সমস্যার সূচনা
আমার ভাগ্নি সম্প্রতি গুনতে শিখেছে । সারাদিন-রাত গুনছে ১,২,৩,৪...............1,2,3,4, ……………… ব্লা,ব্লা,ব্লা..................
ছোটদের একটা সমস্যা হচ্ছে সবকিছু সম্পর্কে অতিরিক্ত আগ্রহ । একটু ভুল হল, আসলে এটা ছোটদের সমস্যা না স্বভাব যা বড়দের সমস্যা সৃষ্টি করে ।
সকাল ১০.৩০ টায় যখন আমি আর্লি রাইজিংয়ের অভ্যাসটাকে চালু রাখতে ঘুম থাকে উঠলাম , অণু (আমার ভাগ্নি) এসে হাজির । তার গুরুগম্ভীর প্রশ্ন , মামা , ‘এক’ কি ?
আমি তো পুরো এন্ড্রোমিডা থেকে পরলাম , এ বাবা ! ‘এক’ আবার কি ? ১,২,৩,৪,৫,............ এগুলো হল সংখ্যা । এর শুরুটাই হল ‘এক’ ।
দ্বিগুন আগ্রহ নিয়ে অণু জিজ্ঞাসা করলো , কেন ? এটা ‘এক’ কেন ?
“ এটা এক না হয়ে ‘দশ’ হলে তুমি কি খুশি হতে ? তুমি কি গণিত অলিম্পিয়াড দিবা ?” ১০ ঘন্টার কাচা ঘুম ভাঙ্গাতে আমি মোটামুটি রেগেই গেলাম ।
“মামা, গণিত কি ?” আবার প্রশ্ন ।
বুঝলাম Question Firing শুরু হয়ে গেছে । এরপর প্রত্যেকটা নতুন শব্দের সাথে ‘কি’ Tag করে Fire চলতে থাকবে ।
প্রকৃতি অনেক সময় যাবত মিস্কল দিচ্ছিল । অণুকে বললাম “ তুমি তোমার গুগল মামার কাছে জিজ্ঞাসা কর, আমার এখন প্রকৃতির সাথে Appointment আছে” ।
কিছু ট্রাডিশনাল কথাবার্তা
অণুর প্রশ্ন দুটা কিন্তু গণিতের জগতে পা দেয়া কোনও আগন্তুকের প্রথম প্রশ্ন হওয়া উচিত । কিন্তু আসলে কি তাই হয় । আমি স্কুল ও কলেজ লাইফের অধিকাংশ পরীক্ষাতেই গণিতে ১০০% মার্কস পাওয়া ছাত্র , কিন্তু আমার মাথায় এরকম প্রশ্ন জাগেনি । আমি হলফ করে বলতে পারি আমাদের দেশের ৮০% শতভাগ নম্বর পাওয়া শিক্ষার্থীর মাথায় এই প্রশ্নটি জাগবে না ।
কেন ?
কেননা শতভাগ মার্কস পেতে ‘এক’ কি বা কেন জানার কোনও প্রয়োজন নেই ।
তাহলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে ?
মার্কস ( আরে মিয়া কার্ল মার্ক্স না, নাম্বার) এর দিকে নাকি জ্ঞানের দিকে ?
না , প্রসঙ্গ আমার এটা ছিল না । ( চলে আসলো তাই লিখে ফেললাম আর কি ! )
ভারতে গণিত চর্চার গৌরবোজ্জ্বল অতীত , আরে সংখ্যা গুলো তো আমাদের ডোমেস্টিক অ্যাসেট !
প্রসঙ্গে ফেরা যাক ;
১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯ এগুলোকে বলা হয় হিন্দু- আরবিক সাংখ্যিক প্রথা । এই প্রথা অনুসারে ২৫৬ কে পড়তে হবে দুই পাঁচ ছয় । ভারতীয় সংখ্যার এই পদ্ধতি মুলত পার্সিয়ান এবং আরবীয় গণিতবিদের ভারতে আগমন ও পারশপারিক সংস্কৃতিক আদান প্রদানের মাধ্যমে অর্জিত ।
বর্তমান সংখ্যা পদ্ধতি উত্তর আফ্রিকাতে স্বতন্ত্রভাবে বিকশিত হয় যেটি ভারতীয় বা পুর্ব আরবীয় সংখ্যাপদ্ধতি থেকে আলাদা ছিল । ইতালীয় পণ্ডিত ফিবনাক্কি উত্তর আফ্রিকার বাজাজা শহরে পড়ালেখা করেন (জন্ম নেন রিপাবলিক অব পিসা, আলজেরিয়া) , যিনি মুলত প্রচলিত সংখ্যা পদ্ধতি ইউরোপীয় দেশগুলোতে বিস্তার লাভে ভূমিকা পালন করেন ।
আচ্ছা , তোমাদের কি ফিবনাক্কি সেকোয়েঞ্চের সাথে পরিচয় আছে ?
