আমি চেয়েছিলাম এই ডিসেম্বর মাসটায় আমাদের মহান মুক্তযুদ্ধ নিয়ে প্রতিদিনই ব্লগে কিছু না কিছু লিখবো। কিন্তু আমার তা আর হয়ে উঠে নি। ডিসেম্বর মাসের ৭ম দিন শেষ হয়ে ৮ম দিন শুরু হলো কিছুক্ষন আছে। ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে ব্লগে একটি লেখাও আমি দিতে পারিনি। যাই হোক কাজ-কর্ম মোটামুটি গুছিয়ে এখন কিছুটা অবসরে আছি। তাই এখন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কিছু লিখতে চাই।
সম্মানীত পাঠকগণ, আমার এই লেখা বিভিন্ন বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা এবং মিডিয়া থেকে পাওয়া আমার অভিজ্ঞতার আলোকে লেখা। ভুল ত্রুটি হলে শুধরে দিয়ে আমাকে উপকৃত করবেন বলে আশা করি। যাই হোক, কথা না বাড়িয়ে আমরা মূল লেখায় যাই।
একাত্তরের এই দিনে
৮ ডিসেম্বর বুধবার, ১৯৭১
যুদ্ধবিরতির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে ইয়াহিয়া খান
একাত্তরের উত্তাল এই দিনে রচিত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি বীরত্ব গাথা। মুক্তিসেনাদের প্রবল প্রতিরোধে প্রাণভয়ে বরিশাল, পটুয়াখালী ও ঝালকাঠি ছেড়ে পাক হানাদারবাহিনী পালিয়ে যায় এদিন। মুক্তিসেনারা গর্বিত কন্ঠে দক্ষিণের এই তিনটি অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত ঘোষণা করেন।
এদিন পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যুদ্ধবিরতির জন্য মরিয়া হয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ধর্ণা দিতে থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, বৃটেন, ফ্রান্স ও পোলান্ড এ ব্যাপারে ভোটদানে বিরত থাকে।
মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী ঢাকায় হানাদার বাহিনীর অবস্থানগুলোতে বিমান হামলা জোরদার করেন। নিশ্চিত পরাজয়ের আশংকায় ইয়াহিয়া খান কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠনের আহ্বান জানান।
মুক্তিযোদ্ধাদের চোখে যুদ্ধ বিজয়ের স্বপ্ন। সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে তারা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের উপর নৃশংস হত্যাকান্ড শুরু করে। এদিন পাকিস্তানের ৬ নম্বর সেক্টরের উপ-সামরিক আইন প্রশাসক বাংলাদেশের সর্বত্র বিকেল ৫টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সান্ধ্য আইন জারি করে।
আজ যেসব এলাকা শত্রুমুক্ত হলো
বরিশাল ঃ ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক হানাদারদের দখলদারিত্বের কবল থেকে বরিশাল মুক্ত হয়। ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান দিয়ে এদিন মুক্তিযোদ্ধারা আকাশ-বাতাস মুখরিত করেন। ১৭ এপ্রিল প্রথম পাকবাহিনী আকশ পথে বরিশাল ও পটুয়াখালীতে হামলা চালায়। ২৭ এপ্রিল জল, স্থল ও আকাশপথে। বরিশাল শত্রুকবলিত হওয়ার আগেই সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলা সরকারের সচিবালয়। এ সচিবালয় থেকেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করা হতো।
পটুয়াখালী ঃ ২২৬ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর একাত্তর সালের এই দিন ভোররাতে মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে গোলাবারুদ ফেলে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর ইয়ামিন তার দোসরদের নিয়ে একটি লঞ্চে করে পটুয়াখালী থেকে পালাতে বাধ্য হয়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এই অঞ্চলেও পাকবাহিনী চালায় বর্বর নির্যতন।
ঝালকাঠি ঃ মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে ৭ ডিসেম্বর ভোর থেকে পাক হানাদার বাহিনী নৌপথে ঝালকাঠি ত্যাগ করতে থাকে। এ খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা শহরের চারপাশে এসে অবস্থান নেন। ৮ ডিসেম্বর শহরে প্রবেশ করে মুক্তিযোদ্ধারা ঝালকাঠি থানা দখল করে নেন। সেই সঙ্গে শহরে তাঁদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।
মৌলভীবাজার ঃ মৌলভীবাজার হানাদার মুক্ত হয় আজ। মৌলভীবাজার ছিল পাক হানাদার বাহিনীর ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার। ৫ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর ঘাঁটিগুলোতে বিমান আক্রমণ শুরু হয়। প্রতিরোধের মুখে পাকবাহিনী টিকতে না পেরে সিলেটের দিকে পালাতে থাকে। ৬ ও ৭ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার একেবারে ফাঁকা হয়ে পড়ে। ৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম দলটি মৌলভীবাজার শহরে প্রবেশ করে এবং মৌলভীবাজার কোর্ট বিল্ডিং-এ প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।
গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) ঃ ১৯৭১ সালের এদিনে পাক হানাদার বাহিনী পালিয়ে গেলে শত্রুমুক্ত হয় গৌরীপুর। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে ৩ নভেম্বর পলাশকান্দায় এক যুদ্ধে শহীদ হন সিরাজ, মঞ্জু, মতি, জসিম। শ্যামলগঞ্জে প্রাণ হারান সুধীর বড়–য়া। পাক হানাদার বাহিনী ৭ ডিসেম্বর রাতে রেলযোগে পালিয়ে গেলে ৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা গৌরীপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
ভালুকা (ময়মনসিংহ) ঃ ১৯৭১ সালের এই দিনে আফসার বাহিনীর কাছে প্রায় ২ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য, রাজাকার, আল-বদর সদস্যরা আত্মসমর্পণ করলে শত্রুমুক্ত হয় ভালুকা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া ঃ মিত্র বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে ৭ ডিসেম্বর রাতে পাকবাহিনীর সদস্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ছেড়ে আশুগঞ্জের দিকে পালাতে থাকে। ফলে ৮ ডিসেম্বর বিনা বাধায় মুক্তিযোদ্ধারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
মিরসরাই (চট্টগ্রাম) ঃ ৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা মিরসরাই হাইস্কুল, মিরসরাই থানা ও সিও অফিসে পাক হানাদারদের ওপর আক্রমণ চালান। বেলা ১১টার দিকে দুই পরে মধ্যে গুলিবিনিময় শুরু হয়। এক পর্যায়ে পাক হানাদাররা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ফলে শত্রুমুক্ত হয় মিরসরাই।
চাঁদপুর ঃ ৬ ডিসেম্বর মুদাফফরগঞ্জ মুক্ত হওয়ার পর যৌথ বাহিনী চাঁদপুরের দিকে এগুতে থাকে। ৭ ডিসেম্বর রাতেই হানাদাররা হাজিগঞ্জ ছেড়ে চাঁদপুর চলে আসে এবং চাঁদপুর থেকে গানবোট, স্টিমার, লঞ্চযোগে নারায়ণগঞ্জের দিকে পালিয়ে যায়। ৮ ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে শহরে প্রবেশ করেন।
কুমিল্লা ঃ ৭ ডিসেম্বর রাতে মিত্রবাহিনীর একটি দল কুমিল্লা বিমানবন্দরে অবস্থানরত পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালান। ভোরে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করে। বানাশুয়া হয়ে শহরের ভাটপাড়া কাপ্তানবাজার দিয়ে মুক্তিবাহিনীর একটি দল শহরে প্রবেশ করে। আরেকটি দল বিবিরবাজার হয়ে চকবাজার দিয়ে শহরে প্রবেশ করে। মুক্ত হয় কুমিল্লা। উল্লাসে ফেটে পড়েন মুক্তিকামী মানুষ।
পিরোজপুর ঃ ৭ ডিসেম্বর রাত ১০টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা পিরোজপুরের দণিপ্রান্ত পাড়েরহাট বন্দর দিয়ে শহরে প্রবেশ করে। উত্তর দিকে কদমতলা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অপর একটি দল শহরে ঢুকে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের আগমনের সংবাদ পেয়ে পাক হানাদাররা কচা নদী দিয়ে শহর ছেড়ে বরিশালের উদ্দেশ্যে পালিয়ে যায়।
কালকিনি (মাদারীপুর) ঃ ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কালকিনি থানা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে চলে আসে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে ৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদাররা মাদারীপুর শহরের দিকে পালিয়ে যায়।
লোহাগড়া (নড়াইল) ঃ ৮ ডিসেম্বর প্রায় ১ হাজার ২শ’ মুক্তিযোদ্ধা লোহাগড়া থানার পুলিশ ও রাজাকারদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে লোহাগড়া মুক্ত করেন।
এছাড়া আজ শত্রুমুক্ত হয় নলছিটি, মির্জাগঞ্জ, মিরপুর (কুষ্টিয়া), ফুলবাড়িয়া (ময়মনসিংহ), পলাশবাড়ী সহ বিভিন্ন এলাকা।