আজ বছরের প্রথম-দিন একটা কনফেস করতে চাই। মোটামুটি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মালেও জীবনের চলার পথ অতটা স্মুথ ছিল না। ষ্টুডেন্ট লাইফ শেষ করার দিন পর্যন্ত কখনো পড়ালেখার জরুরত মিটাতে কোন অভাবে পরতে হয় নি৷ হয়তো বুঝাতে বা কনভিন্স করতে হয়েছে, সময় লেগেছে। তবে পেতে সমস্যা হয় নি।
আমাদের ৯৪ ব্যচ ছিল 500 প্রশ্নের MCQ যুগ। সেই সময় MCQ বদৌলতে ফার্স্ট ডিভিশান পাওয়াই কঠিন ছিল। সবচে বাজে ষ্টুডেন্টও কমপক্ষে ১ সাবজেক্টে লেটার মার্ক পেতো। মানে ৮০ পেতো। ষ্টার নাম্বার অর্থাৎ সর্বমোট ৭৫০ নাম্বার ছিল ডালভাত।
আমাদের সারা স্কুলে একমাত্র আমিই হলাম সেই ছাত্র যে ষ্টার পাই-নি, কোন লেটারও পাই-নি। সিম্পল ফার্স্ট ডিভিশান- তখন আমাদের কাছে ছিল ফেল করার নামান্তর। কোনমতে ফার্স্ট ডিভিশান পেয়ে আমি আদতে ফেল-ই করলাম। আত্মীয় স্বজন চেনাপরিচয় মহলে ঘৃণ্য ছি ছি পরে গেলো। বাপ-মা মুখ দেখাতে পারে না অবস্থা। ঘরে বাইরে সব জাগায় আমি পর্যুদস্ত। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে দুপুরের ভাত খেতেও কেউ ডাকে-না। কোন হাত খরচ পাই না। রিকশাভাড়াও না। ক্লাসে যায় পায়ে হেঁটে।
ছোট একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বাড়ি থেকে ক্লাস ছাড়া বের হই না। কারন বের হলেও রেজাল্টের খোঁচা শুনতে হয়। বিরক্ত হয়ে এক পয়লা বৈশাখ বের হলাম। বন্ধুদের সাথে রমনা পার্ক। রমনা হতে জগন্নাথ..। সমস্যা হল জগন্নাথ এসে সবাইরে হারিয়ে ফেললাম। হারিয়ে ফেললে সমস্যা না। ঢাকা শহরের অলিগলি অনেকটা হাতের রেখার মত চেনা আমার। সমস্যা হল পকেটে কোন টাকা নেই। নেই মানে নেই-ই। সকালে বের হয়েছিলাম বন্ধুদের সাথে ফিরবো ওদের সাথে- এই হল প্লান। অতএব বাড়িতে টাকা চেয়ে অপদস্থ হবার দরকার কি?
সেদিন জগন্নাথ থেকে শ্যামলী ফিরলাম পায়ে হেঁটে ।
রেজাল্টের পর যেটা হল বাড়িতে ফোন এলে ধরার দায়িত্ব আমার ওপর বর্তাল। যেহেতু সবাই রেজাল্ট জানতে ফোন দেয়; তাই আমারেই ফেস করতে হবে। আমি তো আর ষ্টান্ড করি নি যে পত্রিকায় বাপ-মার সাথে ছবি দিয়ে তাদের মুখ উজ্জ্বল হবে। যা শালা নিজের রেজাল্ট নিজেই জানা। সমস্যা হল বাড়িতে যখন ফোন বাজতো; আমার প্যালপিটিশান শুরু হয়ে যেতো৷ মাঝরাতে স্বপ্নেও ফোনের রিং শুনে আঁতকে উঠতাম৷ ফোনের ভয়ে শীতের রাতে ঘেমে চুপচুপা হয়ে যেতাম।
মার্কসিট এল কদিন পর। দেখলাম ভয়াবহ নাম্বার। জেনারেল ম্যথে মাত্র একটা পাটীগণিত ভুল হলেই ফেল করতাম। গণিত প্রতি নাম্বার ছিল ৮। আর আমি পেয়েছি ৩৬!! পাশ নাম্বার থেকে ৩ নাম্বার দূরে।
ম্যট্রিকের পর দুটো বছর কেটে গেলো একলা নির্জনে৷ ঘরে থেকেও কোথাও নেই আমি। আশেপাশে এত মানুষ; অথচ কথা বলার কেউ কোথাও নেই আমার। অনেক টা যেন বোবা প্রাণী বিশেষ। রাগে ক্ষোভে নিজের ভেতর জ্বলতাম। মাঝেমধ্যে ভাবতাম বুড়িগঙ্গা গিয়ে লাফ দেব কি না। দুদিন টার্গেট স্থির করে ঘুরেও এসেছি বুড়িগঙ্গা ব্রিজ।
ধীরে ধীরে ইন্টারমিডিয়েট এক্সাম এগিয়ে এলো। প্রিটেস্ট টেষ্ট দিলাম। কেউ কোন আগ্রহ দেখায় না। একদিক থেকে ভালোই হল। কোন পরীক্ষার রেজাল্ট কাউরে আর দেখাতে হয় না৷ এক্সাম ফি জমা দিলাম। আমার আগে সবাই আগাম বুঝে গেলো এবার নির্ঘাত ফেল করতে যাচ্ছি আমি। আমারে জিজ্ঞাস করা হল, পরীক্ষা এ বছর দেব নাকি আরেকটু ভালোমতো পড়ে আগামী বছর দেবো! ফেল করার চাইতে এক বছর পর পরীক্ষা দিয়ে থার্ড ডিভিশান পাওয়া ভালো। তাছাড়া ফ্যমিলির ইজ্জত বলেও তো কিছু আছে!
