দিয়া আজ প্রচণ্ড টেনশনে আছে। প্রায় একবছর পর মিতুর সাথে দেখা হবে আজ। মিতু ওর ছেলেবেলার বন্ধু। গতবছর কানাডায় চলে গিয়েছিল এমবিএ করতে। এবারে দুর্গাপূজায় বাড়ীতে এসেছে। আর এসেই কল দিয়েছে দিয়াকে, এই দিয়া! কবে বসবো তোর সাথে? অনেকদিন জসিম স্যুপ খাওয়া হয় না।
দিয়া ফিক করে হেসে দিয়েছিল, ওই জঘন্য ফ্যানের মত জিনিসকে তুই এখনো স্যুপ বলিস! কানাডায় কি স্যুপ পাওয়া যায় না নাকি! এরচেয়ে পাগলা বাবুর্চির দর্গায় চল, নাগা বার্গার খেয়ে আসি।
আরে, যাবো তো! তোর পাগলা বাবুর্চির দর্গায়ও যাবো! কিন্তু আগে জসিম স্যুপ, প্লিইইইজ! - মিতু এবার একটু ন্যাকা স্বরেই বললো।
আচ্ছা, বাবা আচ্ছা! যাবো ওই ফ্যান খেতে। - হার মেনে নিয়ে বললো দিয়া।
ভালো কথা! তুই যে পাগলা বাবুর্চির দর্গায় যাবি, ওখানে কতো হাই ফাই মেয়েরা আসে জানিস! তোর যা ফ্যাশন সেন্স! ঢোলা লুঙ্গি পড়ে চলে আসিস না আবার! - মিতুটার আর টিপ্পনি কাটা গেলো না! দিয়া ভাবলো, কোন মেয়েকে এভাবে বলতে আছে! তার উপর সমবয়সী এক ছেলে যদি এভাবে বলে, লজ্জা লাগে না!
আসলেই দিয়ার ফ্যাশন সেন্স প্রচণ্ড খারাপ। জীবনের প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ তে জিন্স আর টপ্স পড়ে চলে গিয়েছিল ও! ইন্টারভিউ বোর্ডে বসার পর মনে হয়েছে, আরেহ! ফর্মাল ড্রেস পড়া উচিৎ ছিল! সেবার মান ইজ্জত বেঁচেছিল যে চাকরিটা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরেরবার তাও বাঁচেনি। পরে অন্য একটা জায়গায় ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল পালাজ্জো আর টি-শার্ট পড়ে। সেবারও বাসা থেকে বের হওয়ার সময় টের পেয়েছিল যে ভুল পোশাক পড়ে চলে এসেছে ও। কিন্তু ততক্ষণে আর ফেরার উপায় ছিল না। এরপর চাকরিটা আর হয়নি।
ও হ্যাঁ! যা বলছিলাম, দুইদিন হয়ে গেল দিয়া এখন পর্যন্ত একটা জাতের কিছু খুঁজে বের করতে পারেনি, যেটা ওর মিতুর পছন্দ হবে। অবশ্য ছেলেটা কোনদিন ওর দিকে প্রশংসার দৃষ্টিতে তাকায়ই না! সারাক্ষণ শুধু শয়তানি আর শয়তানি! একবার খুনসুটি করে পায়ে লাথি দিয়ে দিয়েছিল। লাথি খেয়ে মিতু কিচ্ছু বলেনি, ঠিক যাওয়ার আগে আগে বলে গিয়েছে, কোন হাতি যদি বাচ্চা একটা ছেলেকে লাথি দেয়, কেমন লাগবে? হি হি হি হি! লজ্জায় মরে গিয়েছিল সেদিন দিয়া। ফালতু ছেলে কোথাকার!
নাহ! আজকে আমাকে মোটা লাগা যাবেই না! ভাবলো দিয়া, হাজার হোক একবছর পর ফালতুটার সাথে আজকে দেখা হবে! আজকে আমাকে হাতি বলতে পারবে না কিছুতেই।
শাড়ী পড়লে একটু মোটা কম লাগে। মিতুর আবার লাল শাড়ী পড়া মেয়েদের খুব ভালো লাগে। রাস্তা দিয়ে কোন লাল শাড়ী পড়া মেয়ে হেঁটে গেলে হা করে তাকিয়ে থাকতো, বাহ! সুন্দর তো! কি স্মার্ট মেয়ে দেখেছিস??? ইশ! ওই মেয়ে শাড়ী পড়ে এত্ত বড় লেন্সটা হাতে নিয়ে যাচ্ছে! প্রেম করতে হলে এমন মেয়ের সাথেই করবো!
