নোবেল মেডেল কি লুকিয়ে ফেলার জন্য?? নাকি সকলকে দেখিয়ে বেড়ানোর জন্য?? নিশ্চয়ই পরেরটা।'দেখিয়ে বেড়ানো' কথাটা হয়তো ঠিক হলোনা।তবে লুকিয়ে ফেলার জন্যও তো নয়।আর সেকারনেই মেডেলগুলো অনেকেই মিউজিয়মে দিয়ে দেন।কিন্তু মাঝে মাঝে এমন পরিস্থিতিও আসে যে নোবেল মেডেলও লুকানোর প্রয়োজন হতে পারে।আসুন জেনে নিই কেমন সে পরিস্থিতি।
১৯৪০ সাল।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়।হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসী বাহিনী অপ্রতিরোধ্য গতিতে ইউরোপের বড় বড় শহরগুলো একের পর এক দখল করে নিচ্ছে।এবার তাদের করাল থাবা পড়লো ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে।কোপেনহেগেনের প্রতিটি রাস্তায় রাস্তায় নাৎসী সৈন্যরা মার্চ করে বেড়াচ্ছে আর বাড়ি-ঘর,প্রতিষ্ঠান আর বিজ্ঞানাগার লুট করে চলেছে।সাথে চলছে নির্মম নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ।
নীলস বোর।নোবেল বিজয়ী বিখ্যাত পদার্থবিদ।ওই মুহূর্তে আছেন 'বোর ইন্সটিউট অব থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স' এর ল্যাবে।হাতে সময় খুব কম।হয়তো এক ঘন্টাও নেই। কিংবা কে বলতে পারে মিনিটখানেক পরেই হয়তো এসে হানা দিবে হিটলারের কুখ্যাত বাহিনী।অথচ তার আগেই বোরকে দুই দুইটা নোবেল মেডেল লুকিয়ে ফেলতে হবে।পারলে সম্পূর্ণ অদৃশ্য করে দিতে হবে।
নোবেল মেডেলগুলো বানানো হয় ২৩ ক্যারট স্বর্ণ দিয়ে।খোদাইকৃত আর চকচকে বলে লুকিয়ে রাখা কঠিন।বেশ ভারীও বটে।এদিকে নাৎসীরা ঘোষণা দিয়েছে,' জার্মানী থেকে কোন ধরনের স্বর্নই বের হয়তে পারবেনা'।বিশেষ করে ১৯৩৫ একজন জেলেবন্দী শান্তিকর্মী নোবেল পাবার পর তাদের নোবেল বিদ্বেষ চরমে রূপ নেয়।দুজন জার্মান নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী যারা জন্মসূত্রে ইহুদি তারা আগেই বুদ্ধি করে তাদের মেডেলগুলো পাঠিয়ে দিয়েছেন বোর ইন্সটিউটে। আশা একটাই, যুদ্ধকালীন সময়ে এগুলো অন্তত নিরাপদে থাকবে।এদের একজন আবার ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টির বিরোধী। যদি কোনভাবে বোর ইন্সটিটিউটে এই মেডেলগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া যায় তবে সর্বোচ্চ শাস্তি ছাড়া অন্য কিছু ভাবাই যায়না।
দুঃখজনকভাবে মেডেলগুলো এখন বোর ল্যাবে জলজ্যান্ত প্রমাণ হিসেবে এই দুই বিজ্ঞানীর মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। বোর জানেন যে, নাৎসিদের চোখ এই ইন্সটিটিউটে পড়বেই। তাছাড়া গত এক বছর ধরেই ইহুদিদের ভরসাস্থল হয়ে দাঁড়িয়েছে বোর ইন্সটিউট।অনেক ইহুদিকে রক্ষা করার করার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অগ্রগণ্য। এসব নাৎসিদের অজানা নয়।নীলস বোর নিজেও যে তাদের টার্গেট সেটাও স্পষ্ট।এখন তিনি এই মেডেল দুটো নিয়ে করবেন বুঝে উঠে পারছিলেন না।
'There will be always a solution to every problem'--- আর হ্যাঁ, সেই জন্যেই বোধ হয় ওইদিন বোর ল্যাবে কাজ করছিলেন এক হাঙ্গেরিয়ান রসায়নবিদ।
নাম তাঁর - জর্জ দ্য হ্যাভসে।যিনি আর কয়েক বছর পরে নিজেই নোবেল পুরষ্কার পাবেন। তো তিনি বোরকে পরামর্শ দিলেন যে মেডেলগুলো মাটিতে পুঁতে ফেলতে। বোর চিন্তা করে দেখলেন যে, নাৎসিদের আচরন অনুযায়ী তারা এই মেডেল পাবার জন্য সব জায়গায় তন্ন করে খুঁজে দেখবে এমনকি বাগান,আশেপাশের খোলা জায়গাও বাদ দিবেনা। এই পরামর্শ মানা গেলোনা।