আমি কোন উত্তর করি না। পরীক্ষা দেব কি দেব না তাও বলি না। দু বছরে তিলে তিলে গড়া আত্মবিশ্বাস শূন্যে নেমে আসে। কথা বলার মত শক্তি হারিয়ে ফেলি আমি।
সবার শেষ পরীক্ষা ফোর্থ সাবজেক্ট। থিওরি শেষ করে প্রাক্টিকালে এ্যটেন করলাম না। জাষ্ট সাইন দিয়ে চলে গেলাম সিনেমা হলে। এক টিকিটে দুই ছবি। ইংরাজি ছবি। সিনেমা হলের নাম অভিসার।।
পেপারে লিখেছে কাল রেজাল্ট। বাড়িতে সবার মুখ থমথমে। কোথাও কোন শব্দ নেই। আমার আবার টেনশান হলে প্রচন্ড ঘুম আসে। মাগরিবের পরপরই কিভাবে যেন ঘুমিয়ে গেলাম..
দুপুর ১২ টার দিকে রেজাল্ট। বরগুনার মিন্নির মত মুরগীর মাংস দিয়ে ভাত খেলাম পেটপুরে। সিদ্ধান্ত ফাইনাল; রেজাল্ট দেখতে যাব না। ডাইরেক্ট বুড়িগঙ্গা যাব। তবে জীবনের মায়া বড় মায়া। জীবন সাঙ্গ করা ছেলেখেলা নয়। শেষমেষ গেলাম রেজাল্ট দেখতে। গিয়ে দেখি সবার মুখ কালো। মাত্র ১৮% নাকি পাশ করেছে। সেরা ছাত্ররাও অনেকে সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে। গড় রেজাল্ট তৃতীয় বিভাগের দিকে ভারি। তবে পেছনের আবহাওয়া এবার ভিন্ন। শিক্ষক থেকে অভিভাবক সবার মন খারাপ। একে অন্যকে শান্তনা দিচ্ছে। এটা কোন ব্যাপার না। সবার রেজাল্টই খারাপ হয়েছে। এককোনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি রেজাল্ট বোর্ডের ভিড় কমার জন্য। ফলাফল ধসের পরিস্থিতিতে কেউ আর সাহস করে আমার রেজাল্ট জিজ্ঞাস করছে না। আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলছি, নিজেরে সাহস দিচ্ছি এবার বুড়িগঙ্গায় ঝাঁপ দেবার পালা….
