অনুবাদ প্রসঙ্গেঃ গল্পটি পড়ার সময় বেশ ভালো লেগেছিলো। আহামরি কোন টুইস্ট নেই।সাধারন গল্প।পাঠকেরা কি হবে তা সহজেই অনুমান করতে পারবেন।তবে তাই বলে না পড়ে থাকবেন না।আমি আবার গল্পের স্থান বদলে আমার শহর কুমিল্লা করেছি।পরে বুঝেছি করা উচিত হয়নি।তাও কোনমতে ঝামেলা কাটিয়ে উঠেছি।আশা করি পড়বেন এবং জানাবেন কেমন হল অনুবাদ।
গল্পঃ
গতকাল সন্ধ্যেবেলায় মা আর আমার সাথে ঘটে যাওয়া একটা মজার কাহিনি বলবো আপনাদের।আমি বারো বছর বয়সের মিষ্টি একটি মেয়ে। আমার মায়ের বয়স চৌত্রিশ হলেও মায়ের উচ্চতা আর আমার উচ্চতা প্রায় সমান।আমরা থাকি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় একটা ভাড়া বাসায়।
গতকাল বিকেলে মা আমাকে দাঁতের ডাক্তার দেখাতে শহরে নিয়ে গিয়েছিলো।আমার একটি দাঁতে পোকা হয়েছিলো। মানে গর্ত পাওয়া গেছে আরকি।ডাক্তার সেটাকে ফিলিং করে দিয়েছিলো।ফিলিং করানোর সময় যে কত ব্যথা লাগে তা নিজে অনুভব না করলে বুঝা যাবেনা।যাই হোক,ডাক্তারখানা থেকে বেরিয়ে আমরা একটা হোটেলে ঢুকেছিলাম।সেখান থেকে কফি খেয়ে বেরোতে বেরোতে প্রায় সন্ধ্যা ছ'টা বেজে গেলো। আর রাস্তায় এসেই দেখি আকাশের কান্না মানে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে।
''এই সেরেছে! এখন একটা সিএনজি লাগবে'',মা বললো।মা শাড়ি আর আমি স্কার্ট পরে ছিলাম।তুমুল বৃষ্টির ছাঁটে জামা কাপড় সব ভিজে যাবার জোগাড়।
''মা চলো আমরা আবার হোটেলটাতে ফিরে যাই'',আমি বললাম।আমার আরেক কাপ কফি খেতে ইচ্ছে করছিলো অবশ্য।কফিটা বেশ ভালো ছিলো।
''যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে তো মনে হচ্ছেনা খুব সহজে থামবে'',মা বললো।'আমাদের বাসায় ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি'।
আমরা বৃষ্টির মধ্যে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে সিএনজির খোঁজ করছিলাম।রাস্তা দিয়ে বেশ কয়েকটা সিএনজি গেলো কিন্তু সবগুলাতেই প্যাসেঞ্জার ছিলো।
''ইশ! আমাদের যদি ড্রাইভার সহ একটা গাড়ি থাকতো !!, মা একটু হতাশার সুরে বললো।
ঠিক তখন একটা লোক আমাদের কাছে এসে দাঁড়ালো।দেখতে ছোটখাটো গড়নের আর বেশ বৃদ্ধ। বয়স সম্ভত সত্তর আশির কাছাকাছি হবে।লোকটা একটা রুমাল দিয়ে মুখ মুছলো। এরপর একটু কেশে বললো,''ইয়ে,আমার একটু সাহায্য দরকার...।'' লোকটার মুখে ইয়া বড় সাদা গোঁফ আর ভ্রু দেখতে একেবারে ছ্যাঙ্গা মানে শুঁয়োপোকার মতোন।অনেক ভাঁজ পড়া মুখটা দেখতে কিছুটা গোলাপী গোলাপী।একটা ছাতা মাথায় ধরে নিজেকে বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করছিলো।
'জ্বী',মা নিরুত্তাপ সতর্ক গলায় বললো,''আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি বলুন। সাধ্যের মধ্যে হলে নিশ্চয়ই করবো।''
