ভোরের কাগজে প্রকাশের লিংক Click This Link
আবারো শুরু হয়েছে প্রাণের বইমেলা। লেখক প্রকাশক আর বইপ্রেমীদের পদভারে মুখরিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বাংলা একাডেমিসহ গোটা শাহবাগ চত্বর। মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্যই হলো ক্ষত ভূলে গীয়ে আনন্দে মিশে যাওয়া। অথচ এই বইমেলা যা দিয়েছে তার চেয়ে কম কেড়ে নেয়নি। তাই যখন ভাষা উৎসবের মাস ফেব্রুয়ারি আসে, তখন কতোগুলো মুক্তপ্রাণ মানুষের আত্মচিৎকার হৃদয়ে বেজে উঠে। সে অনুভূতি প্রকাশের ভাষা তখন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। যে মানুষগুলো বইয়ে নিজেদের স্বাধীন মত প্রকাশ করতে গীয়ে বিরোধীদের চাপাতিঘাতে নির্মম লাশ হয়েছেন বইমেলার গালিচায়। এ মেলা প্রাঙ্গনে তাদের রক্তাক্ত শরীর পড়েছিল, কেউ ফিরেও তাকায়নি। হাত বাড়ায়নি মমতার, এক সমুদ্র রক্তক্ষরণে সোহরাওয়ার্দীর মাঠেই তাদের মৃত্যু হয়েছিল। গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারী বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎকে এখানেই চাপাতি দিয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে খুন করে অতি ইশ্বরবিশ্বাসী একদল অন্ধকারের হায়েনা। তার স্ত্রী ডা. নাফিজা আহমেদকেও কুপিয়ে নিস্তেজ করে দেয়া হয়, ভাগ্যসুপ্রসন্ন তাই পরে বেঁচে গীয়েছিলেন তিনি। আজ থেকে ১২ বছর আগে বাংলা সাহিত্যের একমাত্র প্রথাবিরোধী লেখক ড. হুমায়ুন আজাদ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে যে নিধনযজ্ঞের শুরু, তার সর্বশেষ টার্গেট হয়েছিলেন জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্ত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন। গত ৩১ অক্টোবর প্রজন্মের মুক্তাঞ্চল নামে খ্যাত শাহবাগে নিজ প্রকাশনা কার্যালয়ে উগ্রমনারা তাকে অকৃপণভাবে হত্যা করে। দীপনের অপরাধ, তিনি প্রগতিশীল মুক্তমনাদের বই ছাপতেন। যে লোকটি সমাজের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে জ্ঞান অর্জনের পর চাকরি না করে আলোর মশাল হাতে নিয়েছেন, সমাজকে আলোকিত করবেন এই প্রত্যয়ে। আর তার গড়ে তোলা প্রকাশনী সংস্থা থেকে একের পর এক বহুমত ও মাল্টিচিন্তকদের সমাজ সংস্কারের বই ছাপিয়ে চলেছেন। সেই তিনি কী না শেষ পর্য্ন্ত অন্ধকারের শক্তির নিশানা হলেন। ওইদিন শুদ্ধস্বরের প্রকাশকসহ আরও তিন লেখক-প্রকাশক অপশক্তির টার্গেট কিলিংয়ে পড়েছিলেন। তারা একসঙ্গে ছিলেন বলে বেঁচে গেছেন, কিন্তু দীপনকে রক্ষা করা যায়নি। ওই হত্যাকাণ্ডের পর সারাদেশে যে প্রতিবাদ হয়েছিল, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে তা হাওয়া হয়ে গেল। আজ আমরা এমন এক রাষ্ট্রযন্ত্রে বাস করছি, যেখানে আলোর কথা বলা সবচেয়ে বড় পাপ। আমরা এমন সমাজে লেখালেখি করছি, যেখানে চেতনাধারীরা আর ভিন্নমতালম্বীরা আজ উদ্ভট উটের পিঠে চড়ে বৈতরণী পার হচ্ছেন। উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে আত্মরক্ষার প্রাণান্তকর চেষ্টা করছেন।
