সমরেশ মজুমদারের লেখার সাথে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য সাহিত্যিকদের লেখা তুলনা করলে কিছু লক্ষণীয় পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে । অন্যরা যেখানে প্রায় সাধারণভাবে উপন্যাসের চরিত্রগুলোর জীবনে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে যান সেখানে সমরেশের লেখনীতে পাওয়া যায় থ্রিলারধর্মী আবহ । কাহিনী যা নিয়েই হোক না কেন সমরেশ রোমাঞ্চ মিশিয়ে উপস্থাপন করতে চেষ্টা করেছেন । সম্প্রতি তাঁর “সিনেমাওয়ালা” বইটা পড়ার সুযোগ হয়েছে । সেটা নিয়েই আজ কথা বলব……থুড়ি, লেখব……
কাহিনীর শুরুতে মিলন নামের একজন পরিচালকের নতুন ছবির জন্য নায়িকা খুঁজছেন । প্রযোজক বলছেন, গ্রামের সাধারণ মানুষদের মাঝে বাংলাদেশী নায়িকাদের নাকি ভাল চাহিদা আছে । কিন্তু বাংলাদেশে নাকি শুনে শুনে ডায়লগ বলে আর্টিস্টরা কলকাতায় যেখানে মুখস্ত করে বলার নিয়ম । বাইরে থেকে নায়িকা এনে মুখস্ত করালে বেশি খরচ হবে বলে নতুন নায়িকা খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ।
অনেক পরিচালক নাকি আছেন যারা অনেকদিন ধরে ছবির কাজ করে লাইম্লাইটে থাকতে চান । কিন্তু মিলন বাবু এইসব ব্যাপারে খুব নীতিবান । সংসার চালানোর মত টাকা শেষ হয়ে আসছে, ছবিটা তাই তাড়াতাড়ি শুরু করা উচিত । নায়িকা খোঁজার কাজে অনেক হেনস্তা হওয়ার পর স্ত্রীর মারফতে এমন একটি মেয়ের খোঁজ পেয়ে যান যে কিনা নায়িকার রোলে একদম মানিয়ে যাবে । পেশায় সেলসগার্ল এই মেয়েটির নাম অদিতি ।
যথাসময়ে স্ক্রিণ টেস্ট হল । দৃশ্যটা ছিল যে, টেলিফোন বাজবে এবং অদিতি গিয়ে ফোন ধরে সংলাপ উচ্চারণ করবে । ফোনের কাছে যাবার সময় কানের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়া ঘাম মুছল অদিতি, এই ছোট্ট ব্যাপারটা দেখেই ইউনিটের সবাই নবাগতা অভিনেত্রীর ভবিষ্যত খ্যাতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেল । যথাসময়ে সিনেমার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল ।
অদিতি মেস ছেড়ে ভাড়া ফ্ল্যাটে উঠল । ফটোশুটে অংশ নিল । পত্রিকায় সেসব ছবি ছাপা হলে এসে হাজির হল অদিতির আগের স্বামী কমলেন্দু । একটা সময়ে অদিতির কিছু অর্ধনগ্ন ছবি তুলেছিল কমলেন্দু, সেসব নষ্ট করেনি কমলেন্দু । অদিতিকে হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করতে চায় কমলেন্দু । প্রযোজক পরিচালক ও ঘটনা জেনে ফেলেন । পরে বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এত টাকা দিয়ে এসব ছবি কেনার ক্ষমতা কলকাতার কোন ফিল্মি ম্যাগাজিনের আদতে নেই । জাল পেতে কমলেন্দুকে ধরা হয় । সিনেমা শেষ হয় এবং সুপার ডুপার হিট হয় ।
জয়ন্তের মন্ত্রী পিতা জয়ন্ত-অদিতির সম্পর্কের কথা টের পেয়ে ব্যাপক ক্ষেপে যান ।
এবার শুরু হয় আসল সমস্যা এবং উপন্যাসটির কিছুটা অযৌক্তিক অংশও এখান থেকেই শুরু । প্রভাবশালী মন্ত্রীর ছেলে জয়ন্ত অভিনেত্রী অদিতিকে মনে মনে পছন্দ করে ফেলে । এইটুকু পর্যন্ত ঠিকই ছিল । অদিতির ফিল্মি ব্যস্ততা বাড়তে থাকে, বাড়তে থাকে জয়ন্তের সাথে সখ্যতাও । একপর্যায়ে জয়ন্তের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ফিল্ম ক্যারিয়ার শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয় অদিতি । এত তাড়াতাড়ি কোন শীর্ষ অভিনেত্রী অবসর নিয়ে নেয় বলে শুনিনি ।
সমরেশ পাঠকদের একটা সাধারণ অভিযোগ আছে যে, তিনি পুরো কাহিনীতে গাঁথুনি বজায় রেখে এমনভাবে শেষ করেন যে তা অনেকের মনঃপুত হয় না । “সিনেমাওয়ালা”তে প্রাভাবশালী মন্ত্রী ও তার সাংগপাংগদের ক্রমাগত হুমকিতেও পিছু হটে না । জয়ন্তের বাবার ক্রোধ থেকে বাঁচতে কিছুদিন দৃশ্যের আড়ালে থাকার জন্য আমেরিকার বিমানে চেপে বসে । কিন্তু কতদিনের জন্য? জয়ন্ত পরবর্তীতে কি করবে? কিছু দিন গেলেই কি অদিতি মন্ত্রীর ক্রোধ থেকে বাঁচতে পারবে??? এই সমস্ত প্রশ্নের জবাব না দিয়েই “সিনেমাওয়ালা” শেষ হয় ।
বইটি সাধারণ পাঠকদের জন্য । চলচ্চিত্রের অন্তরমহল নিয়ে আগ্রহীরাও পড়তে পারেন ইচ্ছা করলে । বইটি একবার পড়া ধরলে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে ইচ্ছা করবে । উপন্যাসটি বেশিরভাগ সময় আপনার আগ্রহ ধরে রাখবেই যদি আপনি উচ্চমার্গীয় সাহিত্যের কঠিন পাঠক না হয়ে থাকেন ।
সবাইকে ধন্যবাদ ।