''এই একটুখানি উপকার করলেই হবে'',লোকটা প্রত্যুত্তরে বললো। আমি দেখলাম মা লোকটার দিকে বেশ সন্দেহজনক চোখে তাকাচ্ছিলো।আমার মা এমনিতেও খুব সন্দেহবাতিকগ্রস্ত।বিশেষ করে তার সন্দেহ দুইটা ব্যাপারে----অপরিচিত লোকজন আর সেদ্ধ ডিম। সেদ্ধ ডিম ভাঙ্গার সময় উনি চামচ দিয়ে এমনভাবে ডিমটাকে টোকা দিতে থাকেন যেন এর ভেতর থেকে কোন ইঁদুর বেরিয়ে আসবে।আর অপরিচিত লোকজনের ব্যাপারে তাঁর বিখ্যাত বানী হচ্ছে,''এরা বাইরে থেকে যতটা ভালো আর ভদ্র মনে হবে ভিতরে ভিতরে ঠিক ততটাই খারাপ আর শয়তান হবে।''এই ছোটখাটো বৃদ্ধ লোকটাকে বেশ ভালোই মনে হচ্ছে।বেশ শান্ত আর কথার ধরনও সুন্দরই। পরনে ভদ্রলোকের মতো পরিপাটি পোষাক।লোকটা আসলেই একজন ভদ্র মানুষ।তিনি যে সজ্জন তা আমি বুঝেছিলাম তার জুতো দেখে।''তুমি জুতা দেখে কোন লোক কেমন তা বলে দিতে পারবে'' এটা মায়ের আরেকটা বিখ্যাত বাণী।এই লোকটা বাদামী রঙের সুন্দর একজোড়া জুতা পরে আছে।
''আসলে ব্যাপারটা হচ্ছে কি...'' লোকটা বলে চললো,''আমি একটু বিপদে পড়েছি।তাই একটু সাহায্য দরকার।না না।আসলে এটা তেমন কিছুই না।আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি।আমার এই সাহায্যটা খুব প্রয়োজন।দেখুন ম্যাডাম,আমার মতো এই বয়সের লোকদের ভুলে যাবার প্রবণতা তো থাকেই,তাইনা?''।মা চিবুক একটু উপরের দিকে তুলে লোকটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নাক বরাবর তাকিয়ে রইলো।এই ব্যাপারটা বেশ ভয়ানক। মা যখনি কারো দিকে এভাবে তাকান সেই ভয়ে কুঁকড়ে যায়। আমি একবার আমাদের হেডমিস্ট্রেসকে তোঁতলাতে আর মূর্খের মতো হাসি দিতে দেখেছি যখন মা উনার দিকে তাকিয়ে নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছিলেন। কিন্তু এই মাথার উপর ছাতা ধরে রাখা এই বৃদ্ধ লোকটি এতে চোখের পাতাও ফেললো না।
ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন,''বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, এভাবে রাস্তার মধ্যে মহিলাদেরকে থামিয়ে নিজের সমস্যার কথা বলে বেড়ানোর অভ্যাস আমার নেই।''
'আশা করি আসলেই নেই'', মা জবাব দিলেন।মার এমন কড়াভাব দেখে আমি একটু বিব্রত বোধ করলাম। আমি বলতে চাইলাম,'মা দেখো, লোকটা অনেক অনেক বুড়ো।দেখতেও যথেষ্ট ভালো আর ভদ্র।তার উপর এখন ঝামেলায় পড়েছে।উনার প্রতি এতোটা কঠিন না হলেও চলবে।''কিন্তু আমি কিছুই বললাম না।
লোকটি ছাতাটা এক হাত থেকে অন্য হাতে চালান করলেন,''আমি আসলে আগে কখনোই এভাবে ভুলে যাইনি।''
'কি ভুলে যাননি?"মা বেশ কড়াভাবে জিজ্ঞেস করলো।
''আমার মানিব্যাগ',লোকটা বললো,''হয়তো অন্য একটা জ্যাকেটের পকেটে ফেলে এসেছি।কাজটা বোকার মতো হয়ে গেছে,না??''
