খুব ছোটবেলায় পাশের বাসায় এক আংকেল থাকতেন। তিনি আমাকে দেখলেই বলতেন, স্মৃতি তুমি বেদনা! (বাসায় আমার ডাকনাম স্মৃতি) উনি আমাকে খেপানোর জন্য বলতেন, সফলও হতেন। কিন্তু সেই ছোট্ট আমি'র মধ্যে এই একটিমাত্র বাক্য প্রচণ্ড্ভাবে প্রভাব ফেলতো। মনে হতো, আসলেই কি তাই! স্মৃতি কি বেদনারই হয়??
কলেজে যাওয়া শুরু করার পর বন্ধুরা যখন আমার সাদিয়া নামটিকে ছোট করে স্যাড ডাকা শুরু করলো, তখন একদম নিশ্চিত হয়ে গেলাম, নাহ! স্মৃতি শুধু বেদনারই হয়! নাহলে আমার সব নামে এমন বেদনা বেদনা নির্যাস থাকবে কেন! আম্মা-ই তো বলে, নামের অর্থ মানুষের চরিত্রে অনেক প্রভাব ফেলে। আমারও নির্ঘাত তাই-ই হয়েছে!
কলেজের শেষ দিনগুলোতে প্রেম এলো জীবনে। একদিন সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তোমাকে কি স্মৃতি নামে ডাকবো? নাকি সাদিয়া? আমি বললাম, প্লিজ তুমি আমাকে সাদিয়া-ই ডেকো। স্মৃতি শুধু বাসার লোকজন ডাকে। অন্যকেউ ডাকলে আমার রাগ লাগে!
নাম নিয়ে এমন হেন তেন অবস্থা সব সময়-ই হয়েছে।
ভার্সিটি তে আসার পর দেখা গেল ক্লাসে তিন তিনজন সাদিয়া। অগত্যা নাম হিসেবে বেছে নিতে হলো আমার শেষ সম্বল, হালিমা! এই নামটা আমি কোথাও ব্যবহার করতে চাইতাম না। ব্যাকডেটেড বলে নয়! সবাই এই নাম শুনে অদ্ভূত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতো আর বলতো, নবীজীর দুধ মায়ের নাম হালিমা ছিল, তাই না? তাঁর নামে নাম হওয়াতে আমার যেখানে গর্ববোধ করার কথা, সেখানে আমি কুঁকড়ে যেতাম মানুষের উদ্ভট দৃষ্টির সামনে। পালক মা বলা যায়, দুধ মা কেন বলতে হবে?? কিশোরী আমি লজ্জায় ছোট হয়ে যেতাম।
একটা সময়ে দেখা গেল যখন পাবলিক গ্যাদারিংয়ে নিজের নাম বলতে হতো, আমার গলার স্বর নিচু হয়ে যেত। কাঁচুমাঁচু করে বলতাম, আমি হালিমা-তুস-সাদিয়া। মনে হতো, এইরে! এই বুঝি হেসে দিলো! এই বুঝি জেনে গেলো যে আমি খুবই দুঃখি মানুষ! এই বুঝি টের পেয়ে গেল যে আমি সারা দুনিয়ায় দুঃখ ছড়িয়ে বেড়াই!
একদিন একজনের সাথে দেখা হলো। খুবই বিশেষ মানুষ। যদিও এখন আর তিনি আমার সাথে নেই। এই প্রথম একজন আমার নাম শুনে বললো, বাহ! সুন্দর নাম তো! (এমন না যে অন্য কেউ বলেনি! কিন্তু এই লোকটার কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হলো) আস্তে আস্তে আমরা আড্ডা দেয়া শুরু করলাম, বন্ধু হয়ে গেলাম। এমন অবস্থা হলো, আমি চোখ মেলে তাকালেও দৌঁড়ে গিয়ে বলতাম, ভাইয়া দ্যাখেন চোখ মেলেছি! আমি ওনাকে অনুমতি দিলাম, আচ্ছা! আপনি আমাকে স্মৃতি বলে ডাকতে পারেন। তিনি একদম গালভরে কয়েকবার বললেন, বাহ! সুন্দর তো! স্মৃতি! স্মৃতি! স্মৃতি! আমরা দুজনের কেউই টের পাইনি তখন যে তাকে কি অবস্থান দিয়ে দিলাম আমার জীবনে! তিনি বোধহয় আজও টের পাননি, কি জানি! আবার টের পেতেও পারেন! সবাই বলে, আকাশের ওপার থেকে নাকি সব টের পাওয়া যায়!
