somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলামে মাতৃভাষার মর্যাদা

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মানুষের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশের ধ্বনিকে ভাষা বলে। মানবজাতি কখন কোথায় ভাষা ব্যবহার করেছে সে ইতিহাস ভাষাতাত্ত্বিকদের অজানা। ভাষার উদ্ভব উৎস তাদেরকে অনুসন্ধানী করেছে বটে; কিন্তু ভাষার আবির্ভাবতত্ত্বের কোন সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য আবিষ্কার করা যায় নি। নানা ধরনের থিওরী বা তত্ত্ব আবিষ্কারের মোদ্দাকথা হচ্ছে ভাষা আল্লাহ প্রদত্ত, এর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলা। পৃথিবীতে বহু ভাষার প্রচলন ও মানব জাতির ভাষার ভিন্নতা আল্লাহ তাআলার অপার কুদরতের একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। আল্লাহ বলেন, 'আর তারই কুদরতের অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃজন এবং পৃথক হওয়া তোমাদের ভাষা ও বর্ণের। নিশ্চয়ই এতে কুদরতের নিদর্শনসমূহ রয়েছে জ্ঞানবানদের জন্যে। (সুরা রূম: ২২) তবে যিনি যে ভাষা তার মায়ের কাছ থেকে জন্মসূত্রে লাভ করেছেন সেটাই তার মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা। পৃথিবীর যে কোন ভাষাভাষীর কাছে মাতৃভাষার আকর্ষণ বেশি, মাতৃভাষার মর্যাদা অতুলনীয় অনুপম। যে কারো কাছে মাতৃভাষাই শ্রেষ্ঠ এবং মাতৃভাষা চির অহঙ্কার ও গৌরবের। লাল সবুজের বাংলাদেশে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাভাষা। প্রখ্যাত ভাষা বিজ্ঞানী মুনীর চৌধুরীকে সম্ভবত কেউ জিজ্ঞাসা করেছিলেন তাঁর মাতৃভাষা কী? তিনি তখন একটি অত্যাশ্চর্য উত্তর দিয়েছিলেন। "আমার মাতৃভাষা কী? বাংলাভাষা। সমগ্র বাংলাভাষা। বিচিত্র রূপিনী বাংলাভাষা। অভিধানে আছে ষোড়শ রমণী মাতৃ সম্বোধনীযোগ্য। শ্মশ্রু থেকে তনয়া, গর্ভধারিণী থেকে পিতৃরমণী। ষোল নয়, আমার মাতৃভাষার ষোলশত রূপ। তারা সব পদ্মিনীর সহচরী। আমার মাতৃভাষা তিব্বতের গুহাচারী, মনসার দর্পচূর্ণকারী, আরাকানের রাজসভার মণিময় অলঙ্কার, বরেন্দ্রভূমির বাউলের উদাস আহবান, মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ইসলাম আমার মাতৃভাষা। আমার মাতৃভাষা বাংলাভাষা। (বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা, মনসুর মুসা. পৃ.-২)