লাল শাড়ীই পড়বো, ঠিক করলো দিয়া। মায়ের আলমারি থেকে লাল কাঁচের চুড়িও বের করে নিলো। কানে কি রিংগুলোই থাকবে? নাকি ওই মেয়ের মত লম্বা দুল পড়বো? ভালো লাগে তো মিতুর! আচ্ছা থাক! আগে ট্রায়াল দিয়ে দেখি।
শাড়ী পড়ে এসে মায়ের আলমারির আয়নার সামনে দাঁড়ালো দিয়া। নাহ! ওকে আজ যাই পড়ুক, ভালো লাগছে না একদমই! চুড়িগুলোকে মনে হচ্ছে বাহুল্য। কানের দুলে ওকে একদম মানাচ্ছে না। এই লম্বা কোঁকড়া চুল ও কি করবে? সাধারনত ছেড়েই দেয়, আজ কি বাঁধলে ভালো লাগবে? লাল লিপস্টিকটা ক্ষ্যাত লাগছে একদম! ইশ! নাকটা ফোঁড়ানো থাকলে ভালো হতো। নাকে ছোট্ট ডায়মণ্ডের ফুল পড়া মেয়েদেরকে ভালো লাগে মিতুর! আবারো আয়নার দিকে তাকালো দিয়া, ধ্যাত! একদম ক্ষ্যাতের মত লাগছে। রেগে গিয়ে মেকাপ, লিপস্টিক সব তুলে ফেললো, কানের দুলটাও খুলে রাখলো। হাত ভর্তি চুড়িও আর মানাচ্ছে না।
দুঃখে একদম নীল হয়ে গেল দিয়া। ফোনের ডায়াল ঘুরিয়ে মিতুকে কল দিলো, এই তুই আসিস নারে আজকে! ভালো লাগছে না, বের হবো না। মিতু তো একদম রেগে কাই, আসবো না মানে! আমি তোর বাসা থেকে আর ১০মিনিট দূরে আছি! ১০ মিনিটের মধ্যে বের হ তুই! না হলে কানে ধরে নিয়ে যাবো, আগে মনে ছিল না যে ভালো লাগবে না! আগে বললি না কেন, হাতি কোথাকার!
তোর সাথে কথা বলাই বেকার! ফালতু কোথাকার! আয় তুই আমি নামছি। বলে খট করে ফোনটা রেখে দিল দিয়া। বাথরুমে গিয়ে কতক্ষণ কেঁদে নিলো, এমন কেন হয় আমার সাথে! প্রত্যেকবার এমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাজি আর যাওয়ার সময় সব তুলে এমন সাদা মুখ নিয়ে যাই! ঘণ্টা ভালোবাসবে আমাকে মিতু! কাঁদতে কাঁদতেই লাল শাড়ীর আঁচলটা ঠিক করে নিলো। মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে বের হয়ে এল। লিফটের আয়নায় নিজেকে দেখলো, চোখে কাজলের একটু রেখা দেখা যাচ্ছে, আর কপালের মাঝে শুধু একটা কালো টিপ আছে। ব্যাস! শেষ দিয়া'র সাজ!
লিফটের দরজা খুলতেই দেখলো মিতুটা একদম শিয়ালের মত উঁকি দিয়ে আছে, কিরে হাতি! যা বলছিলাম! তুই ক্ষ্যাত তো ক্ষ্যাত-ই থাকবি আর ওয়েস্টার্ন রেস্তোরায় শাড়ী পড়ে যাবি! হা হা হা হা! সাথে সাথে দিয়ার মুখ থমথমে হয়ে গেল, আচ্ছা চল তো! রিকশা ডাক।
রিকশায় যাবো না, ফকিরনি! আজকে উবারে যাবো! উবার! তিড়িং বিড়িং করে নাচতে নাচতে বললো মিতু।
গাড়ীতে উঠে কেন যেন কান্না পেল দিয়ার। এত্ত সুন্দর একটা ছেলে মিতু! ওর পাশে আসলেই একদম কুৎসিত লাগে নিজেকে। এত বছর অনেক কথা বলেছে মিতু, তারপরও মনে কষ্ট নেয়নি। কিন্তু আজ আর আটকে রাখতে পারলো না, টপটপ করে চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। মিতু যেন দেখেও দেখলো না, নিজের মত কথা বলতেই থাকলো; হাতটা ধরে থাকলো শুধু। গাড়ি থেকে নেমে রাস্তা পার না হয়ে মিতু সোজা ধানমণ্ডি লেকের পাড়ে টেনে নিয়ে গেল দিয়াকে, এখনো কাঁদছিস?
