আর পলিটিশিয়ান্দের গালি দিচ্ছিলি?”
আমি আর জামী দুজনেই হেসে বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্ট করি।“কি যে বলিস দোস্ত।আমরাতো টিউশানী নিয়ে আলোচনা করতেছিলাম”
“তাই?” অর চোখে অবিশ্বাস।“দেখিস, সাবধান থাকিস। বেফাস কিছু বলিস না বা করিস না।কারন জানিসইতো...”
ও আর কিছু বলে না। বাকিটা আমরা নিজেরাই বুঝে নেই।
ও চলে যায়। আমি আর জামী পলাশীর দিকে হাটা দেই। দুজনেরই মুখ বন্ধ। কিন্তু জানি দুজনেই মনে মনে গালি দিচ্ছি নষ্ট রাজনীতিকে, নিজেদের অক্ষমতাকে আর তাকিয়ে আছি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।
================================
এই লেখার প্রতিটি ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক। কারো সাথে তা মিলে গেলে সে নিজেই দায়ী, এজন্য আমি দায়ী নই।
শিরোনাম কৃতজ্ঞতাঃ ব্লগার বোহেমিয়ান কথকতা
বুয়েট ক্যাফে নিয়ে ফেসবুক ইভেন্ট
মানববন্ধন নিয়ে খবর
স্যারদের কর্মবিরতি নিয়ে খবর
বিস্তারিত জানার জন্য পড়ুন নীচের দুইটি পোস্টঃ
পোস্ট ১
পোস্ট ২
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:৫০