ভেড়ার বংশ বিস্তার নিয়ে হিসাব রাখতে ফিবনাক্কি সাহেব যে দুনিয়া কাঁপানো সেকোয়েঞ্চ আবিষ্কার করেন ।
থাক , সে গল্প পড়ে কোন একদিন বলা যাবে ।
এখন বলা হয়ে থাকে হিন্দু- অ্যারোবিক সংখ্যা পদ্ধতি আবিষ্কার হয়েছিল নাকি ৫০০ খ্রিস্টাব্দে । আর দেখে তো বুঝতেই পারছ এটি ছিল ডেসিম্যাল বা দশ ভিত্তিক ।
আসলে কি তাই ?
হিন্দু- অ্যারোবিক সংখ্যা পদ্ধতিটি ছিল মূলত Glyph অর্থাৎ অক্ষর বা হরফ ভিত্তিক ।
০ Glyph = ৪৮ ডেসিম্যাল
আমাদের পূর্বসুরীদের আবিষ্কৃত এই সংখ্যাপদ্ধতির উৎপত্তি কিন্তু ব্রাহ্মী লিপি থেকে ! ৩০০খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকের কিছু বৌদ্ধ নিদর্শনে কিছু সঙ্কেত পাওয়া গেছে যা 1, 4 এবং 6 কে রেপ্রেসেন্ট করে । তার প্রায় এক শতাব্দী পড়ে ব্যাবিলনের গণিতবিদেরা ‘sexagesimal positional numeral system’ নামে একধরনের জটিল পদ্ধতির অবতারনা করেন । জটিল আর প্যাচ বেশী থাকায় ওটা কেউ বেশী ঘাটেনি ।
শূন্য ধারনাটিকে যথার্থ আকার দিয়ে প্রকাশের নজির পাওয়া যায় নবম শতকে মধ্য ভারতের ‘গোয়ালিয়রে’ যা ওই সময় সর্বজন স্বীকৃতভাবে গৃহীত হয় ।
ঠিক সেই সময়ে আল- খোয়ারিজমির “ অন দ্য ক্যাল্কুলেসন উইথ হিন্দু নিউমেরালস” এবং আল-কিন্দির “ কেতাব ফি ইতিমাল আল আদাদ আল হিন্দি” ( অন দ্য ইউজ অব ইন্ডিয়ান নাম্বার ) প্রকাশিত হয় যা ঐ সংখ্যা পদ্ধতি কে মধ্য-প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে পরিচিত করে তোলে ।
খোয়ারিজমির বইটি ১২০০ সাল পর্যন্ত সারভাইব করে , এর পর বইটির ল্যাটিন ট্রান্সলেসন থাকলেই মূল বইটি হারিয়ে যায় কালের অতলে । ল্যটিনে বইটির নাম হয় “Algoritmi de numero Indorum” যা থেকে এসেছে Algorithm শব্দটি । সেখান থেকে ভদ্রলোকটিকে “ Algebra” বা বীজগণিতের জনকের সম্মান দেওয়া হয় ।
সে যাই হোক, বিশ্বব্যপি ব্যবহৃত এই সংখ্যাগুলোর জন্ম আমাদের এই ভারতবর্ষে । শুধু সংখ্যাই নয়, আরো অনেক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার হয়েছে এই Sub-continent এ । ( কে বলে Western Public বেশী মেধাবী ? )
শূন্যের প্রথম সার্থক ব্যবহার করেন আর্যভট্ট (Aryabhata) । পাটীগণিতের জানকী কে জানতো ?
লীলাবতী !
পিথাগোরাসের সংখ্যা
সংখ্যার ইতিহাস কিন্তু রসহীন খটখটে ইংরেজি নামেই সীমাবদ্ধ নয় । এখানে আছে অনেক মজার গল্পও ............
