এইতো সেদিন ঘুরে আসা হয়েছিলো জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কী নেই সেখানে? দিগন্ত ছুঁয়ে যাওয়া মাঠ, সবুজ ঘাস, দীঘি পুকুর, ধানক্ষেত, মাইলের পর মাইল গাছে ঢাকা রাস্তা, আর অনেক দূরে দূরে একেকটা ডিপার্টমেন্ট। একজন স্বাভাবিক মানুষের কবি হয়ে যাওয়া সেখানে অলীক কিছু না। আজকে মনে হচ্ছে একটা বিশাল অন্ধকার তথা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়টিতে। সেলিম আল-দীন আর নেই সেখানে। যিনি জাহাঙ্গীর নগরের নাট্যকলা বিভাগের স্থপতি। এবং সেই সাথে একজন প্রথিতযশা নাট্যকার। তার মৃত্যু হলো কাল।
কিন্তু আমি আজকেই জানতে পারলাম তাঁর জীবনের ইতিহাস। কেন? কারণ গতকাল তাঁর মৃত্যু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। এরপর জাহাঙ্গীর নগরের প্রফেসর হোন বাংলা বিভাগের। পরে নাট্যকলায় যোগ দেন। ঢাকা থিয়েটারে তিনি কাজ করতেন বেশির ভাগ সময়। তাঁর নাটকে প্রাচ্য যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনটি পাশ্চাত্য পায়নি। তিনি নাটকের প্রোসেনিয়ামের বিরোধি ছিলেন। আর প্রাচ্যকে আলোকিত করে গড়ে তুলেছিলেন এক অনন্য নাট্যরূপ। অনেকবার তাঁর কাজের সমালোচনা হয়েছিলো। কিন্তু কর্ণপাতও তিনি করেননি। নাটকের উপকরণ সংগ্রহের জন্য ঘুরে বেড়াতেন রাত বিরেতে, একটা জোতসানা রাতের পটভূমি লেখার জন্য একবার বিনিদ্র কয়েকরাত যাপন করেছিলেন। একেকটা স্ক্রীপ্ট লেখতেন অনন্য উপায়ে, এবং বিশালার। রবীন্দ্রনাথ ভ্রমণ প্রিয় ছিলেন। নাট্য উপকরণের জন্য তার ঘুরে বেড়ানোর ইতিহাস আছে। আসলে নাটক সাহিত্যের একটা বিশাল অংশ। যেটাতে নিঃশ্ব বাঙ্গালি আজ। মাইকেন মধূসুদন কর্তৃক সৃষ্ট নাট্য যাত্রা রবীন্দ্রকালেই থমকে গিয়েছিলো। সেই রূপটি ফিরিয়ে আনার জন্য সচেষ্ট ছিলেন সেলিম আল-দীন। তাঁর জীবনের প্রথম নাটক ছিলো শকুন্তলা।
আজকাল বাংলা টিভি চ্যানেল খুললেই আমাদের নাটকের দৈন্যদশা দেখে কষ্ট পাই। এক প্রেম ছাড়া কোন উপাখ্যান নেই। গুটি কতক ভাল নাটক হলেও, বিষয়বস্তু স্তব্ধ হয় প্রেম পীড়িতে। আর আজকে আশ্চর্য হচ্ছি, দেশে এরকম একজন নাট্যকার ছিলেন যার কদর কেউ করেনি। তাহলে হয়তো আমরা আমাদের টিভি চ্যানেল গুলোতে দেখতে পেতাম ভিন্ন কিছু। এখন প্রত্যেক চ্যানেল বেঁচে আছে তাদের খবর দিয়ে। এছাড়া দেখার মত কিছুই নেই।
আমি আরও একটা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষারত। তাহলে হয়তো আরেকবার জানা হবে আমাদের দেশের বিশাল একজন মানুষ প্রদীপের বাতির মতই নেই হয়ে গ্যাছেন। আর তাঁর সৃষ্টিকর্ম আমরা সেই সময়েই টের পাবো। এছাড়া আর পাওয়া যাবে না। এখন একজন মানুষ হাসপাতালে গেলেই তাকে নিয়ে লেখা শুরু করে দেন আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা। কারণ পরেরদিন পত্রিকায় তার লেখাটি ছাপবে যদি ব্যাক্তিত্বটি দয়া করে আজ রাতের মধ্যেই মরে যান। তা না বলে মনে হয় বলা উচিত পত্রিকা প্রকাশ হওয়ার আগেই মরে যান। বেঁচে থাকতে গুণির সমাদর করি না আমরা। আমাদের নাটক কী কবিতা বুঝার সময় তো নেই। কিন্তু পার্কে বসে প্রেমিকার অধরটা কামড়ে দেওয়ার সময়টা ঠিকি পাই, আর অফিসের লাঞ্চের নাম করে তিনি ঘন্টা ঘুরাও হয়। সময় নেই কাররই, না মধ্যবিত্তের না উচ্চবিত্তের। মাঝখান দিয়ে শিল্প আর শিল্পী দুইজনই আকাশে পারি জমাচ্ছেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জানুয়ারি, ২০০৮ সকাল ১১:২৪