কালো করে জমাট মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে। ঝড়ো বাতাসে উপড়ে গিয়েছে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। দ্রুতগামী বাসের চাকাতে পিষ্ট হচ্ছে লাল রঙা ফুল। লোকাল বাসের হ্যান্ডেল ধরে ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে আমি তবুও ঘামছি অবিরত। ৬.৪৫ বাজে এখন অথচ চামেলিকে বলেছি সারে পাঁচটাতে লালমাটিয়া আড়ং এর গেটে হাজির থাকবো আমি। অন্য কোন মেয়ে হলে অসুবিধে ছিল না, ঝড়-ঝঞ্ঝা আর বাবা-মা'র বাঁধা ডিঙ্গতে বয়েই যায় আজকের অধিকাংশ পলিগ্যামি ডিজিটাল জুস পান করা তরুন তরুনীর।
চামেলি আগেই হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছে আজ এক মিনিট দেরি করলেও তার সাক্ষাৎ পাবো না আর এই জনমে। চামেলি অবশ্য সব সময় এমন করেই বলে। আমার মত বাউণ্ডুলে কে এহেন হুঁশিয়ারি দেওয়া ছাড়া উপায়-ই বা কি আছে হাতে। বারংবার সময়ের বরখেলাপের পরেও জানি চামেলি চলে আসবে, ঠিক সময় মতই চলে আসবে। আমি দেরি করব জেনেও চামেলি চলে আসবে নির্ধারিত সময়ের ১৫ মিনিট আগে। চামেলি এমনই, যত গর্জে তত বর্ষে না।
ঘামে জলে ভিজে আমি পৌঁছুলাম যখন ঘড়িতে তখন ৭.১২ বাজে। ঘড়ির কাটা অবশ্য ১০ মিনিট এগিয়ে দেয়া আছে। কাটা এগিয়ে দেবার মহান দায়িত্বটা পালন করেছে সেই ব্যক্তি যে হাত ঘড়িটা আমাকে কিনে দিয়েছিল ১১৫০ টাকা খরচ করে। ইন্টার্ণশীপে থাকা সদ্য ডাক্তারের প্রথম বেতন দুর্মূল্য হয়। বন্ধু বান্ধব, বাবা-মা, ভাই-বোন সবারই কিছুনা কিছু হিস্যা থাকে বাড়ির বড় মেয়ের প্রথম বেতনে। এই হিস্যা ঠিক প্রয়োজনের হিস্যা তা নয় বরং অধিকার আর ভালোবাসার স্মৃতি তে জড়িয়ে রাখার হিস্যা। মেয়ে একদিন চলে যাবে নিজের বাড়িতে; রয়ে যাবে স্মৃতি আর প্রথম বেতনে কেনা ভালবাসা।
প্রথম বেতনের টাকা দিয়ে আমাকে ঘড়ি কিনে দেবার কাহিনী টা অবশ্য একেবারে মিথ্যে বলেছিল চামেলি। বুঝতে পারলেও মুখে বলে আর বেচারি কে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়াতে চাইনি। ১২০০০ টাকা'র প্রথম বেতনে বাসাবাড়ির সবার জন্য কিছু না কিছু কিনে মেয়েরা প্রথম হাজিরা দেয় গাউসিয়া মার্কেটে। চোখে মুখে থাকে তখন বিজয়ের ঝিলিক। ঢাকা শহরে একজন মেয়ের জীবনের সব খরচের এক তৃতীয়াংশ গিলে খেয়ে নেয় এই গাউসিয়া - চাঁদনী চক। তাই চামেলি'র ঐ মিথ্যা ক্ষতিকর মিথ্যা ছিল না। ছিল একজনকে খুশি দেখতে বলা এক ঝলমলে মিথ্যে কথা। ঝলমলে মিথ্যা কথা মোটেও ছহি মিথ্যা নয়।
বন্ধুরা বলে আমি নাকি একই সাথে বোকা আর ক্ষেপাটে। ম্যাচ মিক্সিং কোন এজেন্সি কোন দিনই আমার জন্য চামেলিকে খুঁজে দেবে না। বাহ্যিক ভাবে চামেলি অতি গম্ভীর, রাশভারী আর ফর্মাল। আমার মত উড়নচণ্ডী ক্যাজুয়াল লোকের সাথে ভারী ফ্রেম অপটিক্সের চামেলি'র চুটিয়ে প্রেম কেউ ঘুনাক্ষরেও ভাববে না।
