বাল্যকালে ইস্কুলের বইতে যে সমস্ত কবিতা পড়ে কখনো আনন্দিত আবার কখনো রোমাঞ্চিত হতাম তেমনই একটি কবিতা হচ্ছে- ‘এক যে ছিল মজার দেশ সবকিছুতে ভালো, রাত্তিরেতে সূর্য সেথায় দিনে চাঁদের আলো’। আনন্দে আটখানা হবার মতো কথাই বটে। তখন খুব ইচ্ছে হতো এমন এক মজার দেশে চলে যাবার। আহা! সে দেশে ডাঙ্গায় উড়োজাহাজ চলে। কি চমৎকার! মজার সেই দেশে সবই উল্টো নিয়মে চালিত হয়। মাছ ওড়ে আকাশে আর জলের তলায় ঘোরে চিল। তখন কেবলই ভাবতাম সেই আশ্চর্য দেশ কোথায়। সেকি পৃথিবীর বাইরে? যদি জানতাম!
পরে বড় হয়ে যখন কিঞ্চিৎ বোধশক্তির অধিকারী হলাম তখন ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম যে এমন মজার দেশ কেবল কবির কল্পনাপ্রসূতই নয়। এমন দেশ সত্যিই আছে এবং তা এই পৃথিবী নামক গ্রহের বাইরেও নয়। কিন্তু যতদিনে জানলাম ততদিনে সে দেশে যাবার ইচ্ছের লেশমাত্রও আর অবশিষ্ট থাকলো না। সেই মজার দেশের নাম ‘বাংলাদেশ’।
নিজের দেশের এমন আশ্চর্য মহাত্ত্বের কথা শুনে যাদের ললাট কুঁচকে ছোট হয়ে যাবার যোগাড় তারা জানবেন যে অত্যন্ত সূক্ষè বিচার-বিশ্লেষণেই বঙ্গদেশের এমন গুণাগুণ সম্বন্ধে নিশ্চিৎ হওয়া গেছে। কবির কবিতায় আমরা জেনেছি যে, মজার সেই দেশে জলের তলায় চিল আর আকাশে মাছেরা বিচরণ করে। এ আর এমন কি আশ্চর্য হবার বিষয়? আমাদের বাংলাদেশেও তো যাদের স্থান সবার উপরে থাকার কথা তারাই পড়ে থাকে সবার নিচে। গণতান্ত্রিক শাসন প্রক্রিয়ায় জনগণই সর্ব্বোচ্চ ক্ষমতার মালিক। তাদের স্থান সবার উপরে থাকার কথা। কিন্তু গভীর জলের মাছেরা নিজেরা আকাশে উড়ে বেড়ায় আর জনগণ থাকে নিচে পড়ে। আরো আশ্চর্য ব্যাপার এই যে আমাদের মজার এই দেশে এক মূহুর্তেই সব উল্টে যায়। আজ যারা ভিক্ষুক, যারা আমাদের দরজায় এসে কেঁদেকেটে ভোট ভিক্ষা করে, তারাই কাল এক ভেল্কিতে রাজা বনে গিয়ে আমাদের পেটেই লাথি মারে। ‘আশ্চর্য রাজ্যের’ (ওয়ান্ডারল্যান্ড) অ্যালিসের চাইতে আমরা কম ভাগ্যবান কিসে? সে ভাগ্যগুণে কিছুদিনের জন্য র?পকথার রাজ্যে চলে গিয়েছিল, আর আমরা জন্মসূত্রেই এক রূপকথার দেশের নাগরিক। আমরা রূপকথার গল্প শুনি সর্বত্র। ‘আমরা ক্ষমতায় গেলে অমুক করা হবে, দ্রব্যমূল্য কমানো হবে, দশ টাকা সের চাল দেয়া হবে, এবার জাতীয় প্রবৃদ্ধি এত হয়েছে, তমুক দল ক্ষমতায় এলে জনগন কিছু পায়, উন্নয়নের জোয়ারে দেশ ভেসে যাচ্ছে’ ইত্যাদি।
এ সমস্ত অসম্ভব কথায় আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে এগুলোকে আমরা রূপকথার অধিক কিছুই মনে করতে পারিনা। এর চাইতে পিঠা গাছে ধরাই আমাদের কাছে বেশি বিশ্বাসযোগ্য।
মজার দেশের মজার কথা আর কি বলবো? এ দেশে এম.এ. ,বি.এ. পাশ করে বেকার বসে থাকতে হয়। আর এম.পি. ,মন্ত্রী হতে প্রয়োজন হয় না কোন বিদ্যার। এ দেশে পুলিশ চোর ধরে না, চোরদের পদসেবা করে। এ দেশে শিক্ষা পদ্ধতির উন্নয়নকার্যের যোগ্যতা নেই-এমন একজন ‘শিক্ষামন্ত্রী’, অর্থের কারচুপিতে সিদ্ধহস্ত একজন ‘অর্থমন্ত্রী’, আইনের শীতলমস্তিষ্ক একজন ঘাতক ‘আইনমন্ত্রী’। আর এই সবার যিনি পথপ্রদর্শক তিনি ‘প্রধানমন্ত্রী’। সুবিধাভোগী পোশাকী বন্ধুরা এদেশের বুক চিরে ট্র্যানজিট নেয় আর বিনিময়ে দেয় লাশ। যারা স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা করেছিল তাদের আমরা নির্দ্বিধায় দিয়ে দেই তেল-গ্যাস।
আরো মজা এই যে, এদেশের মানুষ এসব দেখে না। এসব অবশ্য খোলা চোখে দেখবার বিষয়ও নয়। চক্ষু মুদে একটু অন্তদৃষ্টি দিয়ে তাকালেই জলের মতো সব স্বচ্ছ হয়ে যায়। কবি তো মজার দেশ সম্পর্কে বলেই গিয়েছিলেন-‘চোখ খুললে যায় না দেখা, মুদলে পরিষ্কার’। তবে কথা হলো যে, সে অন্তর্দৃষ্টিও অনেকের থাকে না। যতদিনে তাদের সেই চক্ষু জাগ্রত হয় ততদিনে রক্তমাংসের আসল চক্ষু ঝাঁপসা হয়ে আসে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ সকাল ৮:৫৪