আজ ক্ষমতাসীনদের অন্দর মহল থেকে স্বহাস্যে বাহাস চলছে, উন্নয়নের ফুলঝুরি ছড়ানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে প্রভূত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও দেশ মধ্যম আয়ের সারিতে পরিণত হবার কথা। কিন্তু একটি দেশের জনসাধারণের ভাত-পাতের সংকুলানই শেষ কথা নয়, প্রতিটি নাগরিকের বাক্ব্যক্তি ও মুক্তমত প্রকাশের অপার স্বাধীনতাও নিশ্চিত হওয়া চাই। দেশের ভৌত পরিবর্তনের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি তার নাগরিকদের মানসিক জীর্ণতার উন্নয়ন। তাই একুশের মেলা যেভাবে প্রাণের মেলা ঠিক একইভাবে প্রতিবাদ ও দ্রোহেরও পটভূমি। তৎকালীন বৃটিশ উপনিবেশিক শাসনের মূলোৎপাটন ও পাকিস্তানি অন্যায় শুরুতেই রুখে দিতে অদম্য শক্তি নিয়ে একুশের প্রভাত ফেরি হয়েছিল। প্রতিবাদ আর শ্লোগানে দীপ্ত পায়ে হেঁটে চলা বিষ্ফোরণের সেই স্ফুলিঙ্গ ভূলে এখানকার একুশ উদযাপন নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়েছে। আমাদের জাতিসত্তা জুড়ে এখন কেবল প্রতিষ্ঠান আর প্রাতিষ্ঠানিকতা। মূল জায়গা থেকে সরে গীয়ে এ জাতি দম্ভোক্তি আর লোকদেখানো কালচার বিনির্মাণে ব্যস্ত। আমরা ভূলেই গেছি হুমায়ুন, ফয়সল কিংবা অভিজিৎ, ওয়াশিকুরদের হন্তারকদের বিচার না করতে পারা একুশের চেতনার পরিপন্থি। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনা যাবে। কিন্তু যে চেতনা খুনীদের প্ররোচিত করেছে আলোপথের যাত্রীদের প্রাণে মেরে ফেলতে, তার সমাধান কিভাবে হবে। যে আত্মবিনাশী ভাইরাস প্রজন্মের চরিত্রে শিকড় গজিয়েছে, এখনই তার বেড়ে উঠা থামানো না গেলে ভবিষ্যতে তা প্রলয়ের আকার নিবে। যে অন্ধকার চিন্তা সমাজকে গ্রাস করে ফেলছে তা নিরসনের দায় সরকার ও তার গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই নিতে হবে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা তাতে কর্ণপাত না করে মতাদর্শগত এ লড়াইকে রাজনৈতিক লড়াই বানিয়ে ফেলছে। তবে আইন ও সংবিধান যাদের হাতে তাদেরকে এটা বুঝতে হবে যে, এ সংঘাত কোনে আঞ্চলিক সংঘাত নয়। এর একটা বিশ্বরুপ রয়েছে আর এ বদ্বীপে ঘটে যাওয়া ঘটনাক্রমের সঙ্গে তার যোগসূত্র রয়েছে। অথচ দেশের বড় দুটি রাজনৈতিক দল যারা বেশিরভাগ সময় ধরে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদার, তারা এটাকে ব্লেম গেইম হিসেব চালিয়ে দিচ্ছে। পৃথিবীতে এমন হতভাগ্য বাবা খুব কমই আছেন যিনি কী না নিজ ছেলের লাশ কাঁধে তুলেছেন। ওই লাশের ভার বহন করা কতো নিদারুণ তা না হারানোর দল কোনোদিন বুঝবেনা। অথচ দীপনের বাবা ঢাবি অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ছেলের লাশ কাঁধে নিয়ে অত্যন্ত পর্বত কঠিন ভাষায়, ছেলে হত্যার বিচারের চেয়েও সমাজের শুভবুদ্ধির উদয় চেয়েছেন। কতোটা দেশপ্রেমিক আর নি:স্বার্থ মানুষ হলে পঁচে যাওয়া রাষ্ট্রযন্ত্র তার পুত্র কেডে নেয়ার পরও ওই সমাজ ও রাষ্ট্রের এমন কল্যাণ চাইতে পারেন। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক শোক ভুলে তিনি জাতীয় চেতনাকে সজাগ করতে চেয়েছিলেন। পুত্রশোককে শক্তিতে পরিণত করে তিনি তা সমাজের আরো অভ্যন্তরে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। সচেতন মহল তখন ভাবতে শুরু করেছিল এ রাষ্ট্রের বোধোদয় হবে, সমাজে শুভবুদ্ধির জাগরণ সঞ্চারিত হবে। অন্ধকার দ্রুতই মিলিয়ে যাবে আলোর গহ্বরে। কিন্তু বাস্তবে সেটি ঘটেনি। কিন্তু এমন যদি হয়, ছেলে হত্যার বিচার চাইবেন কিভাবে একজন বাবা ।
এদেশের বিচারকরা আগে থেকে রায় ঠিক করে তবেই এজলাসে বসেন। চাপাতি ইস্যুতে তারা বিব্রতবোধ করেন। ক্ষমতাসীনদের কাছে দীপনের বাবা কী অনুযোগ করবেন, যেখানে সরকারে রয়েছে মো. হানিফের মতো কোনো এক দলবাজ। যে কী না ছেলে হত্যার দায় চাপান নিজ পিতার ঘাড়ে। আর যে রাষ্ট্রের সাংসদেরা “পাকিস্তানি ব্লাসফেমি’ আইনের আদলে ৫৭ ধারা চালু করেন। সে রাষ্ট্রের শিক্ষক বাবারা কি উপায়ে তাদের সন্তানদের বিজ্ঞান আর বিশ্বধর্মের শিক্ষা দিবেন। বাবা ছেলে হারানোর শোক ভুলবেন কিভাবে? যেখানে নিজ কর্মস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সবকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীদের একটি বিরাট অংশ চাপাতি হন্তারকদের মতাদর্শ লালন করে। এখনো যে সমস্ত বিবৃতিবাজ ও কবি, টকশোবিদ ও সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সুশীল, লেখক ও প্রকাশক- ব্লগারদের লিখতে বারণ করে প্রকারান্তে উগ্রমনাদের উৎসাহিত করছেন, সেখানে পিতা হিসেবে ফজলুল হক এবং অজয় রায়রা খুব অসহায়। রাষ্ট্রযন্ত্রের নিউক্লিয়াসবাহিনী, সমস্ত গোয়েন্দা, আইসিটি বিভাগ আর পুলিশ প্রশাসন যেখানে এসব হত্যাযজ্ঞে বড় ভাইদের আজ্ঞাবহ, সেখানে পুত্রখুনের মামলা করে এমন আর কি হবে? তাই এদেশের প্রগতিশীল সব পিতা ধরেই নিতেই পারেন, যখন ভোটবাণিজ্যের এ পটকা গণতন্ত্রের দেশে জামায়াত, হেফাজত, আইএস, ওলামা লীগ আর আনসারউল্লাহ এক কাতারে দাঁড়িয়ে যায়, তখন প্রগতিতন্ত্রের ধারক মুক্তপ্রাণগুলো এ ভূমিতে লাশ হয়ে যাবে। আজো যে দেশের পরিবার, সমাজ ও ধর্মীয় বিদ্যায়তনে ধর্মের মর্মবাণী ও সহিষ্ণুতার আলো না ছড়িয়ে, সম্প্রদায়গত জাত্যভিমান আর অন্ধকারের বিষবাণী ছড়িয়ে দেয়া হয়। সে দেশে এভাবেই পিতা হারাবে ছেলেকে, বোন হারাবে তার ভাইকে, স্ত্রী হারাবে তার প্রিয়তমকে। এখন থেকে যেসব মা-বাবা তাদের সন্তানদের শয়তানি শিক্ষা না দিয়ে প্রগতির শিক্ষা দিবেন তারা এভাবেই অকালেই হবেন সন্তাহারা । হত্যাৎসবের এমন মিছিলে তাই ভবিষ্যতে আর কোনো পিতা কিংবা নিহতের কোনো স্বজন বিচার চাইতে আসবেন না। তবে এখন থেকে বন্ধ হয়ে যাক সমস্ত বিচারালয়, ছাপাখানা আর প্রকাশনালয়। বিচার আর বিকাশ বন্ধ হলেই এ দেশটির ধ্বংশ অনিবার্য। আর এ মুহূর্তে হয়তো সেটাই হওয়া সমীচীন।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:৪৬