বাসায় ইতিমধ্যে জানা হয়ে গিয়েছে ফলাফল বিপর্যয় সংবাদ। টিভিতে লাইভ কাভারেজ দিচ্ছে মাতম পরিস্থিতি। ভিকারুননিসা, ঢাকা কলেজ, নটরডেমে কান্নাকাটি চলছে। বাড়ি ঢুকে কারো সাথে কোন কথা বললাম না। রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। মা'য়ের কান্নার আওয়াজ শুনা যাচ্ছে। সেই কান্নায় আমার কোন ভাবান্তর হল না। ওয়াকম্যনের সাথে বক্সের লাইন ইন করা আছে। গান চালিয়ে দিলাম জোর-সে। মন খারাপের দিনে গান শুনা উত্তম।
সম্ভবত মাস খানিক হয়েছে। মার্কসিট পৌঁছে গিয়েছে।
এবার সত্যিই আমার কান্না চলে এলো। একেবারে বুকের ভেতর থেকে অশ্রু বের হয়ে আসতে চাইছে। নিজেরে সামাল দিতে পারছি না। ম্যাট্রিকে জেনারেল ম্যথে ৮ নাম্বারের একটা জেনারেল ম্যথের জন্য ফেল করা থেকে বেঁচে গিয়ে ছিলাম। এবার সেই মাত্র ৮ নাম্বার কম পাবার জন্য প্রথম বিশ জনের একজন হতে পারলাম না। মার্কাসিট দেখার পর আমার এ্যকাউন্টিং স্যার সোজা আমারে থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন।
ফোর্থ সাবজেক্টের প্রাক্টিকাল এক্সামটা এ্যটেন করলে কি এমন ক্ষতি হত রে বনল?
এবার আমি সত্যিই কেঁদে ফেললাম। স্যাররে জড়িয়ে ধরে কাঁদলাম। মনে হল ১৭ বছরের কৈশোর পেরুনো তরুণ যেন মূহুর্তে শৈশবে ফিরে গেলো। নাহ ৮ টা নাম্বার কমের জন্য বা প্রাক্টিকাল না দেবার কারনে অন্তত ২৫ নাম্বার কম পাবার জন্য কাঁদি নি। কেঁদে ছিলাম প্রচন্ড ঘৃণার পাত্র হয়ে দুটি বছর পার করার লজ্জায়। আদতে এই লজ্জা কি আমার ছিল? লজ্জিত তো হবার কথা এডুকেশন সিষ্টেমের।
সেই যে ৯৪ থেকে ফোন বাজার আতঙ্ক আমারে কুক্ষিগত করল; সেই আতঙ্ক কিন্তু রয়েই গেলো। সত্যি কথা বলতে রিং বাজার আতঙ্ক ফুলে ফেপে আরো মহীরুহ বৃক্ষে পরিণত হল। আজও ফোন বাজলেই হার্টবিট মিস করি। ব্লাড প্রেসার ওপরে উঠে যাই। নতুন মানুষের সাথে ঠিকমতো কমিউনিকেট করতে পারি না, অস্বস্তি লাগে খুব, অকারণে প্যালপিটিশান হতে থাকে। ঘামতে থাকি। বলার মত কোন কথা খুঁজে পাই না। এই শতাব্দীর ডিজিটাল যুগে এসেও ইনবক্স, চ্যাটে বা কথা বলতে গিয়ে আমি গুটি-শুটি মেরে বসে থাকি। নিজেকে নিজে ভাঙতে পারি না। ভেঙেচুরে খোলনলচে পাল্টে নিজেকে গড়তে পারি না।।
তাই লিখি। লিখতে চেষ্টা করি। জানি লেখালেখির কিছুই হয় না আমার। তবুও লিখতে ভালো লাগে। নিজেরে ভাঙ্গা গড়া বা সমাজরে ভাঙ্গা গড়ার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ব্যর্থ প্রচেষ্টা লেখালেখির মাধ্যমে করি।
আমার লেখায় না হোক কাজের কাজ কিছু। না হোক লেখাজোকার কিছু। না হোক সাহিত্য বা ইতিহাসের মাইন ফিল্ডে হাটাহাটির কচুটা। তবুও লিখতে ভালবাসি। নিজের জন্য নিজের খুশীতে লিখি। না লিখে বাঁচি কি ভাবে? আমারো তো অনেক কথা আছে, বুকের ভেতর তোলপার আছে, গুমড়ে মরা ক্রোধ আছে। আত্মার সাথে শরীরের কথোপকথনে আমার সম্বল এই ছাইপাঁশ লেখালিখি।
আসলে এত কিছু কেন লিখলাম! আমি কেন লেখালিখি করি ? তার একটা কৈফিয়ৎ লিখতে ইচ্ছা হল।
আমি যা লিখি এগুলোরে সিরিয়াসলি নেবার কিছু নেই। আমার কমতি খামতিরে ভালবেসে আমি আমারে ভালবাসি, এভাবেই বেঁচে থাকি আমি। লেখার চেষ্টা করা হচ্ছে আমার ব্যথা'র অভিলাষ।
বিদায়! বিদায়!! এ অভাগা আজ নোয়ায় শির!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জানুয়ারি, ২০২১ দুপুর ১:২৭