কয়েক মাস আগে স্যাটায়ারগুরু আবুল মনসুর আহমদের অসাধারণ ব্যাংগ রচনা সমগ্র “ফুড কনফারেন্স” নিয়ে আলোচনা করেছিলাম । “ফুড কনফারেন্স” নিয়ে আলোচনা করব অথচ একই লেখকের অনন্য কীর্তি “আসমানী পর্দা” নিয়ে লেখব না তা হয় নাকি??? এই বইটিতে রাজনৈতিক রম্য গল্পের পাশাপাশি দুইটি প্যারোডি কবিতাও আছে ।
বইটিতে মোট সাতটি স্যাটায়ার গল্প রয়েছে । এগুলো হচ্ছে- আসমানী পর্দা, খাজা বাবা, আহলে সুন্নাত, আদু ভাই, ত্রিযুগমিতি, নিমক হারাম, ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি । তিনটি প্যারোডি কবিতা হল “ছহি বড় সোনাভান” এর প্যারোডি “সহি বড় ওযারতনামা”, কাবি কাজী নজরুল ইসলামের “সাম্যের গান গাই” এর অনুকরণে “ট্যাক্সের গান গাই” ও “আয় বেহেশতে কে যাবি আয়” এর প্যারোডি “আয় ভেস্তে কে যাবি আয়” ।
পাকিস্তানের NO(National Organization) এর এক বৈঠক শুরু হয়েছে । ক্ষমতাসীন নেতারা নিজেদের অযোগ্যতা ও ক্ষমতলিপ্সার কারণে দেশের অধঃগতির কথা মানতে চাননা । নিজেদের বাছাই করা আলেম দিয়ে তাই নিজেদের সুবিধামত পরামর্শ নিয়ে থাকেন তারা । আলেমরা পর্দার বিধান শক্ত করার দিকে মত দেন । মহিলাদের পর্দা মানার নির্দেশ দেয়া হয় । কিন্তু কিছুদিন পর মহিলারা এসে বলে, বোরকা ছাড়া মহিলাদের দেখে পুরুষের মনে “শাহওয়াত গালেব” হয়, কিন্তু মহিলাদেরও তো রাস্তায় পর্দাছাড়া পুরুষ দেখে, তাদের মনেও তো পুরুষদের প্রতি “শাহওয়াত গালেব” হতে পারে । তারপর ঠিক হল যে পুরুষরাও বোরকা পড়ে রাস্তায় বের হবে । মেয়েদের জন্য লাল রঙ, এবং পুরুষের জন্য সবুঝ রং্যের বোরকা । এরপরও কিন্তু সমস্যা শেষ হল না । নতুন নতুন কি আজব আজব সমস্যা হল এবং তার সমাধানই বা কিভাবে তাই নিয়ে এগিয়ে যায় বাকি গল্প ।
“খাজা বাবা” গল্পের নায়ক হামিদ নামের একজন দারোগা যে নাকি আট বছর দারোগাগিরি করেও ইন্সপেক্টর হতে পারেনি । হামিদের সাথে একজন আপাতদৃষ্টিতে ধার্মিক বড় পুলিশকর্তার সাথে খাতির হয় । ইসলামিক নানা গ্রন্থের প্রতি হামিদের আগ্রহের কথা জানাতেই গল্পটিতে গতি চলে আসে । আসল কোরআন না পড়ে পীরের মুরীদি করে ইসলাম পালনের কথা পেড়ে বসে বড়কর্তা খান সাহেব । পীরের দোয়াতে নাকি হারাম হাতে পড়ে হালাল হয়ে যায় ইত্যাদি বিভ্রান্তিকর কথাবার্তায় হামিদের বিভ্রাবতি বাড়ে । নানা পীরের ঘাঁটিতে ঘুরেও হামিদের লাভ হল না । খান সাহেব হামিদকে নিয়ে চললেন আজমীর শরীফে । সেখানে ইসলামের নামে নানাবিধ গোমরাহীর চর্চা দেখে হামিদের মেজাজ আস্তে আস্তে বিগড়াতে শুরু করে । আল্লাহর নাম না নিয়ে খাজা বাবার নাম নেয়া, মাজারে ফুল ঢেলে দেয়া, মাজারের সিড়ির মাটিতে চুমা দেয়া, মাজারের সামনে সিজদা দেয়া, বেহেশতের দরজার সাথে আজগুবি তুলনা, সব মিলিয়ে খাজা মঈনুদ্দীন চিশতির এমন অসম্মান দেখে হামিদ আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি । ফলে দুনিয়াবী উন্নতিও তার হয়নি ।