অথচ চামেলি আর আমি বহু দিনের সংগী মুখাপেক্ষী। আমার অগোছালো প্রতিদিনে চামেলি সকাল বেলা টেবিল ঘড়ির এলার্মের মত ভয়াবহ অত্যাচারের নাম। মধ্য রাতে যখন আমার দিনের শুরু হয় চামেলি তখন বুঝে যায় এখন তার ঘুমুতে যাবার সময়। এভাবেই কেটে যাওয়া প্রতিদিনের জীবনে আমি আর চামেলি সমার্থক হয়ে উঠতে পারি না তবুও সম্পূরক হয়ে ঠিকই কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে যায় কোন গভীর অরণ্যে।
মানিক মিয়া এ্যভিনিউ পার হয়ে ফায়ার ব্রিগেডের সামনে এসে দাঁড়াই আমার মুড়ির টিন বাস। কাঁধের সাইড ব্যাগ সামলে লাফ দিয়ে নেমে পড়ি গতির স্বপক্ষে। নেমে দেখি চামেলি এখানে এগিয়ে এসেই দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য। নিজের দেরীর জন্য এবার লজ্জিত হই আমি। সাহস করে আর সাইড ব্যাগ থেকে লাল কৃষ্ণচুড়ার থোকাটা বের করা হয়ে ওঠে না আমার........অথচ এক গোছা রাঙা কৃষ্ণচূড়া চামেলি'র মন ভালো করে দেবার জন্য যথেষ্ট।
'মামা ৬ নাম্বার রোড যাবেন' - আমাকে অবজ্ঞা করে রিকশা ঠিক করে ফেলে চামেলি। কিছুই হয়নি ভাব করে আমিও লাফ দিয়ে উঠে পরি চামেলি'র রিকশা তে। গম্ভীর মুখে আমার চোখে চোখ রাখতে চেষ্টা করে চামেলি। বলে 'শুনো তোমার মত লোকাল ট্রেন দিয়ে আমার চলবে না, কি ভাব নিজেকে! প্লে বয়? যতটা ভাব ততটা পারদর্শী তুমি না। মেয়ে বলে বলছি না, কখনোই সময় রক্ষা করতে না পারা স্বাভাবিক মানুষের কাজ না।'
চ্যাম তুমি আমার বুকের দিকে তাকিয়ে কথা বলছ কেন, চোখের দিকে তাকাতে পারো না? আমি তো কোন ঊর্বসী ললনা না, তুমিও লেসবো না..." বলেই প্রমোদ গুনতে থাকি আমি।
চামেলিকে আমি 'চ্যাম' বলেই ডাকি।
চ্যাম সব সময় চেষ্টা করে কঠিন কথা গুলো আমার চোখে চোখ রেখে বলতে। কিন্তু বলার সময় লজ্জাবতী'র মত লজ্জাবনত হয়ে পরে সে। তখনি চোখের বদলে তার চোখ গিয়ে পরে বুক বরাবর। এতেই বুঝে যায় এবারের মত মোমবাতি গলে যাচ্ছে। সিরিয়াস ভংগিমা ধরার প্রচেষ্টা হতে খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠি আমি, তখনি ফিক করে হেসে আমার সাদা জামাতে মাথা রাখে ফিঙে রঙা শাড়ি লেপ্টানো বিগলিত চামেলি। আমার বুকের সাথে সংঘর্ষে ভেঙে পরে তার হাতের কয়েকটা হলদে নীল কাঁচের চুড়ি। ভাঙা চুড়ির দিকে কোন ভ্রূক্ষেপ করে না সে। সোনার নোলক, চুড়ি, টিকলি আর বাজুবন্ধ না থাকার কোন আক্ষেপ হয় না টমবয় চ্যামের।
তার শুধু আপনার মানুষটাকে আঁকড়ে ধরে জব্দ করতে পারলেই হয়।।
-------