- কই কাঁদছি!
- কাঁদছিস তো!
- না, কাঁদছি না!
- আচ্ছা, কাঁদ। পানির দিকে তাকিয়ে কাঁদ। ভালো লাগবে।
- এখানে আনলি কেন, ম্যাডশেফে চল! বার্গার খেয়ে বাড়ী যাবো।
- আচ্ছা, যাবো। আমি একটা কবিতা লিখেছি, শুনে নে আগে!
- না শুনবো না!
আকাশে উড়লাম
পাগলিটাকে রেখে আসলাম মাটিতে
প্রতিদিন আমার জন্য লাল জামা পড়তো সে
কপালে ছোট্ট কালো টিপ দিতো
কোঁকড়া চুলগুলো ছেড়ে দিতো কোমর অবদি
ও হ্যাঁ! চোখে গতরাতের কাজলও থাকতো!
রেখে আসলাম পাগলিটাকে!
আমার জন্য অপেক্ষায় থাকবে তো?
চোখে পানি নিয়ে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলো দিয়া, এইটা কি ছিল?
- কবিতা!
কবিতা ছিল? আশেপাশের লোকজন তোকে পাগল ভেবেছে, গাধা! চল বার্গার খাই!
- যাবো। তুই আগে ডিসাইড কর আমাকে লোকে পাগলে ভেবেছে? নাকি গাধা?
- দুইটাই ভেবেছে! চল তো এখন!
হাসতা হাসতে লেকের গেটের দিকে হাঁটা শুরু করলো ওরা। কিছুদুর গিয়ে দিয়া হাত ধরলো মিতুর। মিতু ঝটকা দিয়া ছাড়িয়ে নিলো, করিস কি! লোকে আমাকে মোটুর জামাই ভাববে! এরচেয়ে পাগল গাধাও ভালো!
ফালতু কোথাকার! বলে কষে একটা লাথি লাগিয়ে দিল দিয়া মিতুর পায়ে। লাথি খেয়ে আজ মিতু হেসে কুটিকুটি হয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে।
***
সাত বছর পর একদিন দিয়া মিতুকে জিজ্ঞেস করলো, আমাকেই কেন ভালোবাসলি? কত সুন্দর মেয়ে ছিল তোর আশেপাশে! সারদিন তো ওদেরই দেখে বেড়াতি! মিতু উত্তর দিলো, মেয়ে দেখতে তো আজও আমার ভালো লাগে! তোকে কেন? কারণ, তুই অন্যদের মত ছিলি না। তুই ছিলি তোর মত! আলাদা!
দিয়া হা হয়ে শুনছিলো, মিতু কত সুন্দর করে বলছে! মিতু বলে যেতে থাকলো, হ্যাঁ তুই ছিলি একদম আলাদা। মোটু, হাতি আর গাধা! পাগলের মত লম্বা কোঁকড়া চুল ছিল তোর, আঁচড়ানোর বালাই ছিল না। চাইনিজদের মত ছোট চোখে শুকনো কাজল দিয়ে আরো ভরিয়ে ফেলতি! হা হা হা হা!
দিয়া চিৎকার দিয়ে উঠলো, মিতু! মিতু এবার হেসে দিয়ার পেটে হাত রেখে বললো, ও হ্যাঁ! আমি চাই আমাদের ছোট্ট রীতি তোর মত হোক! ঠিক আরেকটা দিয়া!
এবার দিয়ার কেঁদে দেয়ার পালা। তবে এবার আর মিতু বিদঘুটে কবিতা বললো না, ওকে জড়িয়ে ধরে সিঁথিতে আলতো করে চুমু এঁকে দিলো।
***
বিঃদ্রঃ ৩০ দিন লেখালেখি চ্যালেঞ্জের আজ দ্বিতীয় দিন। আজকের বিষয় ছিল পোশাক। গল্প আমি একদমই লিখতে পারি না। পার্সোনাল ন্যারেটিভস লেখার অভ্যাস আমার। তা-ও একটু চেষ্টা করলাম! ধন্যবাদ!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১৭ দুপুর ১:০৮