''আপনি আমার কাছে টাকা ভিক্ষে চাইছেন?" মা বললো।
''হায় আল্লাহ!!',ভদ্রলোক ঠুকরে কেঁদে উঠলো,''আল্লাহ মাফ করুক আমাকে ভিক্ষা চাওয়ার থেকে।ছি ছি ছি!!''
''তাহলে আপনি কি চাইছেন?'' মা বললো,''দয়া করে একটু তাড়াতাড়ি বলুন। এই বিশ্রী বৃষ্টিতে ভিজে আমরা প্রায় জমে গেছি।''
'তা দেখতে পাচ্ছি',লোকটি বলল,''সেজন্যই তো আমি আপনাদের এই ছাতাটা দিতে চাইছি।যাতে বৃষ্টিতে ভিজা থেকে রক্ষা পান। আর আমি এটা একেবারেই দিয়ে দিতে চাচ্ছি।শুধু যদি......যদি...''।
''যদি কি?" মা জিগ্যেস করলো।
'যদি এর বিনিময়ে আমাকে দুশো টাকা দেন সিএনজি ভাড়া হিসেবে।আমাকে বাড়ি যেতে হবে।''
মার সন্দেহ এখনো যায়নি।'আপনার কাছে যদি প্রথম থেকে টাকা না থেকে থাকে তাহলে এখানে কিভাবে এলেন??
''হেঁটে',লোকটি উত্তর দিলো,'প্রতিদিন আমি বেশ অনেকক্ষন ধরে হেঁটে বেড়াই। আর তারপর সিএনজি করে বাড়ি ফিরে যাই।বছরের প্রতিটা দিনই আমি এমন করি।''
''তাহলে আপনি এখন হেঁটে বাড়ি চলে যাচ্ছেন না কেনো?" মার প্রশ্ন।
''আমার তো ইচ্ছে করে হেঁটেই যেতে'',লোকটি বললো,''আমারতো ইচ্ছে করে।কিন্তু আমার মনে হয়না এই দুর্বল পা নিয়ে আমি হাঁটতে পারবো। এছাড়া আমি ইতিমধ্যেই অনেক পথ হেঁটে ফেলেছি।''
মা দাঁড়িয়ে নীচের ঠোঁট কামড়াচ্ছিলেন। আমি দেখতে পেলাম মা এবার কিছুটা নরম হয়েছেন। হয়তো এই ভারী বৃষ্টিতে একটা ছাতার নীচে আশ্রয় পাবার সম্ভাবনা মার কড়া ভাব কিছুটা দূর করেছে।
''ছাতাটা দেখতে খুব সুন্দর'',ভদ্রলোক বললেন।
''লক্ষ করেছি'',মা বললো।
''এটা সিল্কের কাপড়ের',লোকটা বললো।
'সে দেখতে পাচ্ছি'।
'তাহলে আপনি এটা কিনে নিচ্ছেন না কেনো,ম্যাডাম?আমি এটা চারশো টাকা দিয়ে কিনেছি।সত্যি বলছি। কিন্তু এখন আর এটার কোন গুরুত্ব নেই আমার কাছে।আমার বরং বাড়ি গিয়ে পা দুটোকে বিশ্রাম দেয়াটা বেশি দরকারি হয়ে পড়েছে।''
আমি খেয়াল করলাম মার হাত পার্সের হুক খোলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো। আমি যে খেয়াল করেছি মা তা দেখেছে।আমি আমার ট্রেডমার্ক লুকটা দিলাম মার দিকে তাকিয়ে।মা বুঝে গেলো আমি কি বলতে চাচ্ছি। 'মা শুনো,''আমি মাকে ইশারায় বলছিলাম,''আমার মনে হয়না এই দুর্বল বৃদ্ধ লোকের অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়া ঠিক হবে। এটা খুব পচা কাজ।''মা থেমে আমার দিকে ফিরে তাকালো।তারপর লোকটিকে বললো,'' দেখুন আমার মনে হয়না দুশো টাকা দিয়ে এই সিল্কের ছাতাটা নেয়া উচিত কাজ হবে। তারচে বরং আমি আপনাকে সিএনজি ভাড়াটা দিয়ে দিচ্ছি।আপনি চলে যান''।
