ভোরের কাগজে প্রকাশের লিংক Click This Link
কারো পুকুরভরা মাছ, বিষ মিশিয়ে দাও। জলিলের খেতভরা সবুজ ধান, মাড়িয়ে দাও। পণ্ডিতবাড়ির মেয়ে, তা বিয়ে ভেঙে দাও। মোল্লাবাড়ি জামায়াতি, তো পুলিশ পাঠাও। দলনিরপেক্ষ সেতো কেউ আবার শহুরে বাতাসে নতুন শিক্ষিত ভূত। আমাদের ভাবখানা এমন যেন সবাই সব দোষে দুষ্ট। দেশে বস্তুগত ও অবস্তুগত সংস্কৃতি ভেঙ্গে পড়েছে সর্বত্র এ দলগত মানসিকতার চর্চার জন্য। তারুণ্য, শিক্ষা, কলকারখানা ও দেশপ্রেম কোথায় যেন একটা রাজনৈতিক ব্র্যান্ডিং হয়ে যাচ্ছে। সবাই নিজেই একটা পথ ও নিজেই স্বতন্ত্র একটা মত।
তবে ব্যতিক্রম শুধু এ দেশের ক্রিকেট। বাংলাদেশে ক্রিকেট এমন একটা জয়গায় পৌঁছেছে যেখানে সমস্ত সবুজ জুড়ে লাল মিলে মিশে একাকার। যে ভালোবাসার কথা বলতে গেলে চোখ বুজে আসে সুখে, তেমন ভালোবাসানুভূতি ঝরে এ দেশের ক্রিকেটের জন্য। ভক্তকূল এ খেলায় কোনো জাত-পাত, লিঙ্গ, ধর্ম, চরিত্র ও ভূ-সীমানা খুঁজে না। তাইতো টাইগাররা সুন্দরবন, কার্ডিফ, হারারে যেখানেই বিচরণ করুক তারা গর্জন করেই।
এই যেমন মিরপুরে এশিয়া কাপের সেমিফাইনালে ক্রিকেট আধিপত্য বিস্তারকারি পাকিস্তানকে টাইগাররা এমন হুংকার দিলো পরক্ষণে দেশের মফস্বল থেকে ঢাকার রাজপথ ব্যস্ত হয়ে গেল মিছিলে মিছিলে। যে মিছিলে কোনো অবরোধ ছিল না, জ্বালাও পোড়াও স্লোগান ছিল না। যে জনস্রোত থেকে উচ্চারিত হয়েছিলো শুধু ক্রিকেট প্রেমের উপাখ্যান। দেশের মানুষ এখনো অন্তত এ একটি বিষয়ে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে যায়নি। ক্রিকেটীয় উচ্ছ্বাস যেন সব মত আর পথকে এক করে দিয়েছে। প্রাণের ক্রিকেটকে ঘিরে যে টইটুম্বর ভালোবাসা তা বিভিন্ন উৎস থেকে উৎসারিত হয়ে প্রবাহিত হয় একটি মাত্র ধারায়, ঠিক যেন ঝর্ণাধারার মত। তাই আজ ছাপ্পান্ন হজার বর্গমাইল যেন ক্রিকেট মাঠ। সত্যি, হৃদয় নিংড়ানো এ ভালোবাসা শুধু ক্রিকেট দিয়েই সম্ভব।
বোলার তাসকিন যখন ব্যাঘ্রবেগে দৌঁড়ায়, ষোল কোটি মানুষের সবগুলো পাও যেন তার সঙ্গে দৌঁড়ায়। ক্রিকেট শিশুপুত্রের বারুদ মোড়ানো বল যখান ক্রিকেট বরপুত্রদের স্ট্যাম্প উড়িয়ে দেয়, তখন চিৎকার করে উঠে পুরো জাতি। তুমুল উল্লাসে ফেটে পড়ে সব বয়সী মানুষ। ফুলঝুরি ফুটে বিশ্বমিড়িয়ায়। জাতির এই আবেগঘন মুহূর্তে নিজের ঘৃণার বিষবাষ্প ঝেড়ে ফেলে মানবীয় ভালোবাসার সবটুকু দিয়ে অভিনেত্রী হ্যাপিও ক্রিকেট প্রেমীদের সঙ্গে মিশে যান। এ দেশের ক্রিকেটই পারে সব ঘৃণাকে মায়ায় রুপ দিতে। ভক্তরা যৌনতা আর ক্রিকেটকে এক