ফেব্রুয়ারির শেষদিনের সকালবেলা।১৩নং গুলবাহার লেনের একটি বাড়ি।বাড়ির নাম: স্বর্ণকুটির।একতলা পুরনো বিল্ডিং।প্রাচীরঘেরা।ভিতরে বাড়ির সামনে কিছুটা খোলা জায়গা।একপাশে জংলা আর নর্দমা।প্রাচীরের কোলঘেঁষে নারিকেল গাছের সারি।বাড়িটার সামনে এখন একটি পিক-আপ দেখা যাচ্ছে।কিছু লোক তাতে মালপত্র উঠাচ্ছে ধরাধরি করে।মালপত্র বলতে বাড়ির বাসিন্দাদের আসবাবপত্র---আলমারি, খাট,ওয়ার্ডরোব,সোফা ইত্যাদি।ছোট্ট রঞ্জু বারান্দায় বসে শূন্য চোখে আনমনা হয়ে মালামাল উঠানো দেখছে।ওরাই এই বাড়ির বাসিন্দাঅবশ্য আজ থেকে আর থাকবেনা।নতুন একটা শহরের নতুন একটা পাড়ার নতুন বাড়িতে চলে যাবে। এই বাড়িটার প্রতি রঞ্জুর অনেক মায়া জন্মে গেছে।ও বারান্দা থেকে একবার ভিতরে গেলো।বাবার কন্ঠ শোনা যাচ্ছে,"এটাই এ বাড়িতে শেষ সকাল কাটানো।এমন সস্তা আর ভালো বাড়ি সহজে পাওয়া যায়না,রাশেদা।" রাশেদা ওর মার নাম।তিনি প্রত্যুত্তরে কিছু বললেন না।বাবা আর রঞ্জুর বাড়িটা ছেড়ে যেতে কষ্ট হলেও মা কিন্তু বেশ খুশি।এই পুরনো মান্ধাতার আমলের বাসায় উনার থাকতে মন সায় দেয়না এখন আর।রঞ্জু চুপচাপ হেঁটে হেঁটে এ ঘর ও ঘর করছে।সবগুলো রুম প্রায় খালি।মেঝেতে নানা রকম ভাঙাচোরা জিনিসপাতি, বাক্স-প্যাটরা,ধূলি-ময়লা পড়ে আছে।অনেক বছর ধরে ছিলো ওরা এই বাসায়।রঞ্জুর বয়েস এখন আট।ওর জন্মের পর থেকেই ওদের ছোট পরিবার এই বাসায় থেকে আসছিলো।এজন্যই হয়তো বাসাটার প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন বন্ধন একটা অবুঝ মায়া তৈরি হয়ে গিয়েছে।শুধু বাড়িটা নয়-এই পাড়াটার প্রতিও যে টান আছে তা এই যাবার বেলায় রঞ্জু বেশ টের পাচ্ছে।
ওর রুমটার সাথে লাগোয়া বারান্দায় এসে আবার দাঁড়ালো রঞ্জু।সকালের মিঠে কোমল রোদ লোহার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে এসে উম দিচ্ছে এই বসন্তের সকালে।কিন্তু রোদের উষ্ণ উম উপভোগ করার মতো মনের অবস্থা রঞ্জুর এখন নেই।অন্যদিন হলে বারান্দায় রাখা মোড়াটাতে বসে কমিক্স পড়তো সে।বারান্দার এক পাশে ঝুলানো টিয়াপাখির শুণ্য খাঁচাটা ঝুলছে একাকী।খালি বাড়ি আর খালি বাসা--এ দুয়ের মাঝে কোথায় জানি মিল এসে গেছে আজ।যদিও বাড়িটা খালি থাকবেনা।কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো নতুন ভাড়াটিয়ারা এসে পড়বে।
রঞ্জু পিক-আপটার দিকে তাকালো।বিভিন্ন জিনিসপত্র আর ফার্নিচারের মাঝে সোফা সেটটা এমনভাবে রাখা আছে যে চাইলেই ওখানে গিয়ে বসে পড়া যায়।একদম রাজ সিংহাসনের মতো।সোফায় বসে মালপত্রের সাথে হাইওয়ে ধরে নতুন ভুবনে যাবে আর চারদিকের লোকজন অবাক চোখে তাকিয়ে থাকবে এমনটা ভাবতেই ওর ভারি রোমাঞ্চ হলো।পরক্ষনেই আবার এই বাড়ি,এই পাড়ার কথা ওর ভাবনার জগতে আবার হানা দিলো।ও চিন্তা করতে লাগলো এখানে কাটানো বিগত দিনগুলোর কথা।কত মিষ্টি-মধুর আর তিক্ত স্মৃতি আছে এই বাড়ি এই এলাকা ঘিরে।
