বিশ্বখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, পৃথিবীতে ২৭৯৬টি ভাষা প্রচলিত আছে। তবে ভাষার প্রকৃত পরিসংখ্যান আজও নির্ণীত হয় নি। মাতৃভাষার প্রতি মানুষের সংরাগ চিরকালীন। বর্ণিল পৃথিবীকে আরো স্বপ্নিক ও আলোকিত করতে বাংলাভাষার প্রতি আমাদের মমত্ববোধ যে কোনো ভাষার চেয়ে বোধ করি বেশি। দেশমাতৃকার জন্য আত্মত্যাগ ও প্রাণোৎসর্গের ঘটনা জানা থাকলেও কোনো জাতি তার মাতৃভাষার জন্যে জীবনকে বিসর্জন দিয়ে শাহাদাতের মর্যাদা নিয়েছে এমন নযীর ইতিহাসে নেই। জাগতিক উৎকর্ষ ও নানাবিধ ব্যক্তিমোহের প্রতি কোনোরূপ ভ্রূক্ষেপ না করে বাঙালি জাতি মাতৃভাষাচর্চার গুরুত্বকে অনুধাবন করে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য প্রাণোৎসর্গ করেছিলো। সেদিন ঢাকার পিচঢালা পথকে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রঞ্জিত করেছিল শহীদী চেতনায় উজ্জীবিত সালাম, বরকত, রফিক ও জব্বারের মত নাম না জানা আরো অনেক ভাষা সৈনিক। ভাষা আন্দোলন করে নিজের প্রাণকে বিলিয়ে দিয়ে তারা মাতৃভাষা বাংলাভাষার নাম বিশ্ব-ইতিহাসে রক্তে লিখে গেলেন। রক্তের বন্যায় সেদিন ভাষার বিজয়কে ছিনিয়ে এনেছিল বাংলাদেশের ভাষা সৈনিকগণ। এ বিজয় আত্মত্যাগের, এ বিজয় গৌরবের। ভাষার লড়াইয়ে তাদের আত্মোৎসর্গ আজ বিশ্ববাসীর কাছে মর্যাদায় আসীন। ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদের ৩০তম পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বাঙালি জাতির এ ব্যতিক্রমী ভাষার লড়াইয়ে অভূতপূর্ব বিজয়কে স্মৃতিবহ করে রাখতে ২১ ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা' দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ইউনেস্কোর কল্যাণে সকল জাতি এখন বাংলাভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং বাঙালি জাতির ভাষা-শহীদদের প্রতি অবনত-মস্তক। ২১ ফেব্রুয়ারি সম্মান লাভ করেছে, বিশ্বে বাংলাভাষার মর্যাদাও উন্নীত হয়েছে। এ গৌরব মাতৃভাষা বাংলার, এ গৌরব বাঙালি জাতির। উল্লেখ্য, বাংলা শুধু বাংলাদেশের নয়, বিহার প্রদেশের পূর্ণায়া জেলার পূর্বাংশ, রাঁচি, হাজারিবাগ, সাঁওতাল, পরগনা, সিংহভূম ও মানভূমের ভাষাও বাংলা। আসাম প্রদেশের করিমগঞ্জ, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া জেলার ভাষা বাংলা। বার্মার আরাকানের চলিত ভাষা বাংলা। এ ভাষাভাষীর সংখ্যা হিসেবে বাংলা পৃথিবীর সপ্তম স্থানে রয়েছে।
ইসলামে মাতৃভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। অপরিসীম গুরুত্বের সাথে মাতৃভাষাকে স্মরণ করে ইসলাম। মাতৃভাষা শিক্ষা ও বিকাশে ইসলামের রয়েছে অকুণ্ঠ সমর্থন। আল্লাহ তাআলা নবী রাসুলদের কাছে যুগে যুগে যেসব আসমানী কিতাব প্রেরণ করেছেন, তা তাঁদের নিজ নিজ মাতৃভাষায় প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ বলেন: 'আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার জাতির লোকদের মাতৃভাষাতেই প্রেরণ করেছি। (সূরা ইবরাহীম: ৪) যেমন হযরত দাউদ (আ) এর কাছে যাবূর কিতাব তার মাতৃভাষা ইউনানী বা (আরামাইক) ভাষায়, মূসা (আ)-এর কাছে তাওরাত ইবরানী বা হিব্রু ভাষায়। এটাও তাঁর মাতৃভাষা। এভাবে ঈসা (আ) এর কাছে তাঁর মাতৃভাষা সুরিয়ানি বা সিরিয়ার ভাষায় ইনযিল কিতাব ও মুহাম্মদ (স) এর কাছে মাতৃভাষা আরবি ভাষায় আল-কুরআন প্রেরণ করা হয়। এসব আসমানী কিতাব যদি মাতৃভাষায় নাযিল না করতেন তবে এগুলো নাযিলের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতো। হিদায়াত ও অনুধাবনের পরিবর্তে চরম শ্রদ্ধাভরে বুকসেলফে সাজানো ছাড়া আর কোন লাভ হতো না। কেননা এসব আসমানী কিতাব নাযিলের মৌল উদ্দেশ্য হচ্ছে পুণ্য হাসিলের জন্যে এর মর্ম অনুধাবন করা। ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে-এর আলোকে জীবনব্যবস্থা কায়েম করা। কুরআনে এসেছে: আর যদি আমি কুরআন অনারবদের ভাষায় নাযিল করতাম তবে অবশ্যই বলতো -- এর আয়াতসমূহ বিস্তারিতভাবে বিবৃত হয় নি কেনো? এ কেমন কথা, অনারবী কিতাব এবং আরবিভাষী রাসুল। আপনি বলুন : এ কুরআন মুমিনদের জন্যে হিদায়াত ও ব্যাধির প্রতিকারস্বরূপ। কিন্তু যারা ঈমান আনে না তাদের কাছে রয়েছে বধিরতা এবং কুরআন তাদের জন্য অন্ধত্বস্বরূপ। (সুরা হা মীম-সাজদা: ৪৪) আল্লাহ অন্য একটি আয়াতে বলেন: 'আমি তো কুরআন আরবিতে নাযিল করেছি এ জন্যে যে, তোমরা তা বুঝবে।' (সূরা ইউসুফ:২) ইমাম আবু হানিফা (রা) মাতৃভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তাঁর দেশবাসীর জন্যে মাতৃভাষা ফারসি ভাষায় আল-কুরআন অনুবাদ করার ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং তা নামাযে তিলাওয়াতের অভিমত প্রদান করেন। অবশ্য এই অভিমত তিনি বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের স্বার্থে প্রত্যাহার করে নেন। এ ঘটনায়ও ইসলামে মাতৃভাষা মূল্যায়নের প্রমাণ মেলে। এ ছাড়া মনের আকাঙ্ক্ষা কায়মনোবাক্যে আল্লাহর কাছে নিবেদন করতে হলেও মাতৃভাষা ব্যতীত সম্ভব হয় না। মনের আকুতি প্রকাশ করে বিনতিপূর্বক প্রার্থনায় মন ও আত্মার মাঝে এক স্বর্গীয় অনুভূতি তৈরি হয়। বান্দার আর্তি আল্লাহর কাছে কবুল হওয়া না হওয়ার দোলায় দুলেও মাতৃভাষায় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে পেরে সাময়িক জাগতিক শান্তির ছোঁয়া পায়। বঙ্গবাণী কবিতায় আবদুল হাকিম তাই যথার্থই বলেছেন : 'যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ, সেই বাক্য বুঝে প্রভু আগে নিরঞ্জন'। অনুরূপ স্বদেশী ভাষা কবিতায় রামনিধিগুপ্ত বলেছেন: নানান দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশীভাষা মিটে কি আশা।
মাতৃভাষা মূলত মহান আল্লাহর দেয়া অপূর্ব নিয়ামতের অংশ। এই অপার নিয়ামতকে সার্থক করতে হলে মাতৃভাষাকে আমাদের জাগতিক ও পারত্রিক কল্যাণে কাজে লাগাতে হবে। মাতৃভাষা চর্চা ও গবেষণায় লেখক, গবেষক, কবি, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের লেখালেখি ও জ্ঞান-গবেষণায় মাতৃভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাঠ্যপুস্তক, ইসলামী সাহিত্য ও কুরআন হাদীস বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে মাতৃভাষার ব্যাপক প্রসারে এগিয়ে আসতে হবে। ইলেকট্রনিক্স ও প্রিন্টিং মিডিয়াগুলোতে বিদগ্ধ ইসলামী স্কলারদের দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। ভাষা আন্দোলন ও ২১ ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে আলিমদের মূল্যায়ন ও অবস্থান আরো স্পষ্ট করতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ রাত ২:৪৮