করে দেখেনি। হ্যাপি-রুবেলের প্রেমের সমীকরণে আনাড়ি রুবেল যখন দক্ষ হয়ে বল হাতে জয়ের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেন দেশকে, তখন তার বিরুদ্ধে আর মামলা পরিচালনা না করার ঘোষণা দেন হ্যাপীর আইনজীবী। টেলিভিশন চ্যানেল যখন ওই সংবাদ ব্রেকিং নিউজ করে তখন সাধারণ মানুষ ভাবে ক্রিকেটই সব সম্ভব। একবার ভাবুন তো যদি না মামলার বেড়াজালে আর রাজনৈতিক গ্যাঁড়াকলে পড়ে রুবেল গত বিশ্বকাপ খেলা থেকে বঞ্চিত হতো, তবে বিশ্ব ক্রিকেটে তখন বাংলাদেশের কোর্য়াটার ফাইনালে খেলাটাও হয়তো অনিশ্চিত হয়ে যেত।
ক্রিকেট খেলুড়ে এ জাতিকে পৃথিবীর অন্যদেশগুলো সমীহ করে। যদিও এ দেশের পরমাণু, ইউরেনিয়াম ও যুদ্ধবাজ সৈনিক নেই। আছে ১১ জনের একটি স্কোয়াড়। যারা সৈনিকদের মত যুদ্ধ করে অন্যের ভূখণ্ড ছিনিয়ে নেয় না। যারা সবুজের মাঠে লড়ে যায় ষোল কোটি মানুষের একটি স্বপ্ন পূরণের নেশায়। তাইতো তাদের জয়ে সব ভেদাভেদ ভুলে গুলশান আর গণভবন থেকে দুই নেত্রী সাধুবাদ জানাতে ভুলে যান না। তাদের জয়ে তার্কিক সাংসদরা পর্যন্ত ক্রিকেটিয় প্রেমে সিক্ত হয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, স্পিকারের মুখ থেকে ভেসে আসে শাবাশ টাইগার, শাবাশ বাংলাদেশ। অবিস্মরণীয় এই জয়ে কারো ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। অটুট থাকুক, বেঁচে থাকুক এ ভালোবাসা। যাপিত জীবনের চলমান অস্থিরতায় ক্রিকেট এক খণ্ড প্রশান্তি হয়ে ফুটুক সকল বাঙালির হৃদয়ের গহীনে।
বাংলাদেশ টিমের জয়ে দেশের গ্রাম থেকে নগর যেন এক হয়ে গেছে। সর্বত্র চলে অন্যরকম আনন্দযজ্ঞ। দল-মত আর সব পথের উর্দ্ধে উঠে তাইতো টাইগাররা তাদের এ জয় উৎসর্গ করলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়। স্বাধীনতার অগ্নিঝরা এই মার্চে পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে পরাজিত করার মাধ্যমে গোটা জাতি পুনরায় ফিরে যায় একাত্তরের উত্তাল সে দিনগুলোতে। রুদ্ধশ্বাস আর শিরায় টান ধরা টি-টুইয়েন্টির ওই ম্যাচে ম্যাশবাহিনী দেশবাসীকে অন্যরকম ভালোবাসায় সিক্ত করলো। প্রধানমন্ত্রী নিজেও তার আবেগ ধরে রাখতে পারেননি, চোখ বেয়ে গড়ালো অশ্রু। মুক্তি আর বিজয়ে সব ভালোবাসা সমান থাকুক। কোনো রাজনৈতিক বা ভয়ংকর হন্তারক যেন কেড়ে না নিতে পারে এ স্বর্গীয় বন্ধন। বাঙ্গালি তার বুকের যে উঠোন পেতে দিয়েছে ক্রিকেটের জয়োগানে। অমলিন থাকুক তা চিরদিন।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা মার্চ, ২০১৬ রাত ৯:২০