হঠাত মায়ের ডাকে ওর ভাবনায় ছেদ পড়লো।"রঞ্জু,দেখতো বাবা, বাথরুমের সাবান,টুথপেস্ট, শ্যাম্পুর বোতলগুলো বাক্সে ঢুকানো হয়েছে কিনা"।
রঞ্জু গিয়ে বাথরুমে উঁকি দিলো।আশ্চর্য ওর এই বাথরুমটার জন্যও মন খারাপ হলো।মানুষের আবেগ যে কোথায় কিভাবে কেনো কাজ করে তার যে কোন ঠিকঠিকানা নাই তাই বুঝা গেলো।চুপিসারে বাথরুমের জিনিসগুলো এনে রুনু খালার হাতে দিলো সে।রুনু খালামনি এসেছেন মাকে সাহায্য করতে।কিন্তু কাজের চেয়ে অকাজই বেশি করে চলেছেন ওর এই চঞ্চলা খালামণি।
"এই দেখ কি পেয়েছি।তোর পুরনো ক্রিকেট ব্যাট,বল আর গল্পের বই"রুনু খালা বললো।রঞ্জু অবাক হলো।এতোদিন এগুলো খুঁজেই পাচ্ছিলো না।বেখাপ্পাভাবে খালি হয়ে থাকা রুমগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে ওর ভাবলো এই একটা ভালো ব্যাপার ঘটলো।ফার্নিচারগুলো সরানোতে ওর হারানো প্রিয় বস্তুগুলো আবার ফিরে পাওয়া গেলো।এতোদিন এগুলো হয় আলমারির চিপায় কিংবা ওয়ার্ডরোবের পিছনে লুকিয়ে ছিলো।রঞ্জু যত্ন করে নিজের বাক্সে রেখে দিলো সেগুলো।
তারপর ওর মনে পড়লো পাগলা দাদুর কথা।উনার কাছ থেকে এইবেলা বিদায় নিয়ে আসা দরকার। মাও বলে দিয়েছেন যাতে দেখা করে দোয়া নিয়ে আসে। এই দাদু ওদের পাশের বাড়িটাতে থাকে। অবসরপ্রাপ্ত হবার পর থেকেই উনার মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। তবে তা শুধু বড়দের সাথে।সেজন্যই উনার নাম হয়েছে 'পাগলা দাদু'।কিন্তু বাচ্চাদের দাদু খুব ভালোবাসেন।প্রায়ই গল্প শোনান।নানান দেশের অদ্ভুত সব গল্প।কত কি জানা যায় দাদুর কাছে।রঞ্জু দাদুদের বাড়ির সামনে আসতেই দেখতে পেলো উনি চেয়ারে বসে রোদ পোহাচ্ছেন।ওকে দেখেই হাসলেন।
--কি দাদু, আমাদের ছেড়ে চলেই যাচ্ছ তাহলে
--আমিতো যেতে চাইনা।আব্বুর জন্যই তো যেতে হচ্ছে। বদলিটা না হলে কত্ত ভালো হতো
--তা হতো।কিন্তু এক জায়গায় মানুষ আর কতদিন থাকবে। নতুন জায়গায় নতুন পরিবেশে গিয়ে থাকতে হয়।নানান অভিজ্ঞতা হবে।কত মানুষের সাথে পরিচিয় হবে
--কিন্তু আমি যে আর তোমার গল্প শুনতে পারবোনা।ঝন্টু-মিন্টুরা তো ঠিকই শুনবে
--আমি কি আর চিরকাল বেঁচে থাকবো নাকি গল্প বলার জন্য।তাছাড়া এরচে ভালো নিজেই নানান জায়গা ঘুরে নানান বই পড়ে গল্প বলা শিখা।তাইনা??এখানকার গল্প করতে হবে নতুন জায়গায় বন্ধুদের কাছে। সেটাও বা কম কিসে !