গণিত বিষয়ের আদিপুরুষ হিসেবে খ্যাত পীথাগোরাস গণিতকে সুপ্রতিষ্ঠিত করায় অনন্য অবদান রেখেছেন। দর্শন, ধর্ম, বিজ্ঞানে তার যশ ছিল অসামান্য। তবে তার সংখ্যাতত্ত্ব সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি।
পীথাগোরাস বিশ্বাস করতেন বিশ্বের সকল বস্তু সংখ্যা দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব। সংখ্যা সম্বন্ধে তার দুর্বলতা ছিল অসীম। কোন বিন্দুকে একহিসেবে ধরে পর পর বিন্দু বসালে একটি রেখা সৃষ্ট হবে। এজন্য রেখাকে ২ বিবেচনা করা হত। দৈর্ঘ্য, প্রস্থের ক্ষেএফল ধরা হত ৩ এবং বস্তুর ঘনত্বের পরিমান ৪। ঐ যুগে মানুষ শুধুমাত্র ১০ অবধি গণনা করতে পারত।
সংখ্যাগুলোকে তিনি ব্যাখ্যা করতেন এভাবে, ১ সমস্ত সংখ্যার আদি, একারণে ১ দ্বারা ঈশ্বর বোঝানো হয়েছে, ২ সংখ্যাটি নারীর প্রতীক, ৩ পুরুষের প্রতীক, ২(নারী)+৩(পুরুষ)=৫ যা বিবাহের সংখ্যা, ৪ ন্যায়ের প্রতীক এবং ১০ হচ্ছে জাদু সংখ্যা।
বিবাহ ও বন্ধু নির্বাচনে তিনি সংখ্যাতত্ত্বকে বিশেষ গুরুত্ত্ব দিতেন। এক যুবরাজ তার মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি গণনা করে দেখলেন তার নামের সংখ্যা ২৮৪। তিনি ঘোষনা করলেন, যে কন্যার নামের সংখ্যা হবে ২২০ সেই হবে তার আদর্শ স্ত্রী। তবে পীথাগোরাস তার বিবাহে সংখ্যা তত্ত্বকে গুরুত্ব দেননি ! তিনি বিয়ে করেছিলেন তার ছাত্রী থিয়ানোকে। তিনি ছিলেন পীথাগোরসের যোগ্য ছাত্রী ও আদর্শ স্ত্রী।
সংগীতের সংগে সংখ্যার যে নিবিড় সম্পর্ক তাও সংখ্যা তত্ত্বের অবদান। এসব কারণে যুগে যুগে সংখ্যা তত্ত্ব একটি জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
একটু পিছনে ফিরি
এখন আবার গোড়াতে ফিরে আসি । ‘এক’ কেন ‘এক’ ?
ইংরেজি নাম্বারগুলো একটু লক্ষ্য কর 0; দেখ এর স্ট্রাকচারে কোথাও কোনও কোণ উৎপন্ন হয়নি .
0 এর ক্ষেত্রে উৎপন্ন কোণের সংখ্যা ০
এবার 1 এর ক্ষেত্রে স্ট্রাকচারের শীর্ষবিন্দুতে একটি কোন উৎপন্ন হয়েছে ।
অতএব , কোণসংখ্যা ১ ।
অনুরুপে প্রতিটি সংখ্যা 3,4,5,6,7,8,9 এর জন্য কোণের সংখ্যা হবে যথাক্রমে ৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯ টি ।
(ছবিটা খেয়াল কর ) ।
শেষাংক
একজন পদার্থবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ একটি কাফেতে বসে রাস্তার অপর পাড়ের একটি বাড়িতে মানুষজনের আসা যাওয়া দেখছেন। প্রথমে তারা দেখলেন দু’জন লোক বাড়িটিতে প্রবেশ করছে। কিছু সময় অতিবাহিত হল। কিছুক্ষণ পর তারা দেখতে পেলেন তিনজন লোক বাড়িটি থেকে বের হয়ে এল।
পদার্থবিজ্ঞানী বললেনঃ গণনা ত্রুটিপূর্ণ ছিল বলে ধারণা করছি।
জীববিজ্ঞানী মন্তব্য করলেনঃ আমার মনে হয় তারা বংশবৃদ্ধি করেছে। আর
গণিতবিদ বললেনঃ আরও একজন লোক বাড়িটিতে প্রবেশ করলে তা খালি হয়ে যাবে।
গণিত মানেই হার্ড লজিক আর সত্যিকার গণিত বোদ্ধাদের কাছে সেটাই মস্ত বড় ফান । পৃথিবীর হাজার হাজার মানুষ এর নিদর্শন পাওয়া যাবে যারা সারাটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন গণিত কে সঙ্গী করে । ট্রিবিউট জানাই তাদের প্রয়াসকে ।
শেষ করা যাক একটি ছোট্ট গাণিতিক প্রশ্ন দিয়ে,
১,৩,৪ এবং ৬ সংখ্যাগুলোর সাথে অপারেটর ব্যবহার করে ২৪ তৈরি কর।
কোন সংখ্যা বা অপারেটর দুইবার ব্যবহার করা যাবে না । ( খুবই সোজা, গিভ ইট অ্যা ট্রাই )
আজ এপর্যন্তুই ।
"জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হোক প্রতিটি হৃদয়"
পুর্বে ফেসবুকে প্রকাশিত