''না। না। না।',লোকটা কেঁদে উঠলো।''এটা কোনভাবেই হতে পারেনা। স্বপ্নেও না। হাজার বছরেও এমন কাজ করতে পারবো না আমি।এভাবে আপনার কাছ থেকে টাকা নিতে পারিনা আমি। দয়া করে ছাতাটা নিন আর নিজেদের বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচান।'' মা আমার দিকে বিজয়িনীর হাসি হাসলো।বুঝাতে চাইলো,''দেখেছো।তুমি ভুল ছিলে।লোকটা চাইছে আমরা ওর কাছ থেকে ছাতাটা নেই।''
মা তার পার্স খুললো আর একশো টাকার দুটো নোট বের করলো। এরপর লোকটার দিকে টাকাটা বাড়িয়ে ধরলো।লোকটা ছাতাটা দিলো আর টাকাটা নিলো। পকেটে টাকা ঢুকালো। রুমালটা দিয়ে আরেকবার মুখ মুছলো।এরপর ধিন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলো।
''ছাতার নীচে এসো।বৃষ্টতে তো প্রায় ভিজেই গেছো';মা আমাকে বললো,'আমি এর আগে কখনোই সিল্কের ছাতা ব্যবহার করিনি।আমরা আসলেই ভাগ্যবান আজকে।''
'তুমি লোকটার সাথে প্রথমে এত কড়া ভাষায় কথা বলছিলে কেনো!''আমি জিগ্যেস করলাম।
'আমি নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম যে লোকটা কোন ধান্ধাবাজ টাইপের কেউ নয়'',মা বললো,''আর আসলেই লোকটা বেশ ভদ্র।উনাকে সাহায্য করতে পেরে বেশ খুশি লাগছে।''
''হ্যা,মা''আমি বললাম।
''সত্যিকারের ভদ্রলোক'',মা বলে চললো,''আর ধনীও। তা না হলে তার কাছে সিল্কের ছাতা থাকতো না। আমি অবাক হবো না যদি লোকটা কেউকেটা গোছের কেউ হয়। হয়তো দেখা যাবে তার নাম হাজী আখতারুজ্জামান বা এমন কিছু।দানবীরও হতে পারে।এই ব্যাপারটা তোমার জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে।''
''জ্বী, মা'',আমি সায় দিলাম।
'কখনোই তাড়াহুড়ো করবেনা।সবসময় একটু সময় নিয়ে মানুষজনকে লক্ষ্য করবে।তাহলে তুমি আর ভুল করবেনা।''
''ওই যে লোকটা যাচ্ছে',আমি বলে উঠলাম,'' দেখো''।
''কোথায়?"
''ওইযে ওখানে।রাস্তা পার হচ্ছে।দেখে মনে হচ্ছে খুব তাড়ার মধ্যে আছে''।লোকটা বেশ কসরত করে ব্যস্ত রাস্তা পার হলো।ওপাশে গিয়ে বামদিকে ঘুরলো আর অনেক জোরে হাঁটতে লাগলো।
''লোকটাকে দেখে তেমন ক্লান্ত মনে হচ্ছেনা।তাইনা,মা??'' মা কোন জবাব দিলোনা।
''উনাকে দেখে মনে হচ্ছেনা উনি সিএনজি খুঁজছেন'' আমি ফের বললাম।
মা খুব ধীরস্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটার গমনপথের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।আমরা লোকটাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। এমনভাবে হাঁটছে যেনো ভয়ঙ্কর তাড়ার মধ্যে আছে। সৈন্যদের মতো মার্চ করতে করতে পথচারীদের ধাক্কা দিয়ে এগিয়ে চলেছে।
''লোকটার অন্য কোন মতলব আছে'', মা বললেন থমথমে গলায়।
''কি মতলব?"