“আহলে সুন্নাত” হল এক কিশোরের সুন্নত নিয়ে বাড়াবাড়ির গল্প । আবুল মনসুর আহমদের স্বকীয়তার ছাপ আছে । কিশোরের মৌলবী বাবা কিভাবে ছেলের এই বাড়াবাড়ি বন্ধ করলেন তাই নিয়ে এই গল্প ।
“আদু ভাই” গল্পটি নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই । অনেকেই এই গল্পটি পড়েছেন । “হেয়ার স্লিপ্স আদু মিয়া হু ওয়াস প্রমোটেড ফ্রম ক্লাস সেভেন টু ক্লাস এইট.........”
“ত্রিযুগমিতি অত্যন্ত কঠিন একটা স্যাটায়ার । এটা বুঝতে অনেক সমস্যা হবে । আমার মনে হয় “দ্বিজাতিতত্ত্ব” কে ব্যাংগ করে লিখেছেন । আপনারা সুযোগ পেলে পরে দেখুন আপনাদের কি মনে হয় ।
“খাজা বাবা”র মতই “নিমকহারাম” একটা মাস্টারপিস । টাউট বাটপারের হাতে লবণ পাচার হয়ে যাওয়ায় সরকার কিভাবে কুটিল মুফতির পরামর্শে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে পাবলিককে বশ মানায় তাই নিয়ে এই স্যাটায়ার । মুফতি যখন তার যুক্তিগুলো ভেঙ্গে নেতাদের বুঝায়, ইশ! কি আর বলব?......একেবারে দুর্দান্ত একটা পরিণতি দেয়া হয়েছে এই স্যাটায়ারের ।
“ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি”তে সিমলা সম্মেলনকে কেন্দ্র করে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ আর মহাত্মা গান্ধীকে একেবারে ধুয়ে দিয়েছেন । পড়লেই বুঝে যাবেন কি নির্মম ছিল সেই কলম-ধোলাই ।
আর প্যারডিগুলো সেভাবে কালোত্তীর্ণ হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি । আমি সেভাবে কো-রিলেট করতে পারিনি । হয়ত সেটা আমারই ব্যর্থতা ।
আবুল মনসুর আহমদ ধর্মীয় ভন্ডামির বিপক্ষে মোক্ষম প্রতিবাদ করেছেন দেখে কোন কোন সুযোগসন্ধানী নাস্তিক তাঁকে নিজেদের সুবিধামত ব্যবহার করতে চান । কিন্তু তাদেরকে বলে রাখি, আবুল মনসুর আহমদ কিন্তু আল্লাহ, রাসূলের প্রতি শ্রদ্ধা, ইসলামের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণেই বিবেকের তাড়না থেকে স্যাটায়ারগুলো লিখেছেন, কোন সুযোগসন্ধানীর কুযুক্তিতে ব্যবহার হতে নয় ।
আরো রভিউ
বাংলা স্যাটায়ার রিভিউ- "ফুড কনফারেন্স"(১৯৬৯)-আবুল মনসুর আহমদ
বই পর্যালোচনা- "ইন্টারভিউ উইথ হিস্টোরী"- ওরিয়ানা ফালাচি (১ম পর্ব)
বই রিভিউ- "সিনেমাওয়ালা"-সমরেশ মজুমদার