বিশ্বখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, পৃথিবীতে ২৭৯৬টি ভাষা প্রচলিত আছে। তবে ভাষার প্রকৃত পরিসংখ্যান আজও নির্ণীত হয় নি। মাতৃভাষার প্রতি মানুষের সংরাগ চিরকালীন। বর্ণিল পৃথিবীকে আরো স্বপ্নিক ও আলোকিত করতে বাংলাভাষার প্রতি আমাদের মমত্ববোধ যে কোনো ভাষার চেয়ে বোধ করি বেশি। দেশমাতৃকার জন্য আত্মত্যাগ ও প্রাণোৎসর্গের ঘটনা জানা থাকলেও কোনো জাতি তার মাতৃভাষার জন্যে জীবনকে বিসর্জন দিয়ে শাহাদাতের মর্যাদা নিয়েছে এমন নযীর ইতিহাসে নেই। জাগতিক উৎকর্ষ ও নানাবিধ ব্যক্তিমোহের প্রতি কোনোরূপ ভ্রূক্ষেপ না করে বাঙালি জাতি মাতৃভাষাচর্চার গুরুত্বকে অনুধাবন করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য প্রাণোৎসর্গ করেছিলো। সেদিন ঢাকার পিচঢালা পথকে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রঞ্জিত করেছিল শহীদী চেতনায় উজ্জীবিত সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারের মত নাম না জানা আরো অনেক ভাষা সৈনিক। ভাষা আন্দোলন করে নিজের প্রাণকে বিলিয়ে দিয়ে তারা মাতৃভাষা বাংলাভাষার নাম বিশ্ব-ইতিহাসে রক্তে লিখে গেলেন। রক্তের বন্যায় সেদিন ভাষার বিজয়কে ছিনিয়ে এনেছিল বাংলাদেশের ভাষা সৈনিকগণ। এ বিজয় আত্মত্যাগের, এ বিজয় গৌরবের। ভাষার লড়াইয়ে তাদের আত্মোৎসর্গ আজ বিশ্ববাসীর কাছে মর্যাদায় আসীন। ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বাঙালি জাতির এ ব্যতিক্রমী ভাষার লড়াইয়ে অভূতপূর্ব বিজয়কে স্মৃতিবহ করে রাখতে ২১ ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা' দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ইউনেস্কোর কল্যাণে সকল জাতি এখন বাংলাভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং বাঙালি জাতির ভাষা-শহীদদের প্রতি অবনত-মস্তক। ২১ ফেব্রুয়ারি সম্মান লাভ করেছে, বিশ্বে বাংলাভাষার মর্যাদাও উন্নীত হয়েছে। এ গৌরব মাতৃভাষা বাংলার, এ গৌরব বাঙালি জাতির। উল্লেখ্য, বাংলা শুধু বাংলাদেশের নয়, বিহার প্রদেশের পূর্ণায়া জেলার পূর্বাংশ, রাঁচি, হাজারিবাগ, সাঁওতাল, পরগনা, সিংহভূম ও মানভূমের ভাষাও বাংলা। আসাম প্রদেশের করিমগঞ্জ, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া জেলার ভাষা বাংলা। বার্মার আরাকানের চলিত ভাষা বাংলা। এ ভাষাভাষীর সংখ্যা হিসেবে বাংলা পৃথিবীর সপ্তম স্থানে রয়েছে।
ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। অপরিসীম গুরুত্বের সাথে মাতৃভাষাকে স্মরণ করে ইসলাম। মাতৃভাষা শিক্ষা ও বিকাশে ইসলামের রয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন। আল্লাহ তাআলা নবী রাসুলদের কাছে যুগে যুগে যেসব আসমানী কিতাব প্রেরণ করেছেন, তা তাঁদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ বলেন: 'আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার জাতির লোকদের মাতৃভাষাতেই প্রেরণ করেছি। (সূরা ইবরাহীম: ৪) যেমন হযরত দাউদ (আ) এর কাছে যাবূর কিতাব তার মাতৃভাষা ইউনানী বা (আরামাইক) ভাষায়, মূসা (আ)-এর কাছে তাওরাত ইবরানী বা হিব্রু ভাষায়। এটাও তাঁর মাতৃভাষা। এভাবে ঈসা (আ) এর কাছে তাঁর মাতৃভাষা সুরিয়ানি বা সিরিয়ার ভাষায় ইনযিল কিতাব ও মুহাম্মদ (স) এর কাছে মাতৃভাষা আরবি ভাষায় আল-কুরআন প্রেরণ করা হয়। এসব আসমানী কিতাব যদি মাতৃভাষায় নাযিল না করতেন তবে এগুলো নাযিলের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতো। হিদায়াত ও অনুধাবনের পরিবর্তে চরম শ্রদ্ধাভরে বুকসেলফে সাজানো ছাড়া আর কোন লাভ হতো না। কেননা এসব আসমানী কিতাব নাযিলের মৌল উদ্দেশ্য হচ্ছে পুণ্য হাসিলের জন্যে এর মর্ম অনুধাবন করা। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে-এর আলোকে জীবনব্যবস্থা কায়েম করা। কুরআনে এসেছে: আর যদি আমি কুরআন অনারবদের ভাষায় নাযিল করতাম তবে অবশ্যই বলতো -- এর আয়াতসমূহ বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয় নি কেনো? এ কেমন কথা, অনারবী কিতাব এবং আরবিভাষী রাসুল। আপনি বলুন : এ কুরআন মুমিনদের জন্যে হিদায়াত ও ব্যাধির প্রতিকারস্বরূপ। কিন্তু যারা ঈমান আনে না তাদের কাছে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন তাদের জন্য অন্ধত্বস্বরূপ। (সুরা হা মীম-সাজদা: ৪৪) আল্লাহ অন্য একটি আয়াতে বলেন: 'আমি তো কুরআন আরবিতে নাযিল করেছি এ জন্যে যে, তোমরা তা বুঝবে।' (সূরা ইউসুফ:২) ইমাম আবু হানিফা (রা) মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর দেশবাসীর জন্যে মাতৃভাষা ফারসি ভাষায় আল-কুরআন অনুবাদ করার ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তা নামাযে তিলাওয়াতের অভিমত প্রদান করেন। অবশ্য এই অভিমত তিনি বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের স্বার্থে প্রত্যাহার করে নেন। এ ঘটনায়ও ইসলামে মাতৃভাষা মূল্যায়নের প্রমাণ মেলে। এ ছাড়া মনের আকাঙ্ক্ষা কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে নিবেদন করতে হলেও মাতৃভাষা ব্যতীত সম্ভব হয় না। মনের আকুতি প্রকাশ করে বিনতিপূর্বক প্রার্থনায় মন ও আত্মার মাঝে এক স্বর্গীয় অনুভূতি তৈরি হয়। বান্দার আর্তি আল্লাহর কাছে কবুল হওয়া না হওয়ার দোলায় দুলেও মাতৃভাষায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে পেরে সাময়িক জাগতিক শান্তির ছোঁয়া পায়। বঙ্গবাণী কবিতায় আবদুল হাকিম তাই যথার্থই বলেছেন : 'যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ, সেই বাক্য বুঝে প্রভু আগে নিরঞ্জন'। অনুরূপ স্বদেশী ভাষা কবিতায় রামনিধিগুপ্ত বলেছেন: নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশীভাষা মিটে কি আশা।
মাতৃভাষা মূলত মহান আল্লাহর দেয়া অপূর্ব নিয়ামতের অংশ। এই অপার নিয়ামতকে সার্থক করতে হলে মাতৃভাষাকে আমাদের জাগতিক ও পারত্রিক কল্যাণে কাজে লাগাতে হবে। মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণায় লেখক, গবেষক, কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের লেখালেখি ও জ্ঞান-গবেষণায় মাতৃভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক, ইসলামী সাহিত্য ও কুরআন হাদীস বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে মাতৃভাষার ব্যাপক প্রসারে এগিয়ে আসতে হবে। ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্টিং মিডিয়াগুলোতে বিদগ্ধ ইসলামী স্কলারদের দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। ভাষা আন্দোলন ও ২১ ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে আলিমদের মূল্যায়ন ও অবস্থান আরো স্পষ্ট করতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ২:৪৮
১৩টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বেফাঁস মন্তব্য করায় সমালোচনার মুখে সমন্বয়ক হাসিবুল ইসলাম !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৩ রা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১১:৩২



