-১
নিশুতি রাত্রী, আমি আর তুমি বাড়ি ফিরছি। শুন-শান হাইওয়ে জুড়ে ভাপসা গরম। সূর্য ডুবে গিয়েও পারেনি উত্তাপের লাগাম টানতে। রাস্তা'র দু ধারে উঁচু উঁচু মাটির জমাট, লাল মাটি। খারা পাহারের ঢালের মত পথের দু ধারে দাঁড়িয়ে বিভৎস সেই সব দানবীয় লাল মাটি। মাটির ফাঁকেফাঁকে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে পাতা হীন বৃক্ষ’র শিকড় বাকর।
-২
আমি দেখছি তুমি হাটছো। এ ঘর থেকে ও ঘর। মাঝে মাঝে মৃদু হাসছ তুমি। তোমার ফোন বাজে, তুমি হাসি মুখে কথা বল। তুমি নিজেও মাঝেমাঝে ফোন তুলে নাও কানে। এর ওর খোঁজ কর তুমি। পর সমাচার আমি ভালো আছি বলে ওঠো তুমি। আমি বুঝতে পারি তুমি মিথ্যা বল। তুমি ভালো নেই। আমি ছাড়া কিভাবে ভালো থাকতে পরো তুমি?
তোমার হাসি দেখে প্রতি উত্তরেআমি-ও হাসি। তুমি সেই প্রতি উত্তরের হাসিতে অভিব্যক্তি হীন নীরব থাকো। নীরব থাকার-ই তো কথা। একটা বছর আগেই তো হারিয়ে গিয়েছি আমি। তোমারে দু নয়ন ভরে দেখিবার সাধ কড়াই গন্ডাই মিটিয়ে নিই আমি। বেঁচে থেকেও তুমি হয়ে থাকো অতৃপ্ত শরীরের কাঠামো।
-৩
বল তো? তোমার মনে পরে সেই রাতের কথা, সেই লম্বা এয়ার ওয়েভ কারের স্বচ্ছ ছাদ দিয়ে ঢুকে পরা জোছনার আলোর কথা?
ড্রাইভিং সিটে বসে আমার দু পা শক্ত হয়ে আসছিল, যেন দু পায়ের সংযোগ শিরা উপশিরা গুলো একেক-টা শক্ত-পোক্ত লোহা। তুমি বললে শুনো আজ তোমারে কিছু বলতে চাই আমি। ক'মাস ধরে বলতে চাচ্ছি কিন্তু বলা হয়ে উঠছে না।
তখনি একটা বাদামী বাদুর উড়ে এসে ধাক্কা খাই উইন্ড শিল্ডে। আমি ব্রেক করি। তুমি বললে চালাও, চালাতে থাকো।
দেখো আমাদের ভেতর আর কিছু বাকি নেই, তুমি বুঝো নিশ্চয়! সেই কবে থেকে দেখি তোমার পকেটে, তোমার ড্রয়ারে একটা গোলাপি খাম ঘুরাঘুরি করে।
যেখানে যাও যক্ষ’র ধনের মত তোমার সাথে লেপ়্টে থাকে সেই খাম। মানুষের চেয়ে খামের মূল্য যার কাছে বেশী তার সাথে সংসার হয় না ডিয়ার।
-৪
আমি চেয়ে দেখি উইন্ড শিল্ড বাদুর টা আঁটকে গিয়েছে। আমি তোমারে উপেক্ষা করে বাদুরের গল্প বলা শুরু করি। তুমি তো ডাক্তার; আল্ট্রাসাউন্ড কিভাবে কাজ করে আমার চেয়ে ভালো জানো। এই যে গ্লাসে আঁটকে যাওয়া বাদুর- এ কিন্তু বিশেষ জাত, আমার মতই হারামি। আল্ট্রাসাউন্ড কাজে লাগিয়ে এরা শিকারের পজিসন খুঁজে ফেলে। আমার কথা শুনে তুমি বললে ডিভোর্স আলোচনা'য় সময় বাদুরের গল্প বলা লোকের সাথে সংসার করা যায় না। কোথায় তোমার গোপন খামের ব্যাখ্যা দিবা তা না করে তুমি জুলজি ওয়াইল্ড লাইফ কপচাচ্ছ।
তোমার কথা শুনে আমি সমন্বিত ফিরে পাই। স্যুটের পকেট থেকে গোলাপি খামটা বের করে বললাম, খামের ভেতর থাকা চিরকূট-টা গুরুত্বপূর্ণ। যেদিন আমরা আলাদা হয়ে যাবো সেদিন তুমি খামটা খুলবে, পড়বে, যা ইচ্ছা করবে। তোমার সেপারেসনের খায়েশ পূরণ হবে আই সয়ার।
তুমি আলহামদুলিল্লাহ বলে খাম নিয়ে তোমার ভ্যানিটিব্যাগে রাখলে। আমি আবার আমার ঘোর লাগা ভাবের দুনিয়ায় হারিয়ে গেলাম। বলতে শুরু করলাম তোমারে...
