লেখাটি ভোরের কাগজে প্রকাশের লিংক Click This Link
সরকারের ধর্মীয় চেতনা নিয়ে বারংবার আলোচনা হলেও, বিষয়টি সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। কারণ সরকার যে হাতে শাহবাগীদের গলাটিপে ধরেছিলো, সে একই হাতে আবার হেফাজতীদরে পশ্চাৎদেশ পিটিয়ে লাল করে দিয়েছে। আওয়ামী কুশীলবরা যেভাবে মুক্তপ্রাণ ব্লগার হত্যাযজ্ঞে উচ্চকণ্ঠ হয়েছিলো, সমান্তরালি সে তারাই আবার ব্লগারদের কণ্ঠে শীকল পরাতে সম্প্রতি ৫৭ ধারা চালু করেছে। যা পাকিস্তানি কায়দায় ব্লাসফেমি আইনেরই নামান্তর। জঙ্গিদমন ইস্যুতে সরকার বিদেশে যেমন প্রশংসা কুডিয়েছে, তেমনি দেশে মুক্তমনাদের হত্যাকাণ্ডে মধ্যপন্থা অবলম্বনে বেশ সমালোচিতও হয়েছে। এভাবে সরকার একই মঞ্চে জঙ্গিতন্ত্র ও প্রগতিতন্ত্রের মঞ্চায়ন করছে। এ দুদলেরে মধ্যে ব্যালেন্স রাখার নিরন্তর চেষ্টা করছে। এ প্রসঙ্গে সরকারপন্থিদের বক্তব্য হচ্ছে, বাংলাদেশ কখনো ইরাক, সিরিয়া হবে না। অন্যদিকে বিরোধীরা মত দিচ্ছেন, দেশে কোনো কালে জঙ্গি ছিলো না, ক্ষমতায় টিকে থাকতে সরকার জঙ্গি থিউরি আবিষ্কার করলো আর এখন সেটাই বুমেরাং হচ্ছে। কিন্তু কিছুদিন আগে মিরপুরে জঙ্গি আস্তানা থেকে জনসমাগমে বোমা হামলা, পিডিবির সাবেক পরিচালক পীর খিজিরকে খুন, রাজধানীর বুকে একের পর এক ব্লগার হত্যা, রংপুরে জাপানি নাগরিক খুন সহ সর্বশেষ রাজশাহীর বাঘমারায় আহমদিয়া মসজিদে জঙ্গিপনার ঘটনা কীসের ইঙ্গিত দেয়? এসব হত্যাকাণ্ডের চরিত্র, আদর্শ, উদ্দেশ্য একই সূত্রে আবৃত। পৃথিবীর নানা দেশে ধর্মান্ধরা যেভাবে বিদেশি সাংবাদিক, কূটনীতিক ও এনজিও কর্মীদের খুন করে, বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া হত্যাকণ্ডগুলোও তার ব্যতিক্রম নয়। দৃশ্যকল্প বিশ্লেষণে মনে হচ্ছে, এরমধ্য দিয়ে বাংলাদেশ দ্রতই ইসরাইল-আমেরিকা সৃষ্ট বিশ্ব জঙ্গিজালে আটকা পড়তে যাচ্ছে। যা হবে এ বদ্বীপের জন্য মারাক্তক এক পরিস্থিতি এবং এ থেকে নিজেদেরকে বের করে আনাও হবে জাতির জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে যেন এমন পরিস্থিতির মধ্যে না পড়তে হয় তৎজন্নে আগাম কিছু অনুসিদ্ধান্ত ও করণীয় ঠিক করতে হবে। আর এ জন্য ক্ষমতাশীল সরকারকেই প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে।
আওয়ামী সরকারকে যেকোনো একটি পক্ষ বেছে নিতে হবে। হয় মৌলতন্ত্র না হয় বিজ্ঞানতন্ত্র, কিন্তু কৌশলে সরকার যদি এ দুটি পথের মেরুকরণের চেষ্টা করে তা হবে আরো ভয়াবহ। এমন পরিস্থিতিতে সরল দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, দেশের সংবিধানে একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে প্রাধান্য দেয়া কোনোভাবেই সমীচীন হচ্ছে না। ভোটব্যবসার জন্যে আদর্শ বিসর্জন দেয়া যাবে না। সরকার যে ইশতেহার ঘোষণা করে ক্ষমতায় এসেছে তার বাস্তবায়ন চায় আম জনগণ। বুদ্ধিজীবী বিবৃতিবাজরা সবসময় ষড়যন্ত্রের জাল বুনবে, কিন্তু তাতে সরকার তার করণীয় ভুলে গেলে চলবে না। সরকারের নীতি নির্ধারকদের স্মরণ রাখতে হবে, শিকড় থেকে