আমি তাকে রোদ বলতাম (এখনো বলি)। রোদ আমার কাছে সূর্যরশ্মি, নতুন দিনের শুরু। সুবোধের মত পালিয়ে না যাওয়া রোদ, খাঁচায় বন্দি থেকেও একটু একটু করে আলো দেয়া রোদ।
ভাইয়া চলে গেলেও রোদটা রেখে গিয়েছেন। অনুপ্রেরণার রোদ। প্রতিটা কাজে এখনো মনে হয়, ইশ! তিনি যদি থাকতেন! ইশ! যদি দৌঁড়ে গিয়ে দেখাতে পারতাম ভাইয়াকে! এই ইশ আমাকে প্রতিদিন শক্তি যোগায়। প্রতিদিনই আমার একদিন হয়; অনুপ্রেরণার একদিন। অফিসে প্রেজেন্টেশন দিতে গিয়ে জোর গলায় বলি, হ্যালো, আই এম হালিমা-তুস-সাদিয়া, ইওর হোস্ট ফর দ্যা সেশন! সামাজিক মাধ্যমে বড় বড় করে লিখে রাখি, আই এম মি, দ্যা রেইনবো ইন মাই ওউন ক্লাউড। গর্ব করি আমার আমি হওয়ার জন্য। নামটা এখন আর পোড়ায় না আমাকে। সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়।
মায়ের কথাই ঠিক। নামের অর্থ মানুষের ব্যক্তিত্বে ফুটে ওঠে। হালিমা-তুস-সাদিয়া-এর অর্থ সর্বংসহা সৌভাগ্যবতী রমনী। সাবমিসিভ মনে করলে সাবমিসিভ কিন্তু যদি শক্তিশালী মনে করি তবে বেশ শক্তিশালী! কেন সর্বংসহা, কেন সৌভাগ্যবতী তার নতুন অর্থ খুঁজে বের করেছি আমি। সেকথা আরেকদিন বলবো। আপাতত স্মৃতি হয়ে থাকতে চাই আমি। কিছুদিন পর হয়তো আর এই নামে কেউ ডাকবে না, হারিয়ে যাবে। হালিমা নামেও কেউ ডাকবে না, সেটাও হারিয়ে যাবে। ডাকবে সাদিয়া নামে, সৌভাগ্যবতী নামে। কিন্তু মনে মনে আমি হালিমা-তুস-সাদিয়া (স্মৃতি), কাজেও আমি হালিমা-তুস-সাদিয়া (স্মৃতি)। ডাকুক না কেউ হালিমা, কেউ সাদিয়া!
অফিসের এইচ আর ভদ্রলোক আমার নাম ভুল লিখেছিলেন, হালিমা তুস সাদিয়া। এপয়েন্টমেন্ট লেটার থেকে কিচ্ছু পরিবর্তন করিনি, শুধু বলেছিলাম, নামটা ঠিক করে লেখেন, প্লিজ! আমার নামের তিনটা অংশ না, একটা নাম! হালিমা-তুস-সাদিয়া। ব্র্যাকেটের ওই ছোট্ট স্মৃতিটা আমার কোন সার্টিফিকেটে লেখা নেই। তবে আমরা যেমন অনেক বড় একটা বাক্য লিখে ব্র্যাকেটে এক-দুই শব্দে বুঝিয়ে দেই কি লিখতে চেয়েছি, স্মৃতিটা ঠিক তেমন। এই স্মৃতি বেদনার না, এই স্মৃতি শুধুই স্মৃতির। সব কিছু সহ্য করেও সৌভাগ্য নিয়ে আসে এই স্মৃতি। আগের ঘটনাগুলোকে পজিটিভ করে ফেলে এই স্মৃতি। বয়ঃসন্ধিতে থাকা কিশোরি মেয়েটার মতো প্রাণখুলে হাসে এই স্মৃতি, কেউ তাকিয়ে না থাকলে ধেই ধেই করে নেচেও ফেলে একটু। মোবাইলের ক্যামেরা লেন্সে আঙ্গুল দিয়ে ঢেকে কালো স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে ৩০ সেকেন্ডে হেরে গলায় গানও গেয়ে ফেলে সে। একদিনে বাঁচে এই স্মৃতি।
চলে যাওয়া লোকটার কথা খুব মানি। একদিন ফিস ফিস করে বলেছিলেন, আমি জানি! কেউ না পারলেও তুমিই পারবে ওদের দাঁড় করিয়ে দিতে। তোমাকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখি আমি, তুমি উঠবে। একটা দিন অতীতে তাকিয়ে বলবে, বাহ! সুন্দর তো! এই লোকটা আমার একদিনে আটকে আছে। তাকে নিয়ে যত স্মৃতি সব মনে হয় একদিনেই ঘটেছে। এই তো দেখা হলো সেই নভেম্বরে, পরের নভেম্বরে তিনি নেই! মাঝের এই একটা দিন শুধু আমাকে চালিয়ে নিয়ে যায়। কষ্ট পেলে কেঁদে দেই আমি এক পলকেই, আর মনে মনে তাকে ডাকি, আপনি নেই কেন! আপনি থাকলে এরকম হতো আমার! জ্বর হলেও বলি, আপনি নেই কেন! আপনার দোষ! কে জানে! তিনি হয়তো ফিক করে হেসে ফেলেন আমার ছেলেমানুষী দেখে! আবার হয়তো আত্মবিশ্বাসী আমাকে দেখে গর্ববোধ করেন! আমি জানি না। আমি শুধু জানি, আমাকে তাই-ই করতে হবে যাতে তিনি গর্ববোধ করেন। এমন কিছু করা যাবে না যাতে তিনি লজ্জিত হন।
বড় হয়ে যাচ্ছে লেখা। শেষে এসে এতটুকু বলবো, যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন! শান্তি আসুক। আমি দ্বিতীয় জীবনে বিশ্বাস করি না, তারপরও যদি কোন জীবনে দেখা হওয়ার সুযোগ থাকে, আপনি যেন আমাকে চিনতে পারেন। রোদের সাথে বৃষ্টিও যেন হতে পারেন সেদিন। আমি কিন্তু স্মৃতিই থাকবো! আপনাকে ঠিকই চিনে নেবো আমি। এখন যেমন প্রতিদিন ছুঁয়ে দেই আপনার ভাবনাগুলোকে, তখন প্রতিমুহুর্তে ছুঁয়ে দেবো, ভাইয়া!
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০১৭ দুপুর ১:০৩