ভোরের কাগজে প্রকাশের লিংক Click This Link
তুষার শুভ্র পাঞ্জাবি তার ওপরে হাতা কাটা কোট, যেন কাটা রাইফেল। পর্বতসম দেহ নিয়ে জনতার ঢেউ বুকে ঠেলে উঠে দাঁড়ালেন গণসূর্যের মঞ্চে। যেভাবে পৃথিবীর কোথাও কেউ দাঁড়ায়নি আগে। স্বাধীনতার কথা আর বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দিতে মানুষে মানুষে। কবি দাঁড়ালেন জনতার সম্মুখে । অতঃপর সাত কোটি মানুষের বুকে অনুরণন তুলে কবি শোনালেন, তাঁর মৃত্যুহীন কবিতাখানি- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হয়ে গেলো। বাঙালির সেই স্বাধীনতার কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
৭ মার্চ, ১৯৭১ এর সেই বসন্তের বিকেলে পূর্ব বাংলার টেকনাফ থেকে তেতুঁলিয়া সর্বত্র হতে লাখো জনতা এসে মিশে ছিলেন রেসকোর্স ময়দানে। আর আকাশ-কাঁপানো স্লোগান আর করতালির মধ্যে কবি তর্জনি তুললেন। শুরু করলেন তার ঐতিহাসিক ভাষণ। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে কবিতার মত বিদ্রোহ ছড়িয়ে দিলেন। বললেন, ভাইয়েরা আমার, আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে শোষকেরা আমাকে নিতে পারেনি । ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিতে পারেনি। আপনারা বুকের তাজা খুন ঢেলে আমাকে পাকিস্তানি সব ষড়যন্ত্র আর হামলা, মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবো। আজো আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।
শেখ সাহেবের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার কথা। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার আহ্বান। পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রের ২৩ বছরের শোষণে বিরুদ্ধে অগ্নিস্ফূলিঙ্গের মতো জেগে ওঠা পুরো বাংলাকে একটি ভাষণে বেঁধে ফেললেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা। মাত্র ১৮ মিনিটের সেই কালজয়ী ভাষণ বিশ্ব ইতিহাসে নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করলো। ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ২৩ বছরের লড়াই সংগ্রামের বর্ণনা, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার নির্যাতনের চিত্র, সময়ভেদে বাঙালি জাতির করণীয় নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। কোমলে-কঠোরে উচ্চারিত কবিতার মতো প্রখর এই ভাষণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের আলোকবর্তিকা। কবি যেমন হৃদয়ের সবটুকু অনুভূতি শব্দের মালায় গাঁথেন, লেখক যেমন কল্পনার জমিনে তৈরি করেন উপন্যাসের প্রচ্ছদ, এর চেয়েও তুলনাহীন এক অনুভূতি দিয়ে সাত কোটি বাঙালির স্বপ্ন আঁকলেন মহান নেতা। শোষণের নাগপাশ থেকে মুক্তির আগুন ছড়িয়ে দিলেন দিগ্বিদিক।
পর্বত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। সেদিনও ফাগুনের আগুন ছিল মুক্তিকামী বাঙালির হৃদয়ে। সেই আগুনে যেন ঘি ঢেলে দিলেন স্বাধীনতার বরপুত্র শেখ মুজিবুর। ওই ভাষণের ইস্পাত কঠিন ধ্বনিতে বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম। ত্রিশ লাখ শহীদ আর লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং গোটা জাতির আত্মত্যাগে ৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। জন্ম হয় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে স্বাধীন ভূখণ্ড যার নাম বাংলাদেশ।
আজও এই ভাষণ শুনলে শরীরের ভেতর-বাহির জেগে উঠে। বক্তার শব্দ, বাক্য ও তথ্য চয়ন মিলে এই ভাষণ এখন জন-যোগাযোগেরও (পাবলিক স্পিকিং) এক উল্লেখযোগ্য আধেয়। ছোট বাক্যে, বিশাল জনগোষ্ঠীর স্বপ্নের কথা বলেছেন স্বাধীনতার পাঞ্জেরী শেখ সাহেব। যদিও এটা ছিল অলিখিত ভাষণ, কিন্তু একটি বাক্য দুই বার উচ্চারণ করেননি তিনি। তার বলার ভঙ্গি ছিল বিরোচিত। কথোপকথনের ভায়ায় তিনি পুরো বক্তব্য তুলে ধরেছেন। যার ফলশ্রুতিতে মুক্তিকামী মানুষ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। আঠারো মিনিটের একটি বক্তৃতায় রাজপথে মুক্তির মিছিল নামে।
একটি রাষ্ট্রের জন্মমৃত্যুর সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে দেয়া এ ভাষণের সঙ্গে আমাদের বিরাট আবেগ জড়িয়ে আছে।বিশ্বের অন্য সব সেরা ভাষণের সঙ্গে এই ভাষণের পার্থক্য হলো, এটি বঙ্গবন্ধু স্বতঃস্ফূর্তভাবে (লিখিত না) দিয়েছিলেন ময়দানে, সমবেত লাখ লাখ মানুষের সামনে। যারা স্বাধীনতা লাভের প্রত্যাশায় সমবেত হয়েছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। অন্য বিখ্যাত ভাষণগুলোর ক্ষেত্রে বক্তাদের এমন স্বাধীনতাপ্রত্যাশী জনতার সামনে দাঁড়াতে হয়নি। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে মন্ত্রের মতো সেইসব উচ্চারণ আজো প্রতিটি বাংলাদেশিকে উদ্বেলিত করে। যে কোনো আন্দোলনে তার সেই ভরাট কণ্ঠস্বর প্রেরণা জোগায়। ভাষণের ভিডিও টেপ এখন বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার করা হয়। টেলিভিশন চ্যানেল ছাড়াও ইউটিউব, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাষণটি এখন ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে স্বাধীনতা শব্দটি বঙ্গবন্ধু নামটির সঙ্গে জড়িয়ে গেল।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৪:৫৮