সেদিন বৃষ্টি তে প্যাঁচ প্যাঁচে কাদা ঢাকা শহরে। গলি দিয়ে চলছে একটা রিকশা। সন্ধ্যার ভেজা বাতাসে থেকে থেকে শীত শীত লাগছে আমার। চামেলি তার নীল ওড়নাতে আমাকেও ঢেকে নিলে, বেশ হত। নীল ওড়নার মানুষটির শরীরের উষ্ণতা বড্ড তাড়া করছে আমাকে। গম্ভীর চশমাওয়ালী আচানক খামছে আমাকে ছুঁয়ে দেবে, আশা নিয়ে বসে আছি ত্রি-চক্রযানে। আশা- নিরাশার দোলাচলে রিকশা এসে থামলো কাঙ্খিত পুরাতন কফি শপের কাছাকাছি।
ওয়ালেট থেকে রিকশা ভাড়া দিতে দিতে পেছনে শাটার পরার শব্দ শুনলাম। সাঁঝ বাতি জ্বলা মেট্রোপলিটন শহরের লোহার শাটার নয়, চামেলির সেল ফোনে ছবি তোলা শাটার। না সেলফি মার্কা মেয়েলি ছবি আমি তুলি না। হাসি হাসি মুখে ফ্রেমে দাঁড়াতে পুরুষত্বের ইগোতে ভীষণ চোট লাগে। তবুও সব পুরুষের মত আমাকেও আত্মসমর্পণ করতে হয়। কলিজা পুড়া'র গন্ধে মায়ার টানে আলিঙ্গন করতে হয় টমবয় চ্যাম নামের মায়ার পুতুল টাকে।
কখনো দেখি গম্ভীর মেয়ে টা কপোট খোলস ছেড়ে ফোনের ক্যামেরা নিয়ে হঠাৎ দস্যি হয়ে ওঠে। যা পায় সামনে তারই ছবি ওঠাতে থাকে পটপট। ঘামে ভেজা ফেরিওয়ালা, শিল পাটা ধার, টং দোকানের চা ওয়ালা মামা অথবা শ্যামলী নামের কিশোরী ফুলওয়ালি কেউ বাদ পরে না। স্মাইল প্লিজ' উৎপাতে ভেটকি মেরে অংশ নেয় সবাই। অবশ্য রাস্তা তে নিজের ছবি নেবার সময় আমাকে কাছাকাছি ঘেঁষতে হয় না। রাস্তার সেলফিতে হবু জামাইকে রাখার নিয়ম নেই, তাতে গৃহস্তের নাকি অকল্যাণ হবার প্রবল সম্ভাবনা থাকে।
তবে মাঝে মাঝে যে আমাকে ফ্রেমে নিমন্ত্রণ করা হয় না তা নয়। তখন মুখ শুকনো করে কাষ্ট হাসিতে অবস্থান গ্রহণ করি আমি। তারপর এক ফ্রেমে বাঁধা পরার সাথে সাথে শান্তির শান্ত একটা বাতাস ছুঁয়ে যায় আমায়, আদ্র হাওয়া ভিজিয়ে দেয় কুঞ্চিত কঠিন কপাল লেখন।
ক'টা দিন খুব ব্যাকুল কেটেছে আমাদের। টাকা পয়সার নিদারুণ টানাটানি, দিনমান টন়্টনে টেনশন, রাত জাগা দুটো চোখে কাক ডাকা ভোর। জামিন পাওয়া যাবে কিনা আদৌ! পাওয়া গেলে জেলগেটে ভাটির টান কোন গহীন সমুদ্রে নিয়ে ফেলবে চামেলির আপন মানুষটাকে কে জানে! কোন নিশ্চিত বয়ান চামেলি কে দিতে পারেনি কেউ।
জেলখানার সময় দীর্ঘতর হতে থাকে। কাছের মানুষ গুলো দূরতর হতে থাকে। প্রকৃতির অলিখিত আইন এটাই। তবে নিয়ম ভাঙার জীবন সংগ্রামে জয়ী চ্যামের মাথাতে প্রকৃতি বরাবর অসীম মমতায় হাত বুলিয়ে দেয়। কারা মুক্তি যত দূরবর্তী হচ্ছিল, প্রেমিকা আমার ততই নিকটবর্তী হচ্ছিল।
জেলের অর্ধ বছর সময়ে তাহার নাওয়া খাওয়া ঠিকঠাক হয়নি। গালে হাত দিয়ে মন খারাপ দিন কেটেছে ষ্টেথিস্কোপ ঝুলিয়ে। কত মানুষের অসুখ ভালো করে দেয় সে অথচ প্রেমিকের থেঁতলে যাওয়া পা আর ইলেকট্রিক শক খাওয়া যৌনাঙ্গ অচল হতে থাকে বিনা চিকিৎসাতে।
তবুও দিনে পাঁচ বার বিধাতার দুয়ারে কড়া নাড়তে ভুল হয় নি তার। আমার মত ছিদ্রান্বেষী নামে মাত্র মুসলমানকে সম্পর্কের দিব্বি দিয়ে জায়নামাজে পর্যন্ত টেনে নিয়েছে সে। সব হারানো দিশেহারা ব্যথিত মানুষের হৃদয়েই তো ঈশ্বরের অবাধ যাতায়াত।