''জানিনা',মার কন্ঠ বেশ ঠান্ডা লাগলো।''কিন্তু তা আমরা বের করবো।এসো আমার সাথে।''মা আমার হাত ধরে রাস্তা পার হলো। এরপর আমরা বায়ে মোড় নিলাম।
''লোকটাকে দেখতে পাচ্ছ?"মা জিগ্যেস করলো।
''হ্যাঁ। ঐতো যাচ্ছে। ডানদিকে ঘুরে পরের রাস্তাটায় গেলো''। আমরাও রাস্তার কর্নারে এলাম আর ডানদিকে চললাম।লোকটা আমাদের চেয়ে মাত্র বিশ গজ সামনে। একদম খরগোশের মতো দৌড়াচ্ছিলো। তার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে আমাদের বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছিলো।বৃষ্টির ফোঁটা আরো জোরে পড়তে লাগলো। লোকটার মাথা থেকে পানি গড়িয়ে কাঁধে পড়ছে দেখতে পেলাম।আমরা বেশ ভালোই আছি সিল্কের ছাতাটার তলায়।
''লোকটার মতিগতিতো বোঝা যাচ্ছেনা''মা বললো।
''যদি পিছন ফরে তাকায় আর আমাদের দেখে ফেলে??"জিগ্যেস করলাম।
''দেখে ফেলবে ফেলবে',মা বললো,''লোকটা আমাদের সাথে মিথ্যে বলেছে।সে নাকি দুর্বল পায়ের জন্য হাঁটতে পারছিলোনা। অথচ এখন দৌড়ে আমাদের আগে আগে যাচ্ছে।সে একটা নির্লজ্জ মিথ্যেবাদী।ঠগ।প্রতারক।''
''তার মানে সে কোন কেউকেটা লোক নয়?" আমার প্রশ্ন।
''চুপ করে থাকো'',মা বললো।
পরের ক্রসিং পার হবার পর লোকটা আবার ডানে ঘুরলো।
তারপর বামে।
এরপর ডানে।
''এতো সহজে পিছু ছাড়ছিনা',মা বললো,
''লোকটা তো নেই'', আমি চিৎকার করে উঠলাম।''কোথায় গেলো?"
''ওই দরজা দিয়ে ঢুকেছে'',মা বললো,''আমি দেখেছি''
ওই দোকানটায়?? ওটাতো পুরনো একটা দোকান মনে হচ্ছে।দেখলাম নাম লেখা,''নাদের ট্রেডিং এন্ড কোং"। দেশি বিদেশি মদের দোকান।
''তুমি নিশ্চয়ই এর ভিতরে ঢুকবেনা,মা?" জিগ্যেস করলাম।''না। আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করবো।''
দোকানটার বাইরের দিকে বেশ বড়সড় কাঠের জানালা ছিলো।কাছাকাছি দাঁড়ালে ভিতরের কিছু অংশ ভালোভাবে দেখা যায়। আমরা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রইলাম।আমার হাত মায়ের হাতের উপর চেপে বসলো উত্তেজনায়।বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা ছাতার উপর পড়ে খুব শব্দ করছিলো।
'ওই যে লোকটা',মা বললো,'ওখানে'। আমরা যেটুকু দেখতে পাচ্ছিলাম তাতে দেখলাম দোকানের ভিতর অনেক মানুষ। সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে। আর ওই লোকগুলোর মাঝখানে বৃদ্ধ লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। তার জ্যাকেট এখন আর পরনে নেই। সে ভীড় ঠেলে বারের দিকে এগিয়ে গেলো।এরপর বারম্যানের সামনের টেবিলে দু হাত ছড়িয়ে রাখল। আমি তার ঠোঁট নড়তে দেখলাম যখন সে অর্ডার করছিলো।