সরে জনপ্রিয়তার বৃক্ষ যতোই মহীরুহ আকার ধারণ করুক না কেন, তার স্থায়িত্ব নিয়ে কিন্তু সন্দেহ থেকেই যায়। দেশে আগেও বাংলা ভাই ছিলো, এখনো লন্ডন থেকে ইংরেজ ভাইরা আসে। অথচ পরিকল্পিত খুনের ঘটনায় দিনের পর দিন চলে ‘ব্লেইম গেম’। আর এ সুযোগে আসল হন্তারকরা পার পেয়ে যায়। বিশ্বমিডিয়ায় যখন এসব খবর প্রকাশ পায়, তখনই বাংলাদেশের গার্মেন্ট ও নির্মাণ শিল্পে ধস নামে। বিদেশি ক্রিকেট ও ফুটবল টিম বাংলাদেশে তাদের শিডিউল খেলা বাতিল করে দেয়। আর সরকার ওইসব ব্যর্থতা সামাল দিতে সবসময় চরম ভেল্কিবাজির পরিচয় দিয়ে আসছে। সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগ থেকে বলা হয়, দেশে কোনো আইএস, জঙ্গি নেই। পর পর এতগুলো হত্যাকাণ্ড ও জঙ্গিপনা প্রকাশ্যে আসার পরও যদি সরকার এমন মন্তব্য করে তা চরম হতাশাজনক। এ মিথ্যাচার মানা যায় না। ক্ষমতাসীনদের বলা উচিত , দেশে মৌলবাদ ও ধর্মীয় উগ্রগোষ্ঠী রয়েছে এবং তারা এ ব্যাপারে বেশ তৎপর রয়েছেন।
কিন্তু তা যখন হয় নাই, আমারা ধরে নিবো, যারা বাংলাদেশে জঙ্গি নাই বলে বগল বাজাচ্ছেন, তারা প্রকারান্তে জঙ্গিতন্ত্রকেই আসকারা দিচ্ছেন । তবে সমস্যা হচ্ছে, উগ্র ধর্মান্ধরা আদর্শ প্রতিষ্ঠার ঢাল হিসেবে সবসময় ধর্মকে ব্যবহার করছে। আর সেজন্যে বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর। কারণ সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ থেকে ধর্মকে আলাদা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বমোডলরাও এ প্রশ্নে বহুধা বিভক্ত। নিকট অতীতে আমেরিকা যখন তালেবানের নাম ভাঙ্গিয়ে আফগাস্তিান থেকে রাশিয়াকে বের করে দিয়েছিলো। আর এখন সেই রাশিয়াই আবার আইএস নামক ভূতের বিতাড়নে সিরিয়া থেকে আমেরিকাকে হটিয়ে দিচ্ছে। তাই আওয়ামী লীগ সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে জঙ্গিবাদ দমন যেন কোনো ধর্ম, মতবাদ কিংবা আদর্শ দমন যেন না হয়। কারণ হেফাজত, জামায়াত, আনসার উল্লা ও আইএসের মতো উগ্র সম্প্রদায়গুলো তাদের আক্রমণের ঢাল হিসেবে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করেছে। সরকারকে ভালো, সত্য আর সুন্দরের পক্ষ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, দুই নৌকায় পা রাখলে তীরে পৌঁছানো যাবে না। আর সাধারণ মানুষকে মনে রাখতে হবে ধর্মীয় চেতনা বা মুসলমানিত্ব সস্তা কোনো বিষয় নয়। মতবাদ, আদর্শ বা ধর্ম বিশ্বাস মানুষের হৃদয়ের অনেক গভীরে প্রোথিত। কেউ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কিছু লিখলো আর তাতে সবার ধর্ম চলে গেল? এ বদ্বমূল ধারণাই সব বিতর্কের জন্ম দেয়। এও মনে রাখা জরুরি যারা এসব হত্যাযজ্ঞ করে, সংখ্যায় গুটিকয়েক ও সেসসব মানুষ কোনোদিনও পুরো একটি ধর্মের ত্রাণকর্তা নন। আর সরকারকেও জঙ্গি ইস্যুতে জিরো টলারেন্স দেখাতে হবে। জঙ্গিপনা রোধে সরকারের আইন, প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে সমন্বয় করে আরো কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:২২