"মেট্রোরেলে আগুন না দিলে, পুলিশ না মারলে বিপ্লব সফল হতো না "- সাম্প্রতিক সময়ে ডিবিসি নিউজে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করে সমালোচনার শিকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসিবুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমিত্ব বিসর্জন

লিখেছেন আজব লিংকন, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ রাত ১:৪৮



আমি- আমি- আমি
আমিত্ব বিসর্জন দিতে চাই।
আমি বলতে তুমি; তুমি বলতে আমি।
তবুও, "আমরা" অথবা "আমাদের"
সমঅধিকার- ভালোবাসার জন্ম দেয়।

"সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট"
যেখানে লাখ লাখ শুক্রাণুকে পরাজিত করে
আমরা জীবনের দৌড়ে জন্ম... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ হঠাৎ মেহজাবীনের পিছে লাগছে কেন ?

লিখেছেন শিশির খান ১৪, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৭:৪১


স্বৈরচারী আওয়ামীলীগ এইবার অভিনেত্রী মেহজাবীনের পিছনে লাগছে। ৫ ই আগস্ট মেহজাবীন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন ‘স্বাধীন’। সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট যুক্ত করে অভিনেত্রীকে উদ্দেশ্য করে আওয়ামী লীগ তার অফিসিয়াল ফেইসবুকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

×