বারম্যান কিছুক্ষনের জন্য সেখান থেকে চলে গেলো।সে যখন ফিরে আসলো তখন তার হাতে হালকা বাদামী তরলে পরিপূর্ন একটি গ্লাস ছিলো।বৃদ্ধ লোকটি দুশো টাকা রাখলো টেবিলে।
''ওটা আমার টাকা'',মা চিৎকার করে উঠলো।
'ব্যাটার সাহস কত বড়। ওই গ্লাসে কি আছে?"আমি জিগ্যেস করলাম।
''বাংলা মদ। একদম খাঁটি বাংলা মদ।'',মা অবাক চোখে বললো।এদিকে লোকটা আস্তে আস্তে তারিয়ে তারিয়ে গ্লাসের সবটুকু তরল গলায় ঢেলে দিলো।
''ব্যাটা এক নিমিষে টাকাটা নষ্ট করে ফেললো এই বাজে জিনিস খেয়ে!!''মা বললো। আমি দেখলাম দোকানি এর মধ্যেই টাকাটা পকেটস্থ করে ফেলেছে।
''ওর কিন্তু লসই হয়েছে।সিল্কের ছাতাটার দাম কিন্তু চারশো টাকা'',আমি বললাম।
''সে যাই হোক।এই লোক আস্ত পাগল'',মা বললো।
বৃদ্ধ লোকটির মুখে তখন প্রশান্তির হাসি।তার চোখে মুখে সুখের সোনালি আভা ঝিলিক দিয়ে উঠছিলো।আমি লক্ষ্য করলাম লোকটা তার জিহ্বা বের করে গোঁফে লেগে থাকা মদের শেষ ফোঁটাটুকুও চেটে নিলো।
আস্তে করে সে দোকান থেকে বের হবার উদ্যোগ নিলো। জ্যাকেটটা পরলো।এরপর যেন কেউ তাকে লক্ষ্য করছেনা এমন ভঙ্গিতে দোকানের এক পাশে ঝুলানো অনেকগুলো ছাতা থেকে একটা ছাতা নিয়ে নিলো।
''দেখছো লোকটা কি করলো!!',মা বলে উঠলো।'দেখছো কি করলো !'
''শশশশস!লোকটা বেরিয়ে আসছে'',আমি বললাম।আমরা আমাদের ছাতাটা দিয়ে নিজের মুখ ঢাকলাম যাতে সে আমাদের দেখতে না পায়।
বেরিয়ে আসলেও লোকটা আমাদের খেয়াল করলোনা।নতুন ছাতাটা খুলে মাথার উপর ধরে যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকে হাঁটতে লাগলো।
''তাহলে এটাই লোকটার চালিয়াতি'',মা মাথা নেড়ে বললো।
''কি দারুন ব্যাপার'',আমি বললাম।আমরা তাকে অনুসরণ করে ঠিক আগের জায়গায় আসলাম আর দেখলাম একইভাবে ছাতার বদলে টাকা নেয়ার ফন্দি আঁটছে লোকটা ।এবার এক লম্বা ভদ্রলোকের কাছে ছাতাটা বিক্রি করলো। আর এরপর আগের দোকানটাতে না গিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো।
''দেখেছো লোকটা কি চালাক'',মা বললো,''একই দোকানে বারবার যায়না।মনে হচ্ছে আরো কয়েকটা মদের দোকান আছে এ শহরে।''
''হুম',আমি বুঝদারের মতো বললাম,''আর নিশ্চয়ই বৃষ্টির দিনের জন্য সে মনপ্রাণ উজাড় করে প্রার্থনা করে''।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:১৩