রঞ্জু মাথা নাড়ল বুঝদারের মতো।
--কিন্তু আমার যে তোমাদের কথা মনে পড়বে সারাক্ষন
--প্রথম প্রথম মনে পরোবে।তারপর আস্তে আস্তে মানিয়ে নিবে।হয়তো দেখা যাবে একসময় আমাদের ভুলেই যাবে একেবারে।
--কক্ষনো না। আমি প্রায়ই মার সাথে এখানে চলে আসবো।
--বেশতো। এসো। দাদুও খুব খুশি হবো তুমি আমাকে দেখতে এলে।তোমাদের যাবার সময় বোধয় হয়ে এলো। দাদু আশীর্বাদ করে দিলাম। অনেক ভালো থেকো।
রঞ্জু এখান বিদায় নিয়ে নিজেদের বাড়ির দিকে আসতেই দেখলো পিক-আপটা ঘিরে ওর বন্ধুরা সব জটলা বেঁধেছে। বুল্বুলি,ঝন্টু-মিন্টু,পাপলুরা এসেছে ওর সাথে শেষ দেখা করতে।সেই ছোটবেলা থেকে একসাথে এদের সাথেই বড় হয়েছে রঞ্জু।একসাথে খেলা,একসাথে স্কুলে যাওয়া,ঝগড়া করা,এক কমিক্স সবাই মিলে পড়া আরো কত নানান রকম খুনসুটি করে বেড়িয়েছে ওরা।এমনকি ঝন্টুটার সাথে স্পাইডারম্যান না সুপারম্যান বেশি শক্তিশালি এ নিয়ে তর্ক করে মারামারি পর্যন্ত করেছে। আর এখন?? ওরা ঠিকই এসব করে বেড়াবে।শুধু থাকবেনা রঞ্জু।
-- তোর বুঝি এই গাড়িটা করে যাবি??'বুলবুলির প্রশ্ন
রঞ্জু ফ্যাকাশে হাসি হেসে বললো,''না।আমাদের জন্য আরেকটা গাড়ি আসবে।''
-- ''হ্যাঁরে রঞ্জু,আমাদের ভুলে যাবিনাতো নতুন জায়গায় গিয়ে??'এবারের প্রশ্নটা ঝন্টুর।
-- ''মোটেই না'' রঞ্জু জবাব দিলো
-- ''তুই চলে একটা বড় সমস্যা হয়ে যাবেরে। আমাদের এখন নতুন করে ব্যাট বল কিনা লাগবে। তোর ফুটবল দিয়ে যা না ভাই।'মিন্টুর চিন্তা এসব নিয়ে।
রঞ্জু বললো,'আমি কিন্তু আম্মুর সাথে মাঝে মাঝে আসবো''।এরপর ভাবলো এই ফাঁকে বুলবুলির কাছে একটা গোপন কথা বলেই দিবে। গতবছর ও যে বুলবুলির সাধের পুতুলটা অসাবধানে ভেঙ্গেছে সেটা বলে দিবে।কিন্তু কি ভেবে আর বললো না।মিতুটা আজ নেই। নানুর বাড়ি বেড়াতে গেছে।ওর সাথে দেখা আর হলোনা।শেষ যখন দেখেছে তখন ও মিতুকে খামচি দিয়েছিলো।মিতু নিশ্চয়ই রাগ করে আছে।
''তোরা এখানে কত্ত মজা করবি। আর আমি ওখানে একা একা বসে মন খারাপ করবো।তোদের কথা খুব মনে পড়বে আমার।'রঞ্জু বললো।
এ কথা শুনে বুলবুলি ঠোঁট উল্টিয়ে বললো,''কচু মনে পড়বে। তুই গিয়েই নতুন নতুন বন্ধু পাতিয়ে ফেলবি''
এ সময় মিন্টু তার শার্টের ভিতর লুকানো একটা বই বের করে রঞ্জুকে দিলো। আনকোরা নতুন বই। নামঃ সেরা সন্দেশ।
--''আব্বু এনেছে আমার জন্য। তোকে গিফট দিয়ে দিলাম'' মিন্টু বললো।