শিকারের গায়ে এসে এরা সাথে সাথে কামড়ে দেয় না। জটিল হিট সেন্সর আছে এদের। সেই সেন্সর দিয়ে চামড়ার নিচে গরম রক্ত স্কেন করে। তারপর তীব্র সুচালো কিছু ঢুকিয়ে দেয় ভেতরে। মানুষ তো মানুষ, গন্ডারের চামরাও কিছু না এদের কাছে। এতটা তীব্র ধার এদের যে শিকার হওয়া জন্তু টেরও পাবে না তার রক্ত পান চলছে। নির্বিঘ্নে রক্ত খেতে এরা Anti coaguIate ছেড়ে দেবে লালার সাথে। রক্ত মজাট বাধবে না। যখন টের পাবা তখন দেখবা রক্ত শূন্য এক প্রাণ তুমি।
-৫
এসব শুনে তুমি সত্যিই খুব রেগে গেলে এবার। ভাবলে তোমারেই বুঝি ভ্যাম্পায়ার বাদুর বলে ইঙ্গিত করেছি আমি। আমারে গাড়ি থামাতে বললে আদেশের সুরে। আমি তোমার কথা পাত্তা দিলাম না, স্পিড মিটার ১৪০ এ টেনে তুললাম। তুমি চিল্লাতে শুরু করলে ভয়ে যেন বদ্ধ পাগলের পাল্লায় পরেছ! আমি বললাম শুনো ঐ বাদুর গুলো রক্ত চুষে খায় না কি চেটে খাই তা বিজ্ঞান নিশ্চিত নয়, চল এ বিষয়ে হোক আমাদের শেষ আন্তরিক আলাপ। তুমি বিষ্ফোরিত চোখে তাকালে আমার দিকে। তোমার চোখ থেকে রক্ত যেন মাথায় উঠে গিয়েছে। ড্যাসবোর্ড বক্সে থাকা রেঞ্জার হাতে নিয়ে তুমি দুপ করে বসিয়ে দিলে আমার মাথা বরাবর।
-৬
ষ্টিয়ারিং এ মুখ থুবড়ে পরে আছি আমি। মাথা থেকে রক্ত গড়িয়ে গড়িয়ে আমার ঠোঁটের ভেতর চলে যাচ্ছে। তুমি দেখি কাঁদছ অঝোরে। আর ষ্টেথিস্কোপ দিয়ে আমার বুকে পিঠে চাপ দিচ্ছ। ষ্টেথিস্কোপের মেটালে আমার প্রচন্ড শীত করতে শুরু হয়েছে। তুমি কাঁদছ। কাঁদতে কাঁদতে তুমি বলছো তোমারে রেখে আমি কোথাও যাব না, জাষ্ট রেসপন্স কর, একটা বার রেসপন্স কর..যত ইচ্ছা বাদুর, ভ্যাম্পায়ের গল্প শুনিও আমি কিচ্ছু বলব না, যত ইচ্ছা চিরকুট নিয়ে বসে থাকো আমি একটুও রাগ করব না..জাষ্ট একটা বার তাকাও..
-৭
তোমার ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে আমার এখন অবাধ যাতায়াত। তোমার রিডিং টেবিল, বিছানো মাদুরে গিয়ে বসি মাঝে মধ্যে। বিকালবেলা যখন কফির কাপ হাতে বাড়ান্দায় গিয়ে বসো, আমি বসি পাশের চেয়ারে। আমার খুব ভাল্লাগে যখন দেখি আমার জন্য পেতে রাখা চেয়ারে কাউরে স্থান দাও নি তুমি। আমি বসি, হাঁটি, দু একবার তোমার পাশে গিয়ে শুয়েছিও।
শুধু তুমি দেখো না। মাঝেমাঝে ছায়া শরীরের আভা টের পাও তুমি। তখন গা ছমছম করে ওঠে একটু; এর বেশি কিছু না। আমি যখনি আসি তখনি দেখি একটা গোলাপি খাম থেকে চিরকুট বের করে পড়ছ। চিরকূটে বড় বড় হরফে লেখা 'যেদিন ভালবাসবে না, সেদিন আমি আর রব না'.. তুমি চিরকুট পড়তে শুরু করলেই একটা অদ্ভুত সুর ভেসে বেড়াই সারা ঘর-ময়। গানের সুরে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তোমার চোখের জল জ্যোতি...
আমার গানের মালা, আমি করব কারে দান?
মালার ফুলে জড়িয়ে আছে করুণ অভিমান।
মালা করব কারে দান?
চোখে মলিন কাজল রেখা, কন্ঠে কাঁদে কুহু কেকা
কপোলে যার অশ্রু রেখা, একা যাহার প্রাণ
শাঁখায় ছিল কাঁটার বেদন, মালায় শুচি'র জ্বালা।
কন্ঠে দিতে সাহস না পাই, অভিশাপের মালা।
বিরহ যার প্রেমারতি, আঁধার লোকের অরুণ ধুতি।
নাম না জানা সেই তপতী, তার তরে এই গান..
আমার গানের মালা আমি করব কারে দান?
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:২১