কাঠিন্য'র আঁড়ালে চ্যামের মায়াবতী রূপ আমার জানাই হত না জেলের ঘানি টানাটানি না হলে। প্রকৃতি যা কেড়ে নেয় তার থেকে অনেক বেশি ফিরিয়েও দেয়। দীর্ঘ ১৭৩ দিন জীবন থেকে হারিয়ে ফেলে আমি পেয়েছি নতুন চ্যাম'কে। রুক্ষতার আবডালে লুকিয়ে থাকা তুলতুলে কেয়ারিং হৃদয়ের চামেলি কে।
রিকশা বিদায় করে ফুটপাতে দাঁড়িয়ে যাই আমি। এলবো ভাঁজ করে ৯০ ডিগ্রি ঘুড়িয়ে হাত পেতে নিঃশব্দ আহ্বান করি। তাকে বলতে চাইলাম আমি চলে এসেছি চ্যাম, আর কোন ভয় নেই। এসো আমার হাতটি আঁক়্ড়ে ধর।
আমার আহ্বান বুঝে ফেলে লাজুক প্রেমিকা। দৃঢ় পায়ে এগিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ায় সে। ঘাড় ঘুড়িয়ে এদিক ওদিক চেয়ে দেখে নেয় টমবয় চ্যাম। অনভ্যস্ত আনারির মত বাহুডোরে আটকা পরে হোঁচট খেতে হয় আমাদের। তবুও সেদিন ঢাকার রাজপথে তাকে বাহুডোরে বেঁধে হেঁটে যাই অনেকটা দূর।
ক্যাফে লাইভের পাশেই ছোট্ট ছিমছাম শপিং মল। ফল ফ্রুট, জিন্স গেঞ্জি পাঞ্জাবী পারফিউম থেকে শুরু করে স্যনেটারি ন্যাপকিন, ব্রা পেন্টি জাঙ্গিয়া সবই পাওয়া যায় এক ছাদের নিচে, ডাক্তার চামেলির ভ্যানিটি ব্যাগের নাগালে।
শূন্য পকেটের আমার জন্য সে কিনে নেয় একটা নীল ডেনিম। নীল শাড়ি পরে বই মেলাতে যাবে সে, সেদিন তার বাহু লগ্ন হয়ে হাঁটবো। প্রেমিকা যখন অটোগ্রাফ দেবে, গর্বিত চোখে তখন বিস্মিত হব আমি। জেলখানার সাক্ষাৎ কক্ষে এমনই কথা ছিল দুজনের।
ধীরে ধীরে দুজন ঢুকে যাই ক্যাফে লাইভের দক্ষিণ কোনের ছোট্ট টেবিলটাতে। বার টেন্ডারের মত উঁচু চেয়ারে বসে টেবিলে কুনুই ঠেকিয়ে কোনাকুনি ছুঁয়ে যায় দুজনের দুটি হাত। আঙুলে আঙুলের স্পর্শে কেমিষ্ট্রি খেলা করতে শুরু করে। বহু দিনের অভুক্ত আমি আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠতে চাই তখন।
কোন ফাঁকে টেবিলে হাজির হয় ধূমায়িত কড়া কফি আর পেস্তা স্বাদের দুখানা ব্রাউন চকলেট। ধূমায়িত কফির ধোঁয়া আর হৃদয় কেমিষ্ট্রির উষ্ণতাতে মেঘ জমে ওঠে দক্ষিণা কোন টেবিলের বিষুব রেখা বরাবর। ভালোবাসার মেঘগুলো ধোঁয়া হয়ে জমিয়ে তোলে দুজনের চড়ুইভাতি। চামেলি হয়তো অস্থির হয়ে ওঠে আত্মসমর্পনে। তবুও বিবেকের কার্নিভাল পেরিয়ে যাওয়া হয় না আমাদের।
সেলফোন বেজে ওঠে চামেলি'র। কর্কশ স্বরে ওপাশ হতে কেউ একজন দিতে শুরু করে বাড়ি ফেরার তাড়া। পৃথিবীর সব মায়েরাই বুঝি কন্যার সূর্যাস্ত'র পর ঘরের বাইরে থাকাতে অসহ্য বোধ করেন। ধূমায়িত কফির সাথে হৃদয় কেমিষ্ট্রির খেলা মা'কে বোঝানোর সক্ষমতা পৃথিবীর কোন মেয়েরই হয় নি। ডাক্তার চ্যাম প্রেমিকা হলেও সবার আগে তো একজনের আদরের রাজকন্যা।