আজকে এই প্রথম রঞ্জুর মুখে হাসি ফুটলো। বইটার প্রথম পাতায় ও দেখলো গোটা গোটা অক্ষরে মিন্টু লিখেছে,'' মনে রাখিস আমাদের"।
এদিকে মার ডাক শুনতে পেলোঃ
''রঞ্জু,আমাদের যাবার গাড়ি এসে গেছে।তাড়াতাড়ি রেডি হও'।
ও দেখলো একটা মাইক্রোবাস এসে পিক আপটার পেছনে থেমেছে।ও বাড়ির ভিতর চলে এলো। শেষবারের মতো ওর প্রিয় বাড়িটা একবার দেখে নিবে। কিন্তু কেনো জানি ও শুধু নিজের ঘরটাতেই এলো।এই রুমটার সাথে ওর আত্মার শখ্যতা। এর প্রতিটি কর্নার,দেয়াল,দেয়ালের হাবিজাবি আঁকিবুঁকি, পোস্টার এমনকি ওই টিকিটিকিগুলাকেও ওর কত কাছের মনে হচ্ছে এখন।
দক্ষিণের জানালাটার কাছে দাঁড়ালো সে। এখান থেকে জংলা জায়গাটার ওপারে ওই ভুতুড়ে তেঁতুল গাছটা দেখা যায়। সেজন্য ও এই জানালাটা তেমন খোলা রাখতোনা।অথচ আজকে তেঁতুল গাছটাকেও আপন মনে হচ্ছে।
মজনুর মার কথা শোনা যাচ্ছে।ভিখারী এই মহিলা প্রায়ই রঞ্জুদের বাসায় আসে। এটা সেটা নেয়ার জন্য। কোনদিন খালি হাতে ফিরে যায়নি।এজন্যই মাকে খুব ভক্তি করে।এই মুহূর্তে মার সামনে বিলাপ করছে মহিলা। তাকে এখন কে যখন তখন সাহায্য করবে বলে আপসোস করছে। রঞ্জু সেদিকে এগুলো।মজনুর মা ওকে দেখেই কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।বললো,''ভাইজানরেও আর দেখবার পারুম নাহ।আহারে! ঠিকমতোন পড়ালেখা কইরেন ভাই।আব্বা-আম্মার কথা শুইনবেন। দোয়া করি অনেক অনেক বড় হন।''রঞ্জু আস্তে করে বললো,'আচ্ছা''।
মাইক্রোবাসে উঠে পড়লো সবাই।রঞ্জু আগে গিয়ে সামনে চালকের সিট দখল করে বসলো।পেছনে বাবা,মা আর রুনু খালা।ওদের মালামাল ভর্তি পিক-আপটা একটু আগে ছেড়ে গেছে।বাড়ির গেইটের সামনে ছোটখাটো জটলা। আশেপাশের পরিচিতিরা এসেছে বিদায় জানাতে।তাদের মাঝে রিংকু ভাইয়াকে দেখতে পেলো রঞ্জু। এই রিংকু ভাইয়ার সাইকেলের পিছে চড়ে এই মফস্বল শহর পুরোটা ঘুরে বেড়িয়েছিল রঞ্জু।গাড়ি স্টার্ট দিলো। ঝন্টু,মিন্টু,বুলবুলিদের সাথে শেষবারের মতো চোখাচোখি হলো।ও হাত নাড়লো। সামনে এগিয়ে গেলো গাড়ি।জানালার ফাঁক দিয়ে রঞ্জু ওদের বাড়িটার দিকে তাকালো।দূরে সরে যাচ্ছে বাড়িটা--দূরে সরে যাচ্ছে ওর বন্ধুরা।পিছনে পড়ে গেলো ওর সব সুখস্মৃতি।মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে রঞ্জু চলে যাচ্ছে নতুন ভুবনের পানে।ওর ছোট্ট বুকে অস্পষ্ট হাহাকার বেজে উঠলো। আর চোখের কোনে জমে উঠলো চিকচিক করা নোনা জল।
#সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৫২