এইবার হ্যাভসে রসায়নের দ্বারস্থ হলেন। বিজ্ঞানী বিজ্ঞানকেই কাজে লাগিয়ে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার একটা উপায় খুঁজে পেলেন। আর তা হলো মেডেলগুলোকে তিনি অদৃশ্য করে ফেলবেন।বোরকে বললেন,'আমি এগুলোকে দ্রবীভূত করে ফেলবো'।
যখন দখলদার বাহিনীর সৈন্যরা কোপেনহেগেনের রাস্তায় মার্চ করে বেড়াচ্ছিল তিনি তখন ব্যস্ত ছিলেন নোবেল মেডেলগুলোকে গলাতে।
আর এই গলানোর কাজে কোন সাধারন মিশ্রন ব্যবহার হয়নি। যেহেতু স্বর্ন অনেক নিষ্ক্রিয় ধাতু, সহজে ক্ষয় হয়না,মিশেও না এমনকি দ্রবীভুতও হয়না তাই এই কাজটা করতে হয়েছিল বিশেষ এক ধরনের মিশ্রনের সাহায্যে। এই মিশ্রনের নাম,'একুয়া রেজিয়া'।বাংলা নাম 'অম্লরাজ'।হাইড্রোক্লোরিক এসিডের তিন ভাগ আর নাইট্রিক এসিডের এক ভাগ মিশিয়ে তৈরি করা হয় এই 'একুয়া রেজিয়া'।
এই প্রক্রিয়া কিন্তু খুবই ধীর। প্রথমে নাইট্রিক এসিড স্বর্নের পরমানুগুলোর বন্ধন ঢিলে করে দেয়। এরপর হাইড্রোক্লোরিক এসিড তার ক্লোরাইড আয়ন দিয়ে স্বর্ণকে রুপান্তরিত করে ফেলে।এই কাজ কিভাবে করে দেখে নিন এখান থেকে।
পরে হ্যাভসে তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছিলেন, ' সেই বিকেলটা ছিলো শ্বাসরুদ্ধকর এক বিকেল। একেতো অনেক ভারী মেডেল ছিলো। আর স্বর্নও সহজে গলতে চায়না। কিন্তু ভাগ্য ভালো যে সময় যাচ্ছিলো আর স্বর্নও আস্তে আস্তে বর্ন হারিয়ে মিশ্রনে পরিনত হচ্ছিল।একসময় কমলা বর্নের একটা মিশ্রন পাওয়া গেলো।'
নাৎসিরা আসার আগেই এই তরল পদার্থটুকু পরীক্ষাগারের নিরাপদ একটা শেলফে বোতলে করে রেখে দেয়া সম্ভব হয়েছিলো। ওরা এসে ভাংচুর, তছনছ করা শুরু করলো। লুট করে টরে ওরা ফিরে গেলো। কিন্তু অক্ষত রইলো নোবেল মেডেলের ৪৬ ক্যারট স্বর্ন।
পরবর্তীতে হ্যাভসে দারুন এক কাজ করলেন। তিনি পুরো প্রকিয়াটার বিপরীত পন্থা চালালেন। স্বর্নগুলোকে আবার নিজের রূপে ফিরিয়ে আনলেন। ১৯৫০ সালের জানুয়ারীতে ওই কাঁচা ধাতু তিনি পাঠিয়ে দেন সুইডেনের স্টকহোমে নোবেল কমিটির কাছে। এবং তারা এই স্বর্নকে আবার মেডেলে পরিনত করেন এবং ওই দুই বিজ্ঞানীর কাছে ফিরিয়ে দেন যথাযথভাবে।
এত কথা বললাম অথচ এই দুইজন বিজ্ঞানীর নামই বলা হলোনা।এঁরা হলেন ম্যাক্স ভন লুই(১৯১৪ তে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পান) আর জেমস ফ্রাংক( ১৯২৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পান)।
নীলস বোরের নিজেরও নোবেল মেডেল ছিলো।কিন্তু তিনি একই বছরের মার্চের ১২ তারিখে তা নিলামে বিক্রি করে দেন ফিনিশীয় দুর্গতদের জন্য টাকা তোলার উদ্দেশ্যে। নিলামে ক্রেতা নিজেকে প্রকাশ করেন নি। পরে অবশ্য তিনি তা ফেরত দেন যা এখন ড্যানিশ হিস্টোরিক্যাল মিউজিয়াম অব ফ্রেডিকবর্গে গেলেই দেখা যাবে।
তিনজন নোবেলজয়ী-তিনটা মেডেল। যেগুলো হয় বিক্রি হয়েছে কিংবা দ্রবীভুত হয়েছে। আবার সেই আগের জায়গাতেই ফিরে এলো। যুদ্ধের সময় মেডেলগুলো একটু অন্য ধরনের ভ্রমন করতে ভালোবাসে বৈকি।
পোস্ট সূত্রঃ Dissolve My Nobel Prize! Fast! (A True Story)
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১:১৬