মাঝেমাঝে শেষ বিকেলে এক ঘণ্টা ফ্রি টাইম পাওয়াটাই বেশি বোরিং। কিচ্ছু করার নাই, কোত্থাও যাওয়ার নাই। খুব বেশি ছোট ছিলাম যখন, তখন লেখালেখির শখ ছিল। এখন সেও উবে গেছে।
জানালার গ্রিলগুলো জেলের গরাদের মত লাগে।
শেষ বিকেলে জানালা ধরে বসে থাকি। হাতে কফির মফ, সেখান থেকে সাদা সাদা ধোঁয়া ওঠে।
ওই দূরেও কোন বিল্ডিং-এর পেছন থেকে ধোঁয়া উঠছে। সাদা ধোঁয়া। আম্মু রান্নাঘরে বসে আছে। চুলার উপরে রাখা পাত্র থেকেও ধোঁয়া ওঠে। সামনের ছাদে আসা আঙ্কেলের সিগারেট থেকেও ধোঁয়া ওঠে। সব ধোঁয়াই সাদা রঙের।
ঘনবসতির দেশ, প্রত্যেক বর্গকিলোমিটারে নাকি নয়'শর বেশি লোকের বসবাস। এক বর্গকিলোমিটার যায়গায় নয়'শ জীবনের গল্প লেখা হয়।
কারো গল্প কিংবদন্তি হয়ে যায়। কিছুটা সস্তা দামে হলেও বিকিয়ে যায় কারো কারো গল্প। বেশিরভাগের গল্পই কেউ শুনতে চায় না। সময় হয় না শোনার।
গল্পগুলো মাঝরাতে শোবার বালিশে জমা হয়। নোনাজলে বালিশ ভিজে ভারী হয়। চাপ সইতে না পেরে ছিঁড়েও যায় একসময়। ছেঁড়া বালিশ থেকে তুলা বের হয়ে আসে, গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে বাতাসে মিশে যায়। গল্পের পরিণতি, কেউ শুনতে চায়নি, কারো শোনা হয় না।
একসময় ভাবতাম, বালিশের ছেঁড়া তুলাগুলোই হয়ত "মেঘ" নামে আকাশে ঠাই নেয়। জমে থাকা জল ঝরিয়ে দেয়, "বৃষ্টি" নামে।
ভাবতাম হাজার মানুষের দীর্ঘশ্বাস মিশেই হয়ত তৈরি করে শীতের কুয়াশা। শীতকালে হতাশ মানুষগুলোর দীর্ঘশ্বাস দেখা যায়। গরমকালে তা সবার চোখের আড়াল।
চাইলে কিন্তু দেখা যায়। দেখতে চাইলে গরমকালেও পাশে বসা মানুষটার দীর্ঘশ্বাস দেখা যায়। এড়িয়ে যেতে চাইলে শীতকালেও কিছুই চোখে পড়ে না।
খুব বেশি ছোট ছিলাম যখন, তখন কবিতা লিখতে ইচ্ছে করত। কিছুটা বড় হবার পর সে শখ চলে গেছে।(আমি এখনও অনেক ছোট কিন্তু!)
ইদানিং কবি মানুষগুলার জন্য বরং বেশিই খারাপ লাগে।
"ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়", সেই রাজ্যে কবি হইতে চাওয়াটা বিভিষিকা!
রাস্তাঘাটে মানুষ দেখি; তাঁরা বিজ্ঞাপন পড়ে, সিনেমার পোস্টারের দিকে তাকায় থাকে। মানুষের কনফিডেন্সের বড়ই অভাব! "গোপন সমস্যা সমাধান" টাইপ লিফলেটগুলার দিকে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়া তাকায় থাকে। শুধু কবিতার একটা বই সাধা হোক, সেটাই পড়ে না। সিরিয়াসলি, ফ্রিতে পাইলেও পড়ে না। উপহারে পাওয়া কবিতার বইটা কয়জনে পুরোটা পড়ে? উপহারে কবিতার বই পায়ই বা কয়জন? দেবেটাই বা কে?
বেচারা কবিগুলা, লম্বা লম্বা চুল দাড়ি নিয়া ঘোরাঘুরি করে। শখ করেই রাখে নাকি? মে বি শখ করেই রাখে। চুল দাড়ি কাটানোর খরচও অবশ্য কম না। এই টাকায় কম বেশি পেট ভরায়াও ফেলা যায়। অ্যাট লিস্ট আরও তিন কাপ চা তো খাওয়া যাবে। আরও এক রাত জেগে তো থাকা যাবে। আরও একটা কবিতা লেখা যাবে।
মানুষ কবিতা পড়ে না, এতে মানুষেরে দোষ দিয়াই বা লাভ কি। আজকালকার কবিতাও! সহজ কথাটারে ঘুরায় প্যাঁচায় দুনিয়ার কঠিন করে বলা। তারপর এমন ভাব করা, যেন কথাটা এরচেয়ে সহজভাবে আর বলাই যেত না।
কবি আর কবিতা দেখলে লোকে যে পাগলামি ভাবে, এতে লোকের দোষ কতটুকু?
সন্ধ্যা ঘনায়।
ক্লান্ত লোকেরা ঘরে ফিরতে থাকে। আন সাকসেসফুল কবিরা ঘরে যায় না। নতুন কবিদের ঘরে ফেরার মুড নাই। পুরান কবিদের ঘরে ফেরার মুখ নাই। তারা রাস্তায় ঘুরে। পাবলিশার টু পাবলিশার।
মাঝেমাঝে রাস্তায় রাতুল নামের বাচাল ছেলেটাকে পেলে হাতে একটা পাণ্ডুলিপি ধরিয়ে দ্যায়, "পড়ে বলুন না, কেমন হয়েছে?"
কবি আর তার কবিতাকে নিয়ে উপন্যাস লিখে ফেলা যায়। লিখবে কে? সে গল্প পড়বেই বা কে? কবিদের খাতা জুড়ে ভালোবাসার কবিতা, বাকি পুরো ঘরটা জুড়ে দুঃখ-গাঁথা, ছেঁড়া কাথার গল্প। আরো অনেকের ছেঁড়া তুলার মেঘ হয়ে হারিয়ে যায় গল্পগুলো।
কেউ পড়তে চায় নি, কারো পড়া হয় না......
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